ড. সেলিম মাহমুদ
Advertisement
বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সন্তান, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ পুত্র জাতীয় বীর শহীদ ক্যাপ্টেন শেখ কামাল। শৈশবে তাকে নিয়ে কত যে মিথ্যাচার আর বিকৃত ইতিহাস শুনেছি। তারপর স্কুলজীবন থেকে তাকে জানতে শুরু করলাম। ঢাকা কলেজে এসে অনেক কিছু জানলাম এই ট্র্যাজেডি নায়ক সম্পর্কে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে শিক্ষক আর সহকর্মীদের কাছ থেকে তার গল্প শুনতে শুনতে আরও গভীরভাবে আবিষ্কার করলাম এই মেধাবী, সাহসী, দেশপ্রেমিক, স্পষ্টবাদী সংগঠককে। যিনি ছিলেন একাধারে ক্রীড়াবিদ ও ক্রীড়া সংগঠক, নাট্যকর্মী ও নাট্য সংগঠক, শিল্পকলার সব ক্ষেত্রে যার সুনিপুণ পারদর্শিতা ছিল, ছিলেন ছাত্র সংগঠক ও ছাত্রনেতা, ছিলেন সাহসী মুক্তিযোদ্ধা। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে যিনি তরুণ ও যুব সমাজকে সৃজনশীল রাজনীতি, সাংগঠনিক কার্যক্রম আর ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে ব্যাপকভাবে আকৃষ্ট করেছিলেন; ছিলেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একজন কমিশনড অফিসার। জন্মের মাসেই ঘাতকের বুলেটে নিহত হয়েছিলেন এই বীর সেনানায়ক।
শহীদ শেখ কামাল ছিলেন পঁচাত্তর-পরবর্তী আওয়ামী লীগবিরোধী অপপ্রচার আর ইতিহাস বিকৃতির সবচেয়ে বড় ভিকটিম। এই দেশপ্রেমিক মেধাবী বীরকে নিয়ে বঙ্গবন্ধু হত্যাকারী ও তাদের সুবিধাভোগীরা কতো রকম অপপ্রচারই না করেছে। এ অপপ্রচারগুলো তারা সুপরিকল্পিতভাবে চালিয়েছিল কখনো কখনো তাদের অবৈধ শাসন আর বাংলাদেশের আদর্শবিরোধী পরিচয়কে আড়াল করার জন্য, আবার কখনো কখনো বাংলাদেশবিরোধী ওই পরিচয়কেই বাংলাদেশের মূল চালিকাশক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য। এই অপপ্রচারের আরেকটি কারণ ছিল শহীদ শেখ কামালের মেধাবী নেতৃত্বের বহুমাত্রিকতা, যা তাকে ইতিহাসে একটা উচ্চতর স্থানে নিয়ে যাবে- খুনি চক্র ও তাদের সুবিধাভোগীদের এ রকম একটি ভয়। তাদের ভয় ছিল এ দেশের তরুণ প্রজন্ম এরকম একজন বহুমাত্রিক গুণাবলিসম্পন্ন দেশপ্রেমিক চৌকস তরুণ নেতার অস্তিত্ব ইতিহাসে খুঁজে পেলে তারা আওয়ামী লীগ তথা মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের প্রতি ঝুঁকে যেতে পারে। তাই তারা অপপ্রচার চালিয়েছিল l
এই খুনি চক্র ও তাদের সুবিধাভোগীরা নেতৃত্ব আর ইতিহাসকে অনেক ভয় পায়। সেই ভয় থেকেই তারা প্রথমে জাতির পিতাকে হত্যার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কারণ তিনি বেঁচে থাকলে বাংলাদেশ তার মূল আদর্শ নিয়ে এগিয়ে যাবে। এ দেশকে অন্য কোনো দিকে ধাবিত করা যাবে না। এই চক্রটি বুঝতে পেরেছিল, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের মধ্য দিয়ে একদিকে যেমন একটি জাতি জন্মলাভ করেছিল, অন্যদিকে তারই নেতৃত্বে এই জনপদে স্বাধীন বাংলাদেশের আদর্শ ধারণকারী একটি শক্তির উন্মেষ ঘটেছিল। ওই আদর্শবাদী শক্তি তথা বাংলাদেশকে নেতৃত্বশূন্য করার লক্ষ্যেই সেদিন ওই পিশাচরা জাতির পিতাকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। তাদের পরিকল্পনায় পিতাকে হত্যার পরই তাদের স্বস্তির কারণ ছিল না। তাই বঙ্গমাতাসহ শেখ কামাল, শেখ জামাল ও শিশু রাসেলসহ দেশে অবস্থানরত বঙ্গবন্ধু পরিবারের সবাইকে হত্যা করল। খুনিরা জানতো, বঙ্গবন্ধু পরিবারের প্রতিটি সদস্যের এ জাতিকে নেতৃত্ব দেওয়ার যোগ্যতা রয়েছে। বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে পরিবারের কেউ যাতে নেতৃত্ব নিতে না পারে, সেই লক্ষ্যেই দেশে অবস্থানরত পরিবারের সবাইকে তারা হত্যা করেছিল। আল্লাহর অশেষ রহমতে বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনা ও কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহানা ওই সময়ে বিদেশে ছিলেন। তাই খুনি চক্র তাদের হত্যা করতে পারেনি।
Advertisement
বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ পুত্র শেখ কামালের অসাধারণ নেতৃত্বের ক্ষমতা ও বহুমুখী গুণাবলির কারণে তার মৃত্যুর পরও খুনি চক্র তাকে নিয়ে বেশ চিন্তিত ছিল। সে কারণেই এ চক্র ও তাদের সুবিধাভোগীরা বহু বছর এ প্রতিভাবান নেতার বিরুদ্ধে অপপ্রচার ও মিথ্যাচার করেছিল। তারা চরম মিথ্যাচার করল যে, শেখ কামাল নাকি তার বন্ধুদের নিয়ে ব্যাংক ডাকাতি করেছিল। এই জঘন্য মিথ্যাচার তারা ১৫ আগস্টের পর থেকে করে আসছিল। এটি তাদের একটি পরিকল্পিত মিথ্যাচার ছিল। ব্যাংক ডাকাতি করে থাকলে ওই টাকা সুইস ব্যাংকে থাকার কথা। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর বঙ্গবন্ধু পরিবারের কোন সদস্যের কোন ব্যাংক অ্যাকাউন্ট দেশে-বিদেশে খুঁজে পাওয়া যায়নি। তারা যে সকল মিথ্যাচার করেছিল, তার প্রত্যেকটিই মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু হত্যার পর থেকে এই গোষ্ঠীটিই সেনাবাহিনীকে নিয়ে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে নানা অপপ্রচার চালিয়েছিল। তারা অপপ্রচার চালিয়েছিল, আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধু পরিবার সেনাবাহিনীবিরোধী– সেনাবাহিনীর সাথে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই। অশুভ শক্তির এ অপপ্রচার বহুদিন চলেছে। অথচ মানুষ ধীরে ধীরে জানতে পেরেছে, এই সেনাবাহিনী বঙ্গবন্ধুর হাতে তৈরি বাহিনী। তারা জানতে পেরেছে, বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ দুই পুত্র সেনাবাহিনীর কমিশনপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ছিলেন আর শিশু পুত্র রাসেল দুই ভাইকে অনুসরণ করে সৈনিক হতে চেয়েছিল। শিশু রাসেলের সেই স্বপ্নের কথা জাতির পিতা খুশি মনেই সাংবাদিকদের বলেছেন।
শহীদ শেখ কামাল জাতির পিতা এবং রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানের সন্তান হলেও সব সময়ই ক্ষমতার বলয়ের বাইরে থাকতে পছন্দ করতেন। তিনি খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক কাজকর্মে যুক্ত থাকতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন। ক্ষমতার প্রতি তার কোনো মোহই ছিল না। সেনাবাহিনীর লোভনীয় পদ ছেড়ে তিনি রাজনীতিতে থাকতে চেয়েছিলেন। আবার রাজনীতিতে ফিরে এসেও কোনো পদ গ্রহণ না করে একজন কর্মী ও সংগঠক হিসেবেই সেখানে মনোনিবেশ করেছিলেন। তিনি কোনো গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকতে চাইতেন না। তার মতো চৌকস ও অসাধারণ প্রতিভাবান তরুণ নেতৃত্ব সমসাময়িক সময়ে বিশ্বের কোনো রাজনৈতিক পরিবারে ছিল না। সত্তরের দশকের শুরুতে যখন সারা বিশ্বেই তরুণ প্রজন্ম ড্রাগ আর মাদকের দিকে ঝুঁকছিল, তখন শেখ কামাল তারুণ্য ও যুব সমাজকে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, খেলাধুলা আর রাজনৈতিক কার্যক্রমে যুক্ত করার মাধ্যমে তাদের দেশ গড়ার পথে নিয়ে গিয়েছিলেন। রাষ্ট্র ও সমাজের এমন কোনো জনকল্যাণমুলক কাজ নেই, যেখানে শহীদ শেখ কামালের হাতের ছোঁয়া ছিল না।
বঙ্গবন্ধু পরিবারের সবার নৈতিক অবস্থান এবং ক্ষমতার প্রতি মোহমুক্ত মনোভাব, এই পরিবারকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। ফলে বঙ্গবন্ধু পরিবারের তৃতীয় প্রজন্মে এসেও পরিবারটি আজও উজ্জ্বল। বিশ্ব রাজনীতিতে ক্ষমতাধর ও ঐতিহাসিক রাজনৈতিক পরিবারগুলো ধীরে ধীরে ক্ষয়িষ্ণু হচ্ছে। এর মূল কারণ তাদের উত্তরাধিকারীরা যোগ্যতার প্রশ্নে পূর্বসূরিদের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারেনি। উপমহাদেশের গান্ধী পরিবার, ভুট্টো পরিবার অনেকটা ম্লান হয়ে যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর পরিবার দিন দিন আরও উজ্জ্বল হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা আজ পৃথিবীর অন্যতম ক্ষমতাধর ও সফল রাষ্ট্রনায়ক। বঙ্গবন্ধুর তৃতীয় প্রজন্ম আজ শুধু বাংলাদেশেই অবদান রাখছেন না, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের নাম উজ্জ্বল করছেন। দৌহিত্র সজীব ওয়াজেদ জয় ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা, দৌহিত্রী সায়মা ওয়াজেদ পুতুল আজ বিশ্বে অটিজম বিষয়ে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। আরেক দৌহিত্রী টিউলিপ সিদ্দীক তরুণ বয়সেই দুবার ব্রিটিশ এমপি নির্বাচিত। আরেক দৌহিত্র রাদওয়ান সিদ্দিকী ববি বাংলাদেশের উন্নয়নে নীরবে কাজ করে যাচ্ছেন। সাধারণত বিশ্বের ক্ষমতাধর ও কিংবদন্তি রাজনীতিবিদদের পরিবারে তাদের পরবর্তী প্রজন্মগুলোতে ক্ষমতার প্রকাশটা বেশি থাকে। বঙ্গবন্ধু পরিবারের ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম। এই পরিবারের নতুন প্রজন্ম ক্ষমতা ধারণ ও প্রকাশের পরিবর্তে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিভিত্তিক কর্ম কৌশল দিয়ে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতেই আগ্রহী।
Advertisement
আজ শহীদ শেখ কামাল বেঁচে থাকলে বাংলাদেশের ইতিহাস অন্য রকমের হতে পারতো। বড় বোন রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনাকে তিনি রাষ্ট্র পরিচালনায় সহায়তা করতে পারতেন। তিনি বেঁচে থাকলে ক্রীড়া আর সংস্কৃতিতে বাংলাদেশ অনেক আগেই অনন্য উচ্চতায় চলে যেত। রাজনীতিতে সৃজনশীলতার প্রবক্তা শেখ কামাল বেঁচে থাকলে রাজনীতি এতো দিনে আরও বেশি সৃজনশীল ও মেধাভিত্তিক হতো। স্বাধীনতার পর অর্থাৎ সত্তরের দশকের শুরুর দিকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে, বিশেষভাবে, রাজনীতিতে তরুণ ও যুব সমাজের ইতিবাচক অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে এ অসাধারণ মেধাবী সংগঠক বিশেষ ভূমিকা পালন করেন।
শহীদ শেখ কামালকে নিয়ে জাতীয়ভাবে অনেক বেশি গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। তার বহুমাত্রিক প্রতিভা, নানামুখী জনকল্যাণমূলক কার্যক্রম এবং তার রাষ্ট্র ও সমাজ দর্শন নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে একাধিক ডিসিপ্লিনে গবেষণা কর্ম হতে পারে। এই কাজটি শুরুর আজ সময় এসেছে। ঘাতক চক্র ও তাদের সুবিধাভোগীরা শেখ কামালকে হত্যার পরও জঘন্য অপপ্রচার চালিয়েছিল তার বহুমাত্রিক ব্যক্তিত্ব ও কিংবদন্তিসম নেতৃত্বকে ইতিহাস থেকে আড়াল করার জন্য। ইতিহাসে প্রতিটি মানুষের একটি সত্তা থাকে। মানুষটি জাগতিকভাবে মৃত হলেও ইতিহাসে সেই সত্তা সবসময় জীবিত থাকে। শহীদ শেখ কামালের সেই জাগ্রত সত্তাকে আড়াল করার জন্যই তারা এতো বছর এ মিথ্যাচার ও অপপ্রচার করেছিল। এই মহান তরুণ নেতাকে নিয়ে ব্যাপকভিত্তিক গবেষণার মাধ্যমে তার সঠিক চিত্র নতুন প্রজন্মের কাছে উপস্থাপনের সময় এসেছে। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে এ গবেষণা কর্ম হতে পারে। এ লক্ষ্যে একাধিক গবেষণা কেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।
এই কিংবদন্তিতুল্য নেতার আজ জন্মদিন। শুভ জন্মদিন ক্যাপ্টেন শেখ কামাল। আমরা আপনাকে অনেক অনেক ভালোবাসি। আপনি আমাদের কাছে স্বপ্নের নায়কের মতো। আপনি বাঙালির হৃদয়ে চিরদিন বেঁচে থাকবেন।
লেখক : তথ্য ও গবেষণা বিষয়ক সম্পাদক, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।
এইচআর/এএসএম/ফারুক