ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজে নানা ধরনের বাণিজ্যকে কেন্দ্র করে অধ্যক্ষের সঙ্গে গভর্নিং বডির দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে। গত এক বছরে এ প্রতিষ্ঠানে অতিরিক্ত ভর্তি ও শাখা পরিবর্তন করে প্রায় ১৩ কোটি টাকা বাণিজ্য করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এসব অনিয়ম খতিয়ে দেখতে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। আগামী সপ্তাহে এ কমিটির সদস্যরা তদন্তকাজ শুরু করবেন। এর বাইরেও দুটি তদন্ত কমিটি কাজ করছে বলে জানা গেছে।
Advertisement
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০২০ সালে ভিকারুননিসায় প্রথম শ্রেণিতে বেইলি রোড (মূল শাখা), বসুন্ধরা, ধানমন্ডি ও আজিমপুরে নির্ধারিত ১ হাজার ৮২৬ আসনে অতিরিক্ত ৭৭ জন শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়েছে। দ্বিতীয় শ্রেণিতে মোট অনুমোদিত ১০৫টি আসনে ১৫৫ জন, চতুর্থ শ্রেণিতে ৪৩ আসনে ৫৩ জন ভর্তি করা হয়। অতিরিক্ত প্রতিটি ভর্তি বাবদ তিন লাখ বা তার বেশি অর্থ আদায়ের মাধ্যমে অবৈধভাবে এসব ভর্তি করানো হয়েছে।
অন্যদিকে নিয়মবহির্ভূত ৪৪০ জন শিক্ষার্থীর শাখা পরিবর্তন করা হয়েছে। এ জন্য প্রতিটি শিক্ষার্থীর কাছে ২ লাখ বা তার বেশি টাকা নেয়া হয়েছে। গত এক বছরে ভর্তি বাণিজ্য ও ব্র্যাঞ্চ পরিবর্তন করে ১২ কোটি ৯০ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়েছে। এর সঙ্গে কয়েকজন শিক্ষক প্রতিনিধি, অভিভাবক প্রতিনিধির একাধিক সদস্য ও একশ্রেণির অভিভাবক জড়িত। সেসময় অধ্যক্ষ ছিলেন অধ্যাপক ফওজিয়া ও গভর্নিং বডির চেয়ারম্যানের দায়িত্বে ছিলেন ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার মোস্তাফিজুর রহমান।
জানা গেছে, গভর্নিং বডির কয়েকজন অভিভাবক সদস্য, কিছু অভিভাবক সংগঠন, অভিভাবক ফোরাম এবং কয়েকজন শিক্ষক প্রতিনিধি মিলে প্রতিষ্ঠানটিতে একটি সিন্ডিকেট গড়েছেন।
Advertisement
গত ১৩ জুলাই প্রতিষ্ঠানটির জিবি সভাপতি ও ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার খলিলুর রহমান লিখিতভাবে বিস্তারিত শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে অবহিত করেন। এতে মোটা দাগে তিনি চারটি দিক উল্লেখ করেন। এগুলো হলো- জিবির কতিপয় সদস্য শিক্ষকদের সঙ্গে অশোভন আচরণ, ভর্তিসহ কলেজের সব কাজে অযাচিত হস্তক্ষেপ, ভর্তি বাণিজ্য এবং কলেজের উন্নয়ন ও সংস্কারমূলক কাজে আর্থিক অনিয়মের চেষ্টা। এ চিঠি পাওয়ার পাঁচ দিনের মধ্যে তদন্ত কমিটি গঠন করে ঢাকা শিক্ষা বোর্ড। তিন সদস্যের ওই কমিটির একজন হলেন উপ-কলেজ পরিদর্শক মুহাম্মদ রবিউল আলম।
মুহাম্মদ রবিউল আলমের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি জাগো নিউজকে বলেন, লকডাউনের কারণে তারা তদন্তকাজ শুরু করতে পারেননি। লকডাউন বাড়ানো না হলে তারা ৭ বা ৮ আগস্ট সরেজমিনে গিয়ে শিক্ষক-অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে তথ্য সংগ্রহের কাজ শুরু করবেন।
এদিকে সম্প্রতি ভিকারুননিসার অধ্যক্ষ ও একজন অভিভাবকের ফাঁস হওয়া ফোনালাপ খতিয়ে দেখতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি করা হয়। তারা তদন্ত করে প্রতিবেদন দেবেন।
সূত্র জানায়, কমিটি ফোনালাপের সূত্র ধরে ভর্তি বাণিজ্য, বিভিন্ন সংস্কার ও কেনাকাটায় অনিয়মের তথ্য পেয়েছে। কমিটি তদন্তের শুরুতে ২৯ জুলাই অধ্যক্ষ ও অভিভাবক মীর সাহাবুদ্দিন টিপুকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। কমিটির কাছে কথোপকথনের রেকর্ড মীর সাহাবুদ্দীন হস্তান্তর করেন বলে জানা গেছে। শুরু থেকে অধ্যক্ষ বলে আসছেন, কথোপকথনে তার অংশ ‘সুপার এডিট’ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
Advertisement
এদিকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদফতর (ডিআইএ) সহকারী প্রকৌশলী কামরুল ইসলামের নেতৃত্বে আরেকটি কমিটি কাজ করছে। এ কমিটি প্রতিষ্ঠানটির বিভিন্ন নির্মাণ ও মেরামত কাজের তদন্ত করে প্রতিবেদন জমা দেয়া হয়েছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে ডিআইএর দাখিল করা তদন্ত প্রতিবেদনে দেখা যায়, লাখ লাখ টাকার অনিয়ম, দুর্নীতি ও লুটপাটের চিত্র।
এতে বলা হয়, আসবাবপত্র কেনার নামে ৩ লাখ ৬৬ হাজার টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। খেলাধুলার সরঞ্জাম কেনাকাটায় ২ লাখ ৫৬ হাজার টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। আসবাবপত্র কেনার নামে আরেক বরাদ্দে ১২ লাখ ৫৮ হাজার টাকার অনিয়ম হয়েছে। স্টক হিসাব না থাকায় ওই আসবাবপত্র বাস্তবে কেনা হয়েছে কিনা তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। বসুন্ধরা শাখার জন্য কেনা ১১ লাখ ১৬ হাজার টাকার আসবাবপত্রের হদিস পাওয়া যায়নি।
এছাড়া টেন্ডার ছাড়া ১ কোটি ৭১ লাখ ৭২৭ টাকার অস্পষ্ট ব্যয়, বসুন্ধরা শাখার একটি ভবনের দুটি ফ্লোর নির্মাণে ১ কোটি ৫৯ লাখ ১১ হাজার ৩৬৯ টাকা ব্যয়ে অনিয়ম, খেলাধুলার সরঞ্জাম কেনায় ৩২ হাজার ৯০০ টাকা অপ্রয়োজনীয় ব্যয়, বিভিন্ন কাজে সরকারকে ১ কোটি ৪০ লাখ টাকা ও ৪৫ লাখ ২৮ হাজার টাকা ভ্যাট এবং বিভিন্ন সম্মানীর ক্ষেত্রে ২ কোটি ১৯ লাখ টাকা উৎসে কর বঞ্চিত করা হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বর্তমান অধ্যক্ষ কামরুন নাহার জাগো নিউজকে বলেন, ‘ভর্তি বাণিজ্য বন্ধ করায় আমার বিরুদ্ধে নানা ধরনের ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। বর্তমান গভর্নিং বডির (জিবি) ৬ষ্ঠ সভায় প্রতি সদস্যকে ১০টি করে ভর্তি দিতে রেজুলেশন তৈরি করা হয়। বর্তমান সভাপতি ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার খলিলুর রহমানের সহায়তায় তা বাতিল করি। এতে জিবি সদস্যরা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছেন।’
তিনি জানান, এখানে অনেক সন্দেহজনক ব্যয় দেখে অবশিষ্ট বিল ছাড় করেননি। এ কারণে তাকে সংশ্লিষ্ট অভিভাবক সদস্য অপমান-অপদস্থ করেছেন। দু’দফায় তার রুমে তালাও দিয়েছেন। কাজের বিষয়টি তদন্তে তিনি ইইডিতে চিঠি দিয়েছেন। সব অভিযোগ তদন্তাধীন থাকায় এর বেশিকিছু বলতে রাজি হননি তিনি।
এমএইচএম/এসএইচএস/এএসএম