আজকের আলোচিত চলচ্চিত্র নায়িকা পরীমনি। তার জীবনটাই চলচ্চিত্রের এক সুপারহিট গল্প। অসহায়ত্ব, রহস্য, রোমাঞ্চ, মানবিকতা, রোমান্টিকতা, উত্থান ও পতনের চিত্রনাট্যে দুর্দান্ত এক চরিত্র যেন তিনি। তার জীবনী নিয়ে খন্ড খন্ড অনেক সংবাদ, সাক্ষাৎকার ও ফিচার পাওয়া যায়। সেসব ঘেঁটে তাই মনে হবে যে কারো।
Advertisement
পরীর জন্ম নড়াইল জেলায় কালিয়া উপজেলার বাকা গ্রামে। ১৯৯২ সালে। নাম রাখা হলো তার শামসুন্নাহার স্মৃতি। খুব ছোটবেলায় মা সালমা সুলতানা এবং পরে বাবা মনিরুল ইসলামকে হারান।
জানা যায়, মাত্র তিন বছর, তখন তার মায়ের মৃত্যু হয়। আগুনে দগ্ধ হয়ে মারা গিয়েছিলেন তিনি। সে সময় মা হারা পরীকে বাবা মনিরুল ইসলাম রেখে আসেন তার নানাবাড়ি পিরোজপুরে।
মা হারা নাতনিকে বড় করার দায়িত্ব নেন নানা শামসুল হক গাজী।
Advertisement
তখন থেকে তিনি পিরোজপুরের ভান্ডারিয়া বাসিন্দা। সেখানেই বেড়ে উঠেছেন। নানা বাড়িতে আদরের অভাব হয়নি। স্থানীয় স্কুল কলেজ থেকে মাধ্যমিক শেষ করেন।
পড়াশোনা চলাকালীনই বিয়ে হয়ে যায় পরীর। এক কাজিনের সঙ্গে প্রেমের বিয়ে। গ্রামে বেড়ে উঠলেও পরীর ছিলো জনপ্রিয়তার আকাশ ছোঁয়া স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন নিয়ে ২০১১ সালে তিনি চলে আসেন ঢাকায়। নাচ শিখতে শুরু করেন বুলবুল ললিতকলা একাডেমিতে (বাফা)।
ঢাকায় এসে শুরুতে পরীমনি তার বাবাকে নিয়ে সাভারের ব্যাংক টাউনে বাসা ভাড়া করে থাকতেন। কিন্তু ২০১২ সালে ঘটে দুর্ঘটনা। ওই বছরের ২১ জানুয়ারি সিলেটে তার বাবার গুলিবিদ্ধ লাশ পাওয়া যায়। কেন খুন হয়েছিলেন পরীমনির বাবা মনিরুল ইসলাম আজও সেই রহস্য আজও উদঘাটিত হয়নি।
বাবাকে হারানোর পর সাভারে এক খালার বাসায় থেকে শোবিজে কাজ করার চেষ্টা করতে থাকেন পরী। এরমাঝে আবার গ্রামে যান। ২০১২ সালের ২৮ এপ্রিল বিয়ে করেন প্রেমিক ফেরদৌস কবির সৌরভকে। স্বামীর সঙ্গে আবার আসেন ঢাকায়। একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হন। আর পাশাপাশি চলতে থাকে মিডিয়ায় কাজের সন্ধান।
Advertisement
অবশেষে সুযোগ আসে ২০১৪ সালে। একটি নাটকে অভিনয়ের ডাক পান, যেটি সে সময় এসএ টিভিতে প্রচার হয়। সেখান থেকে সুন্দর মুখশ্রী আর আকর্ষণীয় ফিগারের তরুণী নজর কাড়েন সিনেমার মানুষদের৷ তবে প্রথম তাকে সিনেমায় চুক্তিবদ্ধ করা শাহ আলম মন্ডল। জায়েদ খান ও আনিসুর রহমান মিলনদের সঙ্গে 'ভালোবাসা সীমাহীন' সিনেমা দিয়ে বড় পর্দায় অভিষিক্ত হন পরী। ২০১৫ সালে মুক্তি পায় সিনেমাটি।
এরপরের গল্পটা সবার জানা৷ অভিনয়ে আনাড়ি হলেও সৌন্দর্য পরীকে এগিয়ে দেয় বাঁধ ভাঙ্গা জলের মতো। প্রথম সিনেমা মুক্তির আগেই এক এক করে প্রায় ২৩টি সিনেমায় চুক্তিবদ্ধ হয়ে নবাগতা পরী তাক লাগিয়ে দেন। ক্রমে ক্রমে নিজেকে আভিজাত্য আর জৌলুসময় জীবনে রঙিন করে তুলেন। প্রায় ৩০টির মতো সিনেমা করে একটিতেও উল্লেখযোগ্য সাফল্য না পাওয়া পরীর রহস্যময় বিলাসবহুল জীবনযাপন নিয়ে কানাঘুষা চলতে থাকে।
এর মাঝে ব্যক্তিজীবনেও পরীমনি হয়ে উঠলেন রোমাঞ্চকর, রোমান্টিক। প্রথম স্বামীকে তালাক না দিয়েই একাধিক প্রেম ও বিয়েতে জড়িয়ে আলোচনার জন্ম দিয়েছেন। একাধিক সাংবাদিকদের সঙ্গে তর্ক-বিতর্ক, দুই সাংবাদিকের নামে ১০ লাখ টাকার মানহানি মামলার আলোচিত ঘটনারও জন্ম দিয়েছেন৷ অনেক কাছের পরিচালকের সঙ্গে দূরত্ব বাড়িয়েছেন আবার অনেককে কাছে টেনেছেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একনিষ্ঠ অনুরাগী হিসেবে নিজেকে দাবি করতেন এ নায়িকা। নির্মলেন্দু গুণসহ অনেক সাহিত্যিকের সঙ্গে তার ভালো সম্পর্ক ছিলো৷
সিনেমায় ব্যবসায়িক সাফল্য না পেলেও গিয়াসউদ্দিন সেলিমের 'স্বপ্নজাল' সিনেমায় তিনি অভিনয়ের মুগ্ধতা ছড়িয়েছেন। এ সিনেমা দিয়ে তিনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রত্যাশীও ছিলেন। সর্বশেষ চুক্তিবদ্ধ হওয়া 'প্রীতিলতা' সিনেমাটিও তার ক্যারিয়ারকে সমৃদ্ধ করতে পারতো বলে অনেকের ধারণা।
এছাড়াও তিনি ছিলেন সর্বোচ্চ পারিশ্রমিক পাওয়া নায়িকাদের একজন। প্রচুর বিজ্ঞাপনে কাজ করেছেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় ছিলেন তুমুল জনপ্রিয়। ৯৩ লাখ ফলোয়ার তার ফেসবুকে৷ ফোর্বস ম্যাগাজিনে জায়গা করে নিয়েছিলেন এশিয়ার সেরা প্রভাবশালী তরুণ তারকা হিসেবে।
এত সাফল্যের আড়ালে খাম খেয়ালির জীবন ছিলো তার৷ স্বাধীনচেতাও। এর ভীড়ে পরীমনির মানবিকতা ছিলো যেন অন্ধকারাচ্ছন্ন পথে আলোর ঝলকানি। সবসময় তাকে দেখা গেছে অসহায় চলচ্চিত্র শিল্পীদের পাশে দাঁড়াতে৷ প্রতি বছর কোরবানি ঈদে চলচ্চিত্রের অসহায় শিল্পীদের জন্য গরু কোরবানি দিতেন তিনি। সিনেমায় তার আগমনের প্রতি বছর হিসাব করে বাড়তো গরুর সংখ্যা। সর্বশেষ ঈদে ছয়টি গরু কোরবানি দিয়ে নায়িকা হিসেবে যাত্রার ছয় বছর পূর্ণ হওয়ার জানান দিয়েছেন তিনি।
তবে সব রহস্য, রোমাঞ্চ, রোমান্টিক এ জীবনে কালো অধ্যায় হয়ে এলো গতকাল ৪ আগস্ট। কিছু নির্দিষ্ট অভিযোগ এনে তার বনানীর বাসায় অভিযান চালায় র্যাব৷ সে অভিযানে উদ্ধার হয় বিপুল পরিমাণ মাদক। আটক হন পরীও। তার বিরুদ্ধে একাধিক মামলার প্রস্তুতি চলছে বলে জানা গেছে৷
পরী আবার কবে মুক্ত হবেন, মুক্তির পরের জীবনটা কেমন হবে তার; সেসব নিয়ে জল্পনা কল্পনা চলছে। তবে এ নিয়ে সন্দেহ নেই, পরী দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবেন স্বপ্ন পূরণে সফল হওয়া একজন পরিশ্রমী নারী হিসেবে এবং সেইসঙ্গে লাগামহীন বেখেয়ালি জীবনের খেসারত দেয়া একজন বোকা নায়িকা হিসেবেও৷
এলএ/জেআইএম