জাতীয়

দালালের খপ্পর থেকে রেহাই পাননি ষাটোর্ধ্ব জাফর আলম

ষাটোর্ধ্ব  মোহাম্মদ জাফর আলম। লাঠিতে ভর দিয়ে চলতে হয়। রোগে শোকে কাতর হয়ে গেছেন। মালয়েশিয়ার ভাষা তো দূরের কথা ঠিকমতো কথাও বলতে পারেন না। কথা বলার চেষ্টা করলে বোঝা যায় তিনি চট্টগ্রামের বাসিন্দা। গত বুধবার (৯ ডিসেম্বর) কুয়ালালামপুর দূতাবাসে ট্রাভেল পাস নিতে এলে লোকটির প্রতি সহানুভুতির হাত বাড়ান দূতাবাসের ফাস্ট সেক্রেটারি (শ্রম) মুশাররাত জেবিন।লোকটি দেখে (শ্রম) মুশাররাত জেবিন বুঝতে পারেন লোকটি কোনো ষড়যন্ত্রের শিকার। সাক্ষাৎকার নিতে গেলে মুশাররাত জেবিনের অনুমান ঠিক হয়। লোকটি মুশাররাত জেবিনের কাছে স্থানীয় চেয়ারম্যান সার্টিফিকেট জমা দেন। সার্টিফিকেটে নাম জাফর আলী, পিতা হোসেন আলী, গ্রাম বারঘোর পাড়া, পো. হায়ানক, থানা মহেশখালি, জেলা ককসবাজার। লোকটির কান্না দেখে মুশাররাত জেবিন জানতে চান- মালয়েশিয়া আসা নৈপথ্যের কাহিনী।জাফর আলমের ভাষ্য অনুযায়ী ছবির কাহিনীকে ও হার মানাবে। সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া আসার কাহিনী বলতে গিয়ে লোকটি এক পর্যায়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। একদিকে না খেয়ে বেঁচে থাকা, অন্যদিকে দালালের অত্যাচার আর বাড়িতে যেতে না পারার বেদনা তাকে তিলে তিলে আরও দুর্বল করে ফেলেছে। কারণ লোকটি ইচ্ছা করলেও বাড়িতে যেতে পারছেন না। কারণ সে অবৈধ, তার কাছে পর্যাপ্ত টাকা ও নেই। থাকলেও দালালেরা নিয়ে যায়। অধীর আগ্রহে মুশাররাত জেবিন মালয়েশিয়া আসার কাহিনী জানতে চান।জাফর আলম বলেন, ২০১৫ সাল ফেব্রুয়ারি মাস। প্রতিদিনের ন্যায় আমি হায়ানক যাই। হায়ানকে শাহাবুদ্দিন নামক এক লোকের সঙ্গে পরিচয় হয়। বাড়িঘর সব জানতে চাইলে আমি সব বলে দেই। আমাকে বিভিন্ন প্রলোভন দেখানোর চেষ্টা করে। আমি কিছুতে রাজি হই না। শাহাবুদ্দিন একদিন আমাকে নদীর পাড়ে নিয়ে যায়। দেখি সেখানে একটি ট্রলার ভেড়ানো। শাহাবুদ্দিন আমাকে বলে ট্রলারে ওঠেন। আমি না উঠতে চাইলে শাহাবুদ্দিন আমাকে মুখে চাপ দিয়ে ট্রলারে উঠিয়ে দেন। আমি চিত্কার করতে চাইলে দূর থেকে আমার চিত্কার এতোটা শোনা যায় না। আর শুনলেও লোকজন কিছু বলে না। এক ঘণ্টা পর ট্রলার ছাড়ে সমুদ্রপথে মালয়েশিয়ার উদ্দেশে। জাফর আলম বলেন, আমি যখন ট্রলারে উঠে ভিতরে ভিতরে গিয়ে দেখি প্রায় ২০০ জন যাত্রী অন্ধকারে চুপচাপ বসে আছে। আমি তো হতভম্ব হয়ে গেলাম। চিত্কার দিলেও সবাই মুখ চেপে ধরে। ট্রলারে যারা ছিলেন ৫০ জনের মতো বাংলাদেশি মনে হলো বাকি সবাই মিয়ানমারের। তার মধ্যে ৩০ জন মিয়ানমারের মেয়ে। সবাইকে সারিবদ্ধভাবে শুইয়ে রাখা হয়েছে। আমিও সবার মতো শুয়ে রইলাম। এইভাবে সমুদ্রে কেটে গেল ১৫ দিন। প্রতিদিন এক মুঠো ভাত পাইনি। কেও ঠিকমতো গোসলও করতে পারে না। গায়ের গন্ধে মনে হয় নদীতে আত্মহত্যা করি। এইভাবে অনেকে অসুস্থ হয়ে গেলো। এক মাস পর আমাদের ট্রলারটি থাইল্যান্ডের জঙ্গলের কাছে গিয়ে থামলো।এ সময় দালালরা আমাদেরকে জঙ্গলের ভেতরে নিয়ে গেলো। থাইল্যান্ড জঙ্গলে আমরা বিক্রি হলাম আরও তিন দালালের কাছে। পরে এক দালাল আমাদের আটকে রেখে মারধর করতে লাগলো; এখন বাড়ি থেকে টাকা আনলে তোমাদেরকে ছাড়বো। টাকা না দিলে তোমাদেরকে মেরে ফেলবো।জাফর আলম নিজে লেখাপড়া ঠিকমতো জানেন না, মোবাইল নম্বর জানবে কীভাবে। দালালরাও পড়ছে এই লোকটিকে নিয়ে বিপদে। পরে থাইল্যান্ডে দালালরা সহযোগিতা নেয় বাংলাদেশের শাহাবুদ্দিন দালালের। শাহাবুদ্দিন জাফর আলমের নম্বর সংগ্রহ করে থাইল্যান্ডের দালালের কাছে দেয়। জাফর আলম বাড়িতে ফোন দেয়। জাফর আলম বাড়ির মোবাইল ফোন দিলে পরিবারের লোকজন কিছু বিশ্বাস করতে পারে না। জাফর আলম কান্নাকাটি করে মালয়েশিয়া আসার কাহিনী বলেন।জাফর আলমের তিন ছেলে, চার মেয়ে। ভিটেমাটি ছাড়া জাফর আলমের কিছু নাই। পরে ভিটেমাটি বিক্রি করে এক লাখ ৬০ হাজার টাকা জাফর আলমের পরিবার শাহাবুদ্দিন হাতে তুলে দিলে থাকে মালয়েশিয়ার বাতু পাহাত এলাকায় রেখে দেয়। এইভাবে থাইল্যান্ডের দালালদের কাছ থেকে ছাড়া পেয়ে এখন আবার মালয়েশিয়ার দালালের খপ্পরে পড়েন।বেশ কয়েক দিন বাতু পাহাতে কৃষিকাজ করেন তিনি। যে টাকা আয় করতেন তা আবার দালালরা নিয়ে যেতো। এইভাবে জাফর আলমের কেটে গেলো মালয়শিয়ার আট মাসের জীবন। পরে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন যেকোনোভাবে বাড়ি যাবে। এক দালালের হাত ধরে তিনি বাংলাদেশ দূতাবাস চলে আসেন।মুশাররাত জেবিন তার এই অবস্থা জেনে তাকে ট্রাভেল পাস দেন ইমিগ্রেশন পাস নিতে যাতে কম টাকা লাগে এবং লোকটির দেশে যাওয়ার ব্যাপারে অনেকের কাছে সহযোগিতা হাত বাড়ান। রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত লোকটি দেশে আসার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।মুশাররাত জেবিন এ প্রতিবেদককে বলেন, দালালদের ব্যাপারে আমাদের সবাইকে আরও সচেতন হতে হবে। তাদের কোনো কথা বিশ্বাস করা যাবে না। যারা সমুদ্রেপথে লোক আনে তারা মাফিয়া চক্রের সঙ্গে জড়িত। আমরা সবাই সচেতন হলে মানবপাচার রোধ করা সম্ভব।বিএ

Advertisement