ফারাজী আজমল হোসেন
Advertisement
‘হাচু আপা, হাচু আপা, তোমার আব্বাকে আমি একটু আব্বা বলি।’- কথাগুলো শৈশবে বড় বোন শেখ হাসিনাকে বলেছিলেন শহীদ শেখ কামাল। এই দেশ ও জাতির জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের প্রতিটি সদস্যের অসংখ্য ত্যাগের এক নমুনা হয়ে রয়েছে এই উক্তিটি। অধিকাংশ সময় বাবাকে কাছে না পেলেও বাবার আদর্শ ধারণ করে কর্মময় এক জীবন পার করেছেন ক্ষণজন্মা প্রতিভার অধিকারী শহীদ শেখ কামাল। ঘাতকের বুলেট তাকে আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নিলেও কেড়ে নিতে পারেনি তার অর্জন ও সাফল্য। আজও সকলের বুকে বেঁচে আছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিবের জ্যেষ্ঠপুত্র মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক এবং ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব শহীদ শেখ কামাল।
বাংলাদেশের ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে অসামান্য অবদান রাখা শেখ কামালের জন্মদিন ৫ আগস্ট। ১৯৪৯ সালের এই দিনে তদানীন্তন গোপালগঞ্জ মহকুমার টুঙ্গীপাড়া গ্রামে যখন শেখ কামাল জন্মগ্রহণ করেন তখন বাংলার মানুষের মুক্তির আন্দোলনে ব্যস্ত থাকায় তার কাছে আসতে পারেননি বঙ্গবন্ধু। শেখ কামালের শৈশবের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ এর ২০৯ পৃষ্ঠায় লিখেছেন- 'একদিন সকালে আমি ও রেণু বিছানায় বসে গল্প করছিলাম। হাচু (শেখ হাসিনা) ও কামাল নিচে খেলছিল। হাচু মাঝে মাঝে খেলা ফেলে আমার কাছে আসে আর ‘আব্বা’ ‘আব্বা’ বলে ডাকে। কামাল চেয়ে থাকে। একসময় কামাল হাসিনাকে বলছে, ‘হাচু আপা, হাচু আপা, তোমার আব্বাকে আমি একটু আব্বা বলি।’ আমি আর রেণু দু’জনেই শুনলাম। আস্তে আস্তে বিছানা থেকে উঠে গিয়ে ওকে কোলে নিয়ে বললাম, 'আমিতো তোমারও আব্বা।"
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কালরাতে নির্মমগুলিতে বাবা-মা, ভাই-বোন ও স্বজনদের সঙ্গে শহীদ হওয়ার আগে ছোট জীবনে দেশ ও দেশের মানুষের জন্য অনেক অবদান রেখেছিলেন শেখ কামাল। শাহীন স্কুল থেকে মাধ্যমিক ও ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগ থেকে বিএ অনার্স পাশ করেন তিনি। বাংলাদেশের শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি অঙ্গনের শিক্ষার অন্যতম উৎসমুখ ছায়ানটের সেতার বাদন বিভাগের ছাত্রও ছিলেন শেখ কামাল। স্বাধীনতা উত্তর যুদ্ধ-বিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠন ও পুনর্বাসন কর্মসূচির পাশাপাশি সমাজের পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠীর ভাগ্যোন্নয়নে সমাজ চেতনায় উদ্বুদ্ধকরণে মঞ্চ নাটক আন্দোলনের ক্ষেত্রে শেখ কামাল ছিলেন প্রথম সারির সংগঠক।
Advertisement
‘স্পন্দন’ নামে এক শিল্পীগোষ্ঠী গড়ে তুলেছিলেন শেখ কামাল তার বন্ধু শিল্পীদের নিয়ে। নিয়মিত মঞ্চনাটক করতেন তিনি, কলকাতার মঞ্চেও অভিনয় করে প্রশংসিত হয়েছেন। এ ছাড়া তিনি ঢাকা থিয়েটারের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। অভিনেতা হিসেবেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যাঙ্গনে প্রতিষ্ঠিত শেখ কামাল শৈশব থেকে ফুটবল, ক্রিকেট, হকি, বাস্কেটবলসহ বিভিন্ন খেলায় প্রচণ্ড আগ্রহ রাখতেন। তিনি উপমহাদেশের অন্যতম ক্রীড়া সংগঠন ও আধুনিক ফুটবলের প্রবর্তক আবাহনী ক্রীড়াচক্রের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। শহিদ শেখ কামাল আমৃত্যু এই দেশের নান্দনিক ফুটবল ও ক্রিকেটসহ অন্যান্য দেশীয় খেলার মানোন্নয়নে অক্লান্ত শ্রম দিয়ে অপরিসীম অবদান রেখেছিলেন। নতুন নতুন খেলোয়াড় সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রশিক্ষণ শিবির গড়ে তুলতেন এবং তাদের সঙ্গে নিয়মিত অনুশীলন করতেন।
১৯৭৫ সালের ১৪ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ব্লু’ দেশবরেণ্য অ্যাথলেট সুলতানা খুকুর সঙ্গে তার বিয়ে হয়। খ্যাতনামা ক্রীড়াবিদ সুলতানা কামাল সারাদেশে ‘গোল্ডেন গার্ল’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। হাতের মেহেদির রঙ না মুছতেই স্বামীর সঙ্গে তিনিও ১৫ অগাস্টের ভয়াল রাতে শহীদ হন।
ছাত্রলীগের একজন নিবেদিত, সংগ্রামী ও আদর্শবাদী কর্মী হিসেবে ‘৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন শেখ কামাল। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ওয়ার কোর্সে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হয়ে মুক্তিবাহিনীতে কমিশন লাভ করেন ও মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল ওসমানির এডিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন শেখ কামাল।
১৯৭৫-এর পর শেখ কামালকে নিয়ে যত অপপ্রচার সামরিক শাসকদের পদলেহী মিডিয়া ও আওয়ামী লীগ বিরোধী রাজনৈতিক মহল করেছে, তাদের কাছে একবারও প্রশ্ন রাখা হয়নি এদেশের কয়জন রাজনীতিবিদ এমনকি বনেদি পরিবারের সন্তানকে এমন নিবিড়ভাবে সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়া ক্ষেত্রে জড়িত থাকতে দেখেছেন?
Advertisement
বাংলাদেশের জাতির পিতার সন্তান শেখ কামাল কোনও শর্টকাট পথে উপরে যাওয়ার চিন্তা করেননি। মুক্তিযুদ্ধে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হয়ে মুক্তিবাহিনীতে কমিশন লাভ করে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল ওসমানীর এডিসির দায়িত্ব পালন করার পর চাইলে এই পথে তিনি সেনাবাহিনীতে গিয়ে নিশ্চিত জীবন-যাপন করতে পারতেন। কিন্তু স্বাধীনতার পর শেখ কামাল সেনাবাহিনী থেকে অব্যাহতি নিয়ে লেখাপড়ায় মনোনিবেশ করেন। ছাত্র রাজনীতিতেও তিনি বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের একজন সদস্য হিসেবে নেতাদের নেতৃত্বে কাজ করেছেন।
প্রধানমন্ত্রীর ছেলে, ছাত্রও ভালো, ক্লাসে প্রথম সারিতে বসে মন্ত্রমুগ্ধের মতো শিক্ষকের কথা শুনবেন এমনটা ছিলেন না তিনি। বরাবরই তাগিদ ছিল তার ভিন্ন কিছু করার। যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে হতাশা যেন দেশের তরুণদের গ্রাস না করে তা নিশ্চিতে ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রমে মনোযোগ দেন শেখ কামাল। লক্ষ্য ছিল দেশের তরুণদের আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিয়ে যাওয়া। শেখ কামাল গিটার বাজাতেন, সংগীত চর্চা করতেন, নাট্য চর্চা করতেন। তিনি আড্ডা মাতিয়ে রাখতেন। কিন্তু তার দুর্বলতা ছিল যে তিনি বঙ্গবন্ধুর পুত্র। তাই বঙ্গবন্ধুর নামে মিথ্যা ছড়িয়ে তাকে পরিবারসহ হত্যার প্রেক্ষাপট তৈরির জন্য অনেক কিছুই করেছিল পাকিস্তানের দালালেরা। তার সঙ্গে সরাসরি কাজ করা অনেকের সঙ্গে বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হয়েছে আমার। তার কিছু সহপাঠী এখন আওয়ামী লীগ বিরোধী রাজনীতি করেন। তারাও জানান, কখনও শেখ কামালকে ঔদ্ধত্য বা অশালীন কোনও আচরণে লিপ্ত হতে দেখেননি।
বহুমাত্রিক গুণের পাশাপাশি মানুষ হিসেবে শেখ কামাল ছিলেন উদার এবং বিনয়ী। দেশের জাতির পিতা, প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির পুত্র হওয়া সত্যেও তার ভেতরে কোনও অহমিকার প্রকাশ ঘটতে দেখা যায়নি। খুব দ্রুত সময়ে অন্যকে আপন করে নিতে পারার এক অসাধারণ গুণ ছিল তার।
‘আবাহনী ক্রীড়া চক্র’ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দেশে আধুনিক ফুটবলের উন্মেষ ঘটিয়েছিলেন শেখ কামাল। তিনি প্রথম বিদেশি ফুটবল কোচ এনেছিলেন দেশে। ক্রিকেটও খুব প্রিয় ছিল তার, ভাল ফাস্ট বোলিং করতেন। আজাদ স্পোর্টিং ক্লাবের হয়ে শেখ কামাল প্রথম বিভাগের লীগে খেলেছেন সেসময়। তার নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাস্কেটবল দল ছিল অপ্রতিদ্বন্দ্বী। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শাহাদত বরণের সময় তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগে এমএ শেষ পর্বের পরীক্ষা দিয়েছিলেন।
রাজনীতিকে কেবল ক্ষমতা দখলের নিরিখে না দেখে সৎ ও নিরলসভাবে দেখবার চেষ্টা ছিল শেখ কামালের। এবং সেটাই তার কাল হয়েছে। তিনি যদি সত্যি প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতির পুত্র হিসেবে দখলের রাজনীতি করতেন, যদি সংস্কৃতি আর ক্রীড়াঙ্গনের বাইরে থাকতেন, তাহলে এত বদনাম তার হতো না। বঙ্গবন্ধুর পর যাতে কেউ তার যোগ্য, সৎ উত্তরাধিকার হতে না পারেন, সেজন্যই অপপ্রচারের গল্পে ঢেকে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল শেখ কামালের সকল কৃতিত্ব।
শেখ কামাল ছিলেন বাংলাদেশের আধুনিক ক্রীড়া ও সংস্কৃতি আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ। মহান মুক্তিযুদ্ধ, ছাত্ররাজনীতি, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, খেলার মাঠ থেকে নাটকের মঞ্চ- সর্বত্র ছিল তার উজ্জ্বল উপস্থিতি। শেখ কামালের অকালমৃত্যুতে দেশের ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে তো বটেই, রাজনীতিতেও এক অসামান্য ও অপূরণীয় ক্ষতি সাধিত হয়। একজন সৃজনশীল উদ্যমী প্রাণবন্ত তরুণ, যিনি মুক্তিযুদ্ধে অস্ত্র ধরেছেন, সংগীত, নাটক, ক্রীড়া, সামাজিক কাজেকর্মে তরুণদের নেতৃত্ব দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছেন তাকে নতুন করে এখনকার যুব সমাজের কাছে তুলে ধরতে হবে। শেখ কামালকে অনুসরণ করে যেন আলোর পথের দেখা পায় আজকের তরুণ প্রজন্ম।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
এইচআর/জিকেএস