প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম
Advertisement
‘এ বিশ্বে যাহা কিছু আছে কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর’। নারী পুরুষ মিলে সাজানো হয়েছে বাস্তব দুনিয়া। দ্বিগ্বিজয়ী পুরুষ যোদ্ধারা যেমন পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে চষে বেড়িয়েছেন, নারী যোদ্ধারাও কম যাননি। যুদ্ধে পুরুষ আহত হলে নারী জীবন বাঁচাতে এগিয়ে এসে হয়েছে তার সেবিকা। করুণাময়ী নারী কখনও হয়েছেন ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল, কখনও মাদার তেরেসা আবার দেশ মাতৃকা রক্ষার জন্য কখনও রাইফেল হাতে নিয়ে হয়েছেন তারামন বিবি।
আবার নারীদের অন্যরূপও প্রত্যক্ষ করা গেছে যুগে যগে। নির্যাতিত মানুষের সাহায্যে হাত বাড়াতে গিয়ে কেউ হয়েছেন দস্যু ফুলন দেবী, কেউ শোভা, অর্চনা বলিমুসুন্ডা, সোনাভান, অঞ্জলি মাকান, জামিরা, বুপাশা, খাওলা, জেনাবী জুমানি। আবার কেউ মানুষকে নির্যাতনে সহযোগিতা করার জন্য বিভিন্ন মাফিয়াদের সেবাদাসী হয়ে দুর্ধর্ষ শিলা, পিন্কি, প্রিয়তি, কালিনী, মাযমা, কাজুকো ফুকুদা, ডন যুয়ান, বনি পার্কার, মারিয়া লিসিয়ার্দি, জি ব্লান্কো, মা বার্কের, কুইংচেং জিংলিং, বেলে স্টার সহ আরো কত নাম না জানা নারীরা যুগে যুগে অপরাধীর খাতায় যুক্ত হয়েছেন তা হয়তো অনেকের জন্মের আগের কথা বা অনেকের স্মরণে নেই। তখন তাদের ঘোড়া ছিল, ছিল পশুর চামড়ার বসন, অস্ত্র হিসেবে দোনলা বন্দুক, বুমেরাং, চাকু, তলোয়ার আরো কতকিছু!
আমাদের দেশে নারী চোর ও দস্যুর কথা শোনা গেলেও নারী ডাকাতের কথা তেমন একটা শোন যায় না। ঘরপালানো বা পাচার হয়ে যাওয়া নারীরা মাজার অথবা সাঁইগুরুদের কাছে ঠাঁই পেয়ে সেবাদাসী হিসেবে জীবন কাটালেও বড় কোন অপরাধে জড়াতে চাইতো না। বৈরাগী-বৈরাগিনী হয়ে গান গেয়ে ভিক্ষা করে তাদের জীবনটা পার করে দিত। সমাজ তাদেরকে ঘৃণা করতো না।
Advertisement
যুগের পরিবর্তনে মানুষের ভোগবাদী মনোভাবের উদয় হয়েছে। জমিদার, লাট, নেতা, আমলা নির্ভর বিলাসী সমাজে একসময় যাত্রা, মেলা, বাইজী নাচ, ঘেঁটুনাচ ইত্যাদি ছিল অবসরের বিনোদন। সাথে দেশী মদ, গাঁজা, ভাং, চরস ইত্যাদির নেশায় বুঁদ হয়ে রাত পার করে দিত এক শ্রেণির বিত্তবান ভোগবাদী মানুষ। বিশেষ করে জমিদার, নবাব ও কুঠিয়ালদের রংমহলের ভেতরে আরো কত কিছু ঘটতো সেটা সাধারণ মানুষ জানতে পারতো না। রংমহলের ভেতরের অপরাধ এবং হত্যকাণ্ডের কথা অজানা সুড়ং ও মৃত্যুকূপের মধ্যে হাড়-হাড্ডি উদ্ধারের মাধ্যমে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে বইয়ের পাতায় স্থান করে নিয়েছে।
আমাদের দেশে নারী অপরাধীর হার আগে খুব কম ছিল। ১৯৭১ সালে এই হার ছিল মাত্র ১.৭%, ১৯৯২ সালে ৩.৮%, ২০০৮ সালে বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ১৩%। যারা পারিবারিক সহিংসতার শিকার, বাল্য বিবাহ, ধর্ষণ, দারিদ্র্য ও যৌতুকের বলি হয়ে ডিভোর্স হতো তাদের মধ্যে আত্মহত্যা বেশি ঘটতো। ২০১৯ সালে ধর্ষণের হার ছিল ৩.৮%। ২০২০ সালে আত্মহত্যার হার ছিল ৫% এবং রহস্যজনক মৃত্যু ঘটেছে ৮% নারীর। আগেকার দিনে পুরুষরা ছির বীরপুরুয় আর নারীরা অবলা (প্রথম আলো ০৩.০২.২০২০)। নব্বই দশকে ওপেন ইন্টারনেট চালু হবার পর থেকে নারীরা সাইবার জগতে এগিয়ে এলেও ৫২% নারী সাইবার হামলার শিকার হয়(বিবিসি বাংলা ২০.৫.২০১৮)। তবে পর্নগ্রাফি, ফেক আইডি ব্যবহার ও ব্লাকমেইলিং করে নারীরা পুরুষের তুলনায় বেশী করে সাইবার অপরাধে যুক্ত হয়ে পড়ে(বিবিসি ১৬.১১..২০২০)।
মোবাইল ডিভাইসে ব্লাক মেইলিং এখন সবচে সহজ। কিন্তু এটা মারাত্মক সাইবার অপরাধ-যেখানে ফেক সিম ও ফেক আইডির জন্য নারী-পুরুষকে আলাদা করে চিহ্নিত করা বেশ কঠিন। এই সুবাদে নারী সেলিব্রেটির আড়ালে, রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় তদ্বির ব্যবসার দখল চলে গেছে সাইবার জগতে। আমাদের দেশে সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডে নারীরা এর বড় মাধ্যম হিসেবে চিহ্নিত হয়ে গ্রেপ্তার হচ্ছে।
সাইবার যুগের আবির্ভাবে মানুষ অতিব্যস্ত জীবন যাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। আধুনিক যুগে পার্টি কালচার তৈরি হয়েছে। আধুনিকতার আড়ালে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় কিছু উচ্চশিক্ষিত, মর্যাদাপূর্ণ পেশার অতি উচ্চাভিলাষী লোভী নারী-পুরুষ নেমে পড়েছে প্রতারণার কাজে। গতবছর ধরে গণমাধ্যমে সরব যাদেরকে সরাসরি টিভিতে দেখানো হচ্ছে তারা হলেন- পাপিয়া, সাবরিনা, ডা. ঈশিতা, হেলেনা, পরীমনি, পিয়াসা, মৌ, একা, মুকুল আরো অনেকে। এদের কেউ ডিপ্লোম্যাট, কেউ ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, কেউ মাদক ব্যবসায়ী, কেউ নারী ব্যবসায়ী ও পাচারকারী, কেউ চাকুরীদাত্রী সেজে প্রতারণার ষোলকলা পূর্ণ করে ব্যাপক সামাজিক অবক্ষয় সৃষ্টি করেছেন। সাথে সংযুক্ত হয়েছে নারী ক্ষমতায়নের নামে নারী-পুরুষ সবার উপর চরম অত্যাচার ও নির্যাতন।
Advertisement
এসকল কুলাঙ্গারদের কে বা কারা নেপথ্যে থেকে আস্কারা দিয়ে এতদূর নিচে নামানোর সাহস যুগিয়েছে তাদেরকে খুঁজে বের করার সময় এখন। এসব বেপরোয়া নারীদেরকে সামনে ঠেলে দিয়ে কুকর্ম করার জন্য যারা পেছনে ওঁৎ পেতে কোট পরে সাধু সেজে সবার সামনে ঘুরে বেড়াচ্ছেন তাদের কথা হয়তো শিগগিরই গণমাধ্যমে জানা যেতে পারে। তাদেরকে আগে চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনতে হবে। এজন্য আইন শৃংখলায় দায়িত্বরতদের কঠোর মনোবল ও নৈতিক কমিটমেন্ট প্রয়োজন।
কারণ, এসব ভণ্ড প্রতারক নারীদের অনৈতিক কাজের ব্যাপ্তির সাথে দেশে ব্যাপকভাবে ঘুষ-দুর্নীতির ডালাপালা গজিয়ে গেছে। অফিসের বা মেগা-প্রজেক্টের ফাইল চেপে রেখে সরাসরি অর্থ লেনদেন করাটা অনেকের কাছে ঘৃণা ও চক্ষুলজ্জার কাজ। তাই তারা বিকল্প হিসেবে সুন্দরী স্মার্ট নারীদের ক্লায়েন্টদের পিছনে লেলিয়ে দিয়ে দরকষাকষি করে দামী উপহার নেন। বিদেশে ভ্রমণের বিমান টিকিট, হোটেল ভাড়া, স্বর্ণালঙ্কার, গাড়ি, দামী সিগারেট, বিদেশী মদ ও মাদকদ্রব্য, দামী রেষ্টুরেন্টে খাওয়ানো, দামী আসবাব, প্লট, পোশাক ইত্যাদি নামে-বেনামে গ্রহণ করতে দ্বিধা করেন না।
করোনাকালে সাইবার জগতকে ব্যবহার করে ঘরে বসেই এসব অপরাধের পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এসব অপরাধের সহযোগী হিসেবে অভিজ্ঞ কম্পিউটার অপারেটরকে নিযুক্ত করে দ্রুত যোগাযোগ করা হচ্ছে। যেমন, একজন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নামধারী ডাক্তারের সহযোগী হিসেবে ধরা পড়েছেন একজন ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়র। সাইবার জগতের অপব্যবহার করে বর্তমানে ব্যাংক ডাকাতি, বড় তথ্য চুরি, ঘুষ-দুর্নীতি ও মারাত্মক যে কোন অপরাধের গোপন পরিকল্পনা করা সহজ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আগে পুরুষরা এসব অপরাধে নেতৃত্ব দিত, এখন মহিলারা দেয়। সুন্দরী মহিলারা এসবের নেতৃত্ব দিতে বেশি সক্রিয়। অনেক দেশে পেশাদারী মিলিট্যান্টদেরকে এসব কাজে নেতৃত্ব দিতে দেখা যায়। বর্তমানে সাইবার জগতে নারী প্রতারকদের পাখার ঝাপটা প্রবল। তারা অত্যাধুনিক পরিবেশে নিজেদেরকে মানানসই করে ঘুরে বেড়ায়। সাইবার জগতের অভিজ্ঞ হ্যাকাররা এদের ‘থাপইত’ বা সহযোগী। তাই গোপন তথ্য পেয়ে সে অনুযায়ী নড়াচড়া করতে এদের কোন ঝামেলা হয় না।
নারী ঠগবাজ ও প্রতারকদের রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন খুব শক্তিশালী। এদের নেটওয়ার্ক শক্তিশালী ও অত্যাধুনিক হওয়ায় মান্ধাতার আমলের আইনী সংস্থাগুলো এদের কাছে প্রায়শই নাজেহাল হয়ে পড়ে। এসব নারী ঠগবাজ ও প্রতারক খুবই স্মার্ট, শিক্ষিত, নিজ পেশায় প্রশিক্ষিত, ধুরন্ধর ও বেপরোয়া প্রকৃতির। করোনাকালে এধরনের কিছু ডাক্তার, ব্যবসায়ী, ঠিকাদার, রাজনৈতিক নেতা, গ্যাংলিডারের অপতৎপরতা জাতিকে বেশ বিপদে ফেলে দিয়েছে। তারা যোগসাজশ করে মানবতা বিনাশী তস্করের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে নানা অপকর্ম শুরু করেছে। পাঠক হয়তো এগুলো গণমাধ্যমে জেনে ফেলেছেন। তাই সবার নাম ও অপতৎপরতা নিয়ে লিখতে চাচ্ছি না।
করোনার দ্বিতীয় বছরে ডেল্টা ভেরিয়েন্টের মরণ কামড়ের সময় শুধু একজন চিকিৎসকের কথা কিছুটা উল্লেখ করতে হচ্ছে । তিনি একজন ডাক্তার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল। কখনও সামরিক বাহিনীতে চাকুরি করেননি। অথচ, পদবীটা সামরিক কায়দায় প্রচার করতেন। তার দুটি সামরিক র্যাংক ও ব্যাজ লাগানো ড্রেস আছে। তিনি দামী ভূয়া পদবীধারী পদের প্রতারক। আইন-শৃংখলা বাহিনী সেগুলো তার বাসা রেইড করে উদ্ধার করে গণমাধ্যমে প্রকাশ করেছেন। তার একজন সহযোগী আছে। তিনি পেশায় ডিপ্লোমা প্রকৌশলী বলে জানা গেছে।
ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নাম ভাঙ্গিয়ে সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে কতশত প্রতারকরা পাখা গজিয়ে উড়ে বেড়াচ্ছে তার কী কোন সঠিক পরিসংখ্যান আছে। একজন চিকিৎসকের মনের মধ্যে এমন ন্যক্কারজনক কাজের ইচ্ছে কেন হলো? আসলে আমাদের জাতীয় রাজনীতির দুর্বলতা, সাইনর্বোড লাগিয়ে অপরের সম্পত্তি দখলের কৃষ্টি এবং মানুষের মতের স্বাধীনতাকে দাবিয়ে রেখে যে মানসিক দূরত্ব তৈরী করা হয়েছে তার ফলে একজন এমবিবিএস চিকিৎসকের মনেও ধারণা জন্মেছে যে বিশেষ সাইনবোর্ড লাগাতে না পারলে আমার উন্নতি হবে না।
এই হীন অবস্থা থেকে শুরু হয়েছে তোষণ-বিভাজন ও পরস্পরের প্রতি অবিশ্বাস। তাই নিজ কাজের সময় দায়িত্বে অবহেলা করে বস্ তোয়াজে তৎপর সকল কর্মজীবী মানুষ। বিশেষ করে সরকারী উচ্চপদে আসীনরা সবসময় আতঙ্কে সময় পার করেন। নিজে নিজে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সব ক্ষমতা হরিত হওয়ায় তারা উপরের পানে চেয়ে চেয়ে অফিসে কর্মঘন্টা শেষ করে, রাস্তার জ্যামে গাড়ির তেল ফুরিয়ে বাসায় ফেরেন। গঠনমূলক কিছু করার সুযোগহীনতায় সুন্দরী নারীরা তাদের কাছে আনাগোনা করে তদ্বির করে তাদের ক্লায়েন্টদের প্রমোশন, বদলি করিয়ে দেবার আশ্বাস দিয়ে।
তাদেরই একজন আজকের ডাক্তার ঈশিতা যার ২০টি পদবী। যিনি ২০টি পদের অধিকারী সেজে শিক্ষিত বেকার, আমলা, ব্যবসায়ী তথা সবাইকে ব্দ্ধৃাঙ্গুল দেখেয়ে প্রতারণার ডালি সাজিয়ে অফিসপাড়া ঘুরে বেড়ান ও জালিয়াতি করেন। দেশের সাইবার জগতে উপযুক্ত ফায়ারওয়াল না থাকায় কে রাখে কার খবর? এত সুন্দর অবয়বে, দামী ব্যাজে, ডিগ্রিতে, জৌলুষে নিজেকে রাঙিয়ে আরো যে কত ঈশিতা আমাদের সমাজে প্রতারণার পসরা সাজিয়ে বদলি, প্রমোশন ও দুর্নীতির বিকিকিনি করে বেড়াচ্ছে প্রতিদিন, তার কি কোন হদিস দিতে পারবেন কেউ?
কারণ ওদের পাখার ঝাঁপটা কল্পিত পরীর ডানার ঝাঁপটার চেয়ে শক্ত। যে ডানা এত বড়, এত শক্ত যে আমাদের নৈতিকতার ভিতকে ভেঙে দিয়ে দেশের সার্বিক উন্নয়নের প্রদীপ এক ঝাঁপটায় নিভিয়ে দিতে পারঙ্গম বলে আশঙ্কা জাগে। সেজন্য ডিজিটাল পদ্ধতির বিকাশের সাথে সাথে সুন্দরী সেলিব্রেটিদের আড়ালে ডিজিটাল অপরাধ সম্রাজ্ঞীদের চিহ্নিত করতে হবে। তাদের মাধ্যমে হীন রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় অবৈধ মাদক, জুয়া, শিশু ও নারী পাচার, দেহ ব্যবসা ও চাকুরির তদ্বির ব্যবসা গুঁড়িয়ে দিয়ে সর্বস্তরে সর্বসাধারণের ন্যায্য হক প্রতিষ্ঠায় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে হবে।
লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডীন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান। fakrul@ru.ac.bd
এইচআর/এমএস