বিশেষ প্রতিবেদন

৪৪ বছরেও মেলেনি বীরাঙ্গনা জাহানারার স্বীকৃতি

জয়পুরহাটের এক অসহায় বীরাঙ্গনা জাহানারা বেগম। স্বাধীনতার ৪৪ বছরেও মেলেনি সরকারি স্বীকৃতি। মহান মুক্তিযুদ্ধের একজন বীরাঙ্গনা হিসেবে জনে জনে চিনলেও আজও পায়নি বীরাঙ্গনার খেতাব। ১৯৭১ সালে ষোড়শী জাহানারা খাতুনের স্বামী-সংসার সবই ছিল। কিন্ত মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা আর অপরূপ সৌন্দর্যই ছিল তার বড় অপরাধ। হানাদাররা ক্যাম্পে ধরে নিয়ে এই বীরাঙ্গনার সতীত্বহরণসহ দিনের পর দিন তার উপর চালিয়েছে পাশবিক নির্যাতন। স্বাধীনতা পরবর্তীতে স্বামী পরিত্যক্ত ও নিঃসন্তান এই বৃদ্ধার জীবন চলছে এখন অন্যের দয়া-দক্ষিণায়।সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, জয়পুরহাট জেলা শহরের পশিচম প্রান্তে অবস্থিত খঞ্জনপুর এলাকা। এখান থেকে ঐতিহাসিক পাহাড়পুর যাওয়ার পথে মাত্র ৫০/৬০ গজ দক্ষিণ দিকে পূর্ব খঞ্জনপুর গ্রাম। স্থানীয়রা এই এলাকাকে পূবাপাড়াও বলে থাকেন। জাহানারা বেগমের প্রতিবেশী মুক্তিযোদ্ধা মাহফুজুল হক ও আবু মুসা জানান, ১৯৭১ সালে মৃত কফিল উদ্দিন ও মরিয়ম বেগমের বড় মেয়ে জাহানারা বেগমের বয়স তখন ১৬ থেকে বড় জোর ১৭ বছর। অপরূপা জাহানারার তখন বিয়ে হয় মজনু মিয়া নামে এক যুবকের সঙ্গে। রূপ আর গুণের কারণে বাবার বাড়ি থেকে স্বামীর বাড়ি সবখানেই তিনি ছিলেন অনেক সুখে। কিন্তু তার এই সুখ বেশি দিন সইলো না।১৯৭১ সালে তাকে ধরে নিয়ে গিয়ে পাক হানাদাররা দীর্ঘ দিন ক্যাম্পে আটকে রেখে তার উপর চালায় পাশবিক নির্যাতন। যুদ্ধের শেষ দিকে মুক্তিযোদ্ধারা পাক-হানদোরদের উৎখাত করে এই বীরাঙ্গনারকে উদ্ধার করলেও তিনি স্বামী পরিত্যক্ত হন। শিকার হন নানা সামজিক প্রতিকূলতার। এই অবস্থায় স্বামী-সংসার আর সামজিক বঞ্চনার শিকার দিশেহারা জাহানারা এক সময় হারিয়ে ফেলেন মানসিক ভারসাম্য। ক্ষুধা পেলে কারো বাড়ি বা কোনো হোটেল-রেস্তোঁরার দরজায় দাঁড়িয়ে যান। কম বেশি যারা তাকে চেনেন তারা খালি হাতে ফেরান না। কখনো হাসি, কখনো কান্না আবার কখনোবা গান এভাবেই উদ্দেশ্যহীন এক জাহানারার জীবন চলছে ১৯৭১ এরপর থেকে। দাদা-দাদী, মা-বাবাসহ প্রত্যক্ষদর্শীদের উদ্ধৃতি দিয়ে জাহানারার প্রতিবেশী রেহেনা আখতার জলি, জয়পুরহাট শহরের গাড়িয়াকান্ত এলাকার অনিতা রানী, লাভলী আক্তারসহ জেলা শহরের অনেক গৃহবধূ জানান, হানাদারদের হাতে সম্ভ্রম হারানো জাহানারা স্বাধীনতার পর পরই স্বামীর কাছে ফিরে যান। কিন্তু তার স্বামী মজনু মিয়া তাকে স্ত্রীর মর্যাদা দেননি। জাহানারা বার বার স্বামীর কাছে কাকুতি-মিনতি করলে লোক লজ্জার ভয়ে তার স্বামী এলাকা ছেড়ে সেই যে পালিয়ে যান আজও ফেরেননি। সেই থেকে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন জাহানারা বেগম। খঞ্জনপুর এলাকার ইউনুস আলী ও হামিদুল ইসলামসহ এলাকাবাসী বলেন, এই বীরাঙ্গনার বাস করার মতো কোনো ঘর নেই। অসুখ-বিসুখ হলে খোঁজ নেয়ারও কেউ নেই। এলাকাবাসী সরকারি জায়গায় একটি বেড়ার ঘর করে দিয়েছেন। ১৯৭১ এ সাহসী যোদ্ধা ও মহিয়সী বীরাঙ্গনা জাহানারার সর্বস্ব কেড়ে নিলেও স্বাধীনতার ৪৪ বছরেও তার খোঁজ রাখেনি কেউই।মাথা গোঁজার একটু ঠাঁই তো দূরের কথা এখন দু’ বেলা খাবারও জোটে না বৃদ্ধা জাহানারার। এমন অভিযোগ করে এলাকাবাসীরা তার বীরাঙ্গনার স্বীকৃতিসহ সরকারি সহযোগিতার দাবি জানান। জীবনের শেষ প্রান্তে হলেও এই বীরাঙ্গনাকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতিসহ তার দায়িত্ব গ্রহণ করতে সরকারের প্রতি দাবি জানান  জয়পুরহাটবাসী।মুক্তিযুদ্ধে বীরাঙ্গনা জাহানারার অবদানসহ এলাকাবাসীদের অভিযোগ অকপটে স্বীকার করে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা বলেন, জয়পুরহাট মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষ থেকে জাহানারার বীরাঙ্গনার স্বীকৃতি ও মর্যাদাসহ তার সহায়তার ব্যাপারে বারবার সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলে দাবি জানানো হলেও এ ব্যাপারে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। ৭১’ এ পাক হানাদারদের হাতে সম্ভ্রম হারানোসহ পৈশাচিক নির্যাতন আর স্বাধীনতা পরবর্তীতে একই কারণে স্বামী পরিত্যক্ত হয়ে জীবনের মহামূল্যবান ৪৪টি বছর হারিয়ে গেছে জাহানারার জীবন থেকে। স্বাধীনতার স্বাদ লাভ না করলেও স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতি এখনও এই পাগল জাহানারার মনে আছে অবিচল আস্থা। এখনো জাতীয় সঙ্গীতের মূর্ছনায় আপ্লুত হয়ে পড়েন এই মহান বীরাঙ্গনা। মানসিক ভারসাম্যহীন জাহানারা অগোছালোভাবে প্রায় সবই বলতে পারেন তার সাথে যা যা হয়েছে। যেন তিনি এখনও ’৭১ এর সেই ভয়াবহ সময়গুলো পার করছেন। এসবের মধ্যেও তিনি ভোলেননি জাতীয় সঙ্গীত, ২/৩ লাইন গাইতেও পারেন।দেশের বীরসেনা মুক্তিযোদ্ধাসহ স্বাধীনতা যুদ্ধে অবদানের জন্য অনেকের কমবেশি ভাগ্যের চাকা ঘুরলেও জয়পুরহাটের বীরাঙ্গনা জাহানারা রয়েছেন আজও উপেক্ষিত। জীবনের পড়ন্ত বেলায় হলেও তার যথাযোগ্য মর্যাদা দেখে যেতে চান স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাসহ জয়পুরহাটের আপামর জনতা।এসএস/এমএস

Advertisement