আজ থেকে প্রায় চারশ বছর আগে Thomas Hobbes বলে গেছেন, "self-interest is most fundamental human motivation"(Hobbes,1651) । একই প্রতিধ্বনি দেখতে পাই পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মূল প্রবক্তা অ্যাডাম স্মিথের (১৭২৩-১৭৯০) 'ওয়েলথ অফ নেশনস'-এ (An Inquiry into the Nature and Causes of Wealth of Nations, 1776) । পাশ্চাত্য দার্শনিকদের বেশিরভাগেই এটা গ্রহণ করে নিয়েছিলেন। মানুষ তাঁর ক্ষুদ্র অর্থনৈতিক ও বস্তুগত স্বার্থে উদ্বুদ্ধ হয়। তাঁরা নিজের স্বার্থের পক্ষের নীতিমালাকে সমর্থন করে, কেউ স্বার্থহীন ভাবে কোন কাজ করলে সেটাকে সন্দেহের চোখে দেখে। যদিও অনেক গবেষণায় এ মতের বিপরীত ফলাফল পাওয়া গেছে। এমনকি অন্যান্য জীবের (পশু-পাখি, পতঙ্গ) মধ্যেও নিঃস্বার্থ আচরণ দেখা যায়।
Advertisement
পরার্থবাদীতা(otherishhness) স্বার্থপরতার (selfishness) মতই মানব প্রকৃতির অংশ (Grant,2013; Shaven et.al.,2010)। অর্থনীতি একটি বিমুর্ত ফেনোমেনা যা সমাজের চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে। সমাজেরই একটি উপজাত ( by-product) হচ্ছে অর্থনীতি। এ দিক থেকে বিবেচনা করলে অর্থনীতি, সমাজ ও প্রকৃতি পরস্পরের জৈবিক আত্মীয়, কারণ একই ধরনের RNA/DNA দ্বারা এগুলোর সৃষ্টি। অর্থনীতি একটি সংবেদনশীল বিজ্ঞান, যার কোনো স্থিরতা নেই। প্রকৃতি, বিজ্ঞান ও রাজনীতির ক্রমাগত পরিবর্তনের কারণে এক্ষেত্রে কোনো সুস্পষ্ট উপসংহার টানা যায় না। বিশেষ করে দরিদ্র দেশগুলোতে অর্থনীতি অনেকাংশে বাই রাজনীতি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় ("Asian Drama: An Inquiry into the Poverty of Nations";Gunner Myrdal,1968)।
যেকোনো অর্থনীতিতে মৌলিক প্রশ্ন তিনটি- কি উৎপাদন করা হবে? কিভাবে উৎপাদন করা হবে? এবং কার জন্য উৎপাদন করা হবে? গ্রিক দার্শনিক প্লেটো (৪২৭-৩৪৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দ), এবং অ্যারিস্টোটল(৩৮৪-৩২২ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) এগুলোর উত্তর দেয়ার চেষ্টা করলেও এর পুঁজিবাদী দিকনির্দেশনামূলক উত্তর আসে এর সহস্রাধিক বছর পরে অ্যাডামস্মিথ(১৭২৩-১৭৯০) এর কাছ থেকে। এজন্য এডাম স্মিথকে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার জনক বলা হয়। তাঁর উত্তরগুলো হচ্ছে- বাজার যা কিনতে চাইবে তাই উৎপাদন করতে হবে। তবে বাস্তবতা হচ্ছে বাজার(জনগণ) এমন কিছু চাইতে পারে যা পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী দেশের পক্ষেও তৈরি করা সম্ভব না।
আর ভোক্তা যা চাইবে তাই উৎপাদন করতে হবে, এমনটি হলে আরো নানা সমস্যা তৈরি হবে। (তাহলে দর্শক যে ধরনের সিনেমা চায় কেবলমাত্র সে ধরনের সিনেমাই তৈরি করতে হবে। জনগণের ওপর কখনো বিশ্বাস হারানো যাবেনা! তবে চ্যাপলিনের কথাটা পুরোপুরি বিশ্বাস না করলেও মনে রাখতে হবে, "জনগণ হলো হেডলেস মনস্টার(monster)"। "ভ্যানিসে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র পুরস্কার পাওয়া সত্যজিৎ রায়ের "অপরাজিতা" জনগণ দেখেনি। "অযান্ত্রিক কোরাস" চলেনি। "গুপী গাইন বাঘা বাইন" ১০৭ সপ্তাহ চলেছিল। "পথের পাঁচালী"ও হিট করেছিল। ২০ বছর পর "বেদের মেয়ে জ্যোৎস্না" সেই রেকর্ড ভেঙে দেয়"। সূত্র: ইউটিউব)
Advertisement
সবচেয়ে কম খরচে উৎপাদন করতে হবে; কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে প্রতিবেশের ক্ষতি করে হলেও কি এটা করতে হবে। ন্যায্যতা এবং সাম্যতার কি হবে?
'যাদের টাকা আছে তাঁদের জন্য উৎপাদন করা হবে'। তাহলে যাদের টাকা নাই অথবা বেশি টাকা নাই, তাঁদের কি হবে? হাসপাতালে অক্সিজেন কি কেবলমাত্র যার সামর্থ্য আছে সেই পাবে? করোনা অনেক সমস্যা নিয়ে এসেছে, তবে এর ভালো দিক হচ্ছে এটা আমাদের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও ইকোলজিক্যাল সমস্যাগুলো অনাবৃত করেছে, যা আগে কখনো হয়নি। এক সাক্ষাৎকারে মার্কিন বুদ্ধিজীবী নোম চমস্কি করোনা-পরবর্তী সময়ে সমাজ ও অর্থনীতিতে ধনাত্মক পরিবর্তনের ক্ষীণ সম্ভাবনা নিয়ে হতাশা ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেছেন, "নিজেদের সুবিধার জন্য নয়া উদারবাদীরা যে ব্যবস্থা তৈরি করেছে, তাঁরাই আরেকটা কঠোরতর সংস্করণ সামনে আনার জন্য সচেষ্ট"। করোনা একটি দুর্যোগ, বিপ্লব নয়; যেমন ফরাসি বিপ্লব, রুশ বিপ্লব । বড় পরিবর্তনের জন্য দুর্যোগ তেমন কোন বড় ভূমিকা রাখেনা। বৈপ্লবিক পরিবর্তন এর জন্য প্রয়োজন বিপ্লব। তাই নিশ্চিত করে বলা যায় করোনার কারণে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার কাঠামোগত কোন পরিবর্তন হবে না। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার পরিবর্তন না হলে মার্কেটিংয়েরও বড় ধরনের কোন পরিবর্তন হবে না।
এমনকি এর মৌলিক নীতিমালা অপরিবর্তিত থাকবে। পরিবর্তন যা হচ্ছে তা হবে মানুষের আচরণে (behavioral), সেটা সমাজের নিয়ম-নীতি মানবিকতা ও মানব প্রকৃতির (nature) নয়। মনোবিজ্ঞানীরা বলেন নতুন অভ্যাস দীর্ঘদিন চর্চা করলে নতুন আচরণে স্থায়ী হয়। মার্কেটিংয়ের লোকেরা এটা বিশ্বাস করে এবং নতুন উদ্ভাবনের মাধ্যমে এই প্রক্রিয়ায় স্থায়ী বাজার সৃষ্টির জন্য চেষ্টা চালায়। প্রশ্ন হচ্ছে কত বারের চর্চায় আচরণ স্থায়ী হয় ? লকডাউন এর কারণে নতুন অনেক habit যেমন- অনলাইন শপিং, ক্যাশলেস লেনদেন, ঘরে থাকার অভ্যাস আমরা চর্চা করছি; কিন্তু এগুলি কি স্থায়ী হবে? এসকল ক্ষেত্রে মার্কেটিংয়ের বিবেচ্য বিষয় তিনটি-
প্রথম বিবেচ্যটি হচ্ছে, চলমান পরিস্থিতিতে পরিবর্তিত আচরণগুলো যেমন মাস্ক পরা, ভিড়ের মধ্যে না যাওয়া, একটু পরে পরে হাত ধোয়া; করোনার ভয় ও আইনের কারণে এগুলো বর্তমানের বাস্তবতা বা ''now normal'। সামাজিক দূরত্বের কথা ভেবে ব্যাংকের দরজায় কাউন্টার খালি হওয়া পর্যন্ত মানুষ অপেক্ষা করবে এটা আমাদের দেশের মতো দেশে স্থায়ী হবে কিনা এ নিয়ে সন্দেহ আছে। নিউজিল্যান্ড বা কানাডায় এটা কোনো নতুন অভ্যাস নয়, ওই সকল দেশের মানুষ এমনিতেই আইসোলেশনে থাকে। নিউজিল্যান্ডে জনসংখ্যার ঘনত্ব হচ্ছে প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ৪৪ জন, আর আমাদের বাংলাদেশ প্রায় ৩০০০ জন। কানাডার ভ্যানকুভার শহরে প্রতি বর্গমাইলে বাস করে ১১০০ জন, আর আমাদের ঢাকা শহরে প্রতি বর্গমাইলে জনসংখ্যার ঘনত্ব ৫৬,০০০। গতবছর লকডাউন শিথিল করার পর দিল্লিতে এক কিলোমিটার লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে মানুষ মদ কিনার জন্য হুরোহুরি করেছিল।
Advertisement
দ্বিতীয় বিবেচ্যটি হচ্ছে, স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসলে সব কিছু আগের মতই চলবে। ইতোমধ্যেই মানুষ হাঁপিয়ে ওঠে বলছে, "কবে যে সেই দিন আবার ফিরে পাবো" ('old normal) । তবে অনেকে মনে করেন মানুষ চেষ্টা করেও আর আগের অবস্থা পুরোপুরি হুবহু ফিরে পাবেনা। যেমনটি বলেছেন মহামারি বিশেষজ্ঞ রব ওয়ালেস, "পুঁজিবাদের সংকট প্রকাশিত হয়েছে স্বাস্থ্য সংকটের রূপে এবং মানুষ আর কোনদিনই স্বাভাবিক রূপে ফিরতে পারবে না" অনেকটা কবি টি এস এলিয়ট(১৮৮৮-১৯৬৫) যেমনটা বলেছেন, "there is nothing again"। নিউইয়র্ক টাইমস' পত্রিকার কলামিস্ট Tom Friedman সম্প্রতি এক লেখায় বলেছেন চলতি প্রজন্ম কাল নির্ধারণী দুটি এভরিভিয়েশন শিখবে যা হচ্ছে- BC(before Corona) এবং AC(after Corona) অর্থাৎ করোনা পরবর্তী পরিবর্তনটা খুবই সুস্পষ্ট হবে। ব্যক্তির না বদলালেও পৃথিবী বদলাবে ("It's not me, it's the world")।
তৃতীয় বিবেচ্য বিষয়টি হচ্ছে, মার্কেটিং কলা ও প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে এর সাহায্যে মানুষের পরিবর্তিত আচরণকে বাণিজ্যিক স্বার্থ হাসিলের কাজে ব্যবহার করা যাবে কিনা । গত কয়েক দশক ধরে মানুষের আচরণ সম্পর্কে আমরা যা শিখেছি, গত কয়েক মাসের করোনা কালে আরো বেশি শিখেছি । ক্রেতার আচরণিক পরিবর্তনগুলো আমাদের মেনে নিতে হবে, তবে সতর্ক থাকতে হবে । মানুষের আচরণ ও অভ্যাসের নীতির উপর ভিত্তি করে মার্কেটিংয়ের জন্য সুপারিশকৃত প্রতিক্রিয়াগুলো হল-
(১) নতুন আচরণগুলো অভ্যাসে পরিণত হচ্ছে অতএব এগুলো স্থায়ী হবে ধরে নেয়া
(২) পরিবর্তনগুলো স্থায়ী নয়, সময়মত সবকিছু আগের মতোই হয়ে যাবে। অতএব 'now normal' -এ টিকে থেকে থেকে 'new normal' এর জন্য অপেক্ষা করা।
(৩) তৃতীয় সুপারিশটি হচ্ছে, বাণিজ্যিক স্বার্থে মার্কেটিং কর্মকান্ডের মাধ্যমে মানুষের আচরণে অনুকুল পরিবর্তন আনার চেষ্টা করা ।
প্রথম সুপারিশটি গ্রহণ করা বিপদজনক, কারণ আচরণিক পরিবর্তন হয়েছে সাময়িকভাবে, রোগাক্রান্ত হওয়ার ভয়ে অথবা আইনের প্রয়োগের কারণে। করোনা চলে গেলে সবকিছু মানুষ আগের মতোই করতে চাইবে। বাজারজাতকরণ মিশ্রণের 4p উপাদানের গ্রাফিক উপস্থাপনের সময় একটি বড় বৃত্ত তৈরি করে মাঝখানে ছোট একটি বৃত্তে বড় হাতের "C"লেখা হয় । এই ছোট বৃত্তটির বাইরে চারপাশে চারটি "P" -প্রোডাক্ট, প্রাইস, প্লেস, ও প্রমোশন দেখানো হয়। অর্থাৎ সবকিছু হবে ক্রেতা কেন্দ্রিক। এক্ষেত্রে ক্রেতাকে মধ্য বৃত্তে রেখে বোঝানো হয়েছিল তাঁর আচরণ দ্বারাই '4p' নির্ধারিত হবে অথবা '4p' দ্বারা তাঁর আচরণ প্রভাবিত হবে। কিন্তু আচরণ পরিবর্তিত হলেও মানুষের প্রকৃতিতে একটা রক্ষণশীলতা বিদ্যমান থাকে, যা সহজে পরিবর্তিত হয় না। সেজন্য সুপারিশ হচ্ছে মার্কেটিং মিক্সের মধ্য বৃত্তের বড় হাতের "C" মধ্যে আরেকটা ছোট হাতের "c" সংযুক্ত করা। যার অর্থ হচ্ছে 'কনজারভেটিজম'(conservatism)। এর মাধ্যমে বাজারজাতকরণকারীকে মানুষের প্রকৃতির স্থিরতার বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দেয়া হবে।
পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় কথা ছিল, "বড় ব্যবসায়, ছোট সরকার"। করোনা তা বদলে দেয়ার পথ তৈরি করেছে। বেসরকারি মালিকরা শ্রমিকদের বেতন দিতে না পারায় সরকার শ্রমিকদের মজুরি পরিশোধের জন্য ঋণ সহায়তা দিচ্ছে । সাইবার প্রযুক্তি ব্যবহার করে- কে কোথায় যাচ্ছে, কার সাথে কে কি কথা বলছে তারও খবর রাখছে সরকার। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের করনীয় কাজগুলো করতে গিয়ে সরকারগুলোর বাজেট ঘাটতি বাড়ছে। MicKency & Co. এর হিসাব মতে ২০২০সালে এই ঘাটতির পরিমাণ ছিল ১১ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। সরকারগুলোর বৈদেশিক ঋণের বোঝা বেড়েই যাচ্ছে। যেখানে জিডিপি এবং বৈদেশিক ঋণের অনুপাত সর্বোচ্চ সহনীয় সীমা ধরা হয় ৪৯.৭%, সেখানে শ্রীলঙ্কায় এই অনুপাত ১০১%।
বাংলাদেশে এখনও বৈদেশিক ঋণের ঝুঁকিতে নেই, কারণ বাংলাদেশের জিডিপি ও বিদেশি ঋণের অনুপাত ২৮.৭১%। বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এর বিপরীতে স্বল্পমেয়াদী ঋণের অনুপাত ০.৩% , যেখানে সহনীয় সীমা হচ্ছে ১.৩৪%। কতদিন পর্যন্ত চলবে তা অনিশ্চিত। করদাতারা কর প্রদানের সামর্থ্য অর্জন করলেই তাঁদের নিকট থেকে সরকারগুলো এটা আদায় করবে। মহামারির সময় সরকার লাইফ লাইন হিসেবে ঋণ দিচ্ছে। ব্যবসায়ীরাও তা লুফে নিচ্ছে। একদিকে মহামারীর কারণে সৃষ্ট মন্দার কারণে বিক্রয় কমে যাওয়ায় প্রতিষ্ঠানগুলোর রাজস্ব আয় কমছে, অন্যদিকে ঋণ বাড়ছে।
কোম্পানিগুলোর ব্যালেন্স শিট ভারসাম্যহীন হচ্ছে। ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা না থাকলেও অবিশ্বাস্যরকম ভাবে কোম্পানিগুলো ঋণ নিচ্ছে। এতে ঋণখেলাপির তালিকা দীর্ঘতর হচ্ছে। চাকরির বাজারের চেয়ে দ্রুত হারে আর্থিক বাজার(শেয়ার, ঋণ...) ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। কঠোর বিধি-নিষেধ বা লকডাউন চলাকালেও গতকাল (৩/৮/২১) সূচক ও লেনদেনে নতুন রেকর্ড গড়েছে বাংলাদেশের পুঁজিবাজার,। এই দিন ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের প্রধান সূচক সর্বোচ্চ উচ্চতায় পৌঁছেছে (৬,৫৩৫.৮৭ পয়েন্ট), ঐদিন বাজার মূলধনও এযাবতকালের সবচেয়ে বেশি রেকর্ড অতিক্রম করেছে, যার মূল্য ছিল ৫ লক্ষ ৪১ হাজার কোটি টাকা। আর্থিক বাজারের স্টেকহোল্ডারা অপেক্ষাকৃত ধনী বলেই এমনটি হচ্ছে ।
সার্বিক প্রবৃদ্ধির তুলনায় কর্মসংস্থানের প্রবৃদ্ধি কম এবং নেগেটিভ। সমাজে ব্যাপক বৈষম্য তৈরী হচ্ছে। নতুন করে যুক্ত হয়েছে 'cyber poverty gap'। দারিদ্র্য বিমোচনের প্রক্রিয়া কোন কোন দেশে একদশক পিছিয়ে যাবে বলে আইএমএফ বলছে। উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধি দিয়ে বৈষম্য কমানো যাচ্ছে না। যেমনটি বলেছেন টমাস পিকেটি তাঁর "Capital in the 21st century" বইয়ের, "উন্নয়ন অর্জনে সফল হওয়ার পরেও আয় ও সম্পদের বৈষম্য কমেনা" ।
করোনা দুর্যোগের কারণে আয় বৈষম্য ও বেকারত্ব আরো বাড়ছে। করোনার আরেকটি প্রভাব হচ্ছে শিল্প-কারখানায় শারীরিক সংস্পর্শ এড়িয়ে চলতে এবং খরচ বাঁচাতে রোবট চলে আসছে (চতুর্থ শিল্প বিপ্লব)। মন্দার সময় অটোমেশন জোরদার হয়, করোনা কালেও এর ব্যতিক্রম হচ্ছে না। কৃষিতেও দ্রুত যান্ত্রিকীকরণ হচ্ছে। আমাদের দেশেও কম্বাইনড হারভেস্টারের চাকায় পৃষ্ট হচ্ছে "দাওয়ালরা"। যাঁদের স্বার্থরক্ষায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একবার আন্দোলনে নেমেছিলেন ( "অসমাপ্ত আত্মজীবনী", শেখ মুজিবুর রহমান পৃষ্ঠা-১০৩)
মার্কেটিংয়ের লোকেরা যত গবেষণা করেন সব গবেষণায় কোম্পানির স্বার্থ কেন্দ্রিক। কিভাবে কোম্পানির ব্র্যান্ডের শ্রীবৃদ্ধি করে বাজারে প্রতিযোগিতামূলক অবস্থায় আরো সুদৃঢ় অবস্থান নেয়া যায়, মুনাফা ও কোম্পানির প্রবৃদ্ধিই এসকল গবেষণার মূল বিষয়বস্তু। এমনকি ভোক্তা আচরণ সংক্রান্ত মডেল ও থিউরিগুলোও মার্কেটিংয়ের মৌলিক গবেষণা থেকে খুব কমই এসেছে। এগুলো বেশিরভাগই ধার করে নেয়া হয়েছে সমাজবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান,নৃবিজ্ঞান,অর্থনীতিসহ অন্যান্য সামাজিক বিজ্ঞান ও মানবিক শাস্ত্র থেকে। মার্কেটিং এর বদৌলত সফট ড্রিংকস ও বোতলজাত পানির ব্যবসা রমরমা হলেও এখনো পৃথিবীর অনেক জায়গাতেই মানুষ সুপেয় পানি তো দূরের কথা, পানিই পাচ্ছে না। বিদ্যুতও পৌঁছানো যায়নি সকলের কাছে। বিজ্ঞানের আবিষ্কার প্রযুক্তির কল্যাণে মার্কেটিংয়ের সহায়তায় বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়লেও এর কয়টার প্রাপ্যতা সকলের জন্য নিশ্চিত করা গেছে?
একমাত্র মোবাইল ফোনকে কিছুটা গণতান্ত্রিক প্রযুক্তি বলা যেতে পারে। এর বাইরে ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য প্রযুক্তি যা কিছু উদ্ভাবন করেছে তার খুব কমই সাধারণ জনগণ ব্যবহার করতে পেরেছে (Jagdish Sheth,2018)। মার্কেটিং এর বদৌলতে ব্যক্তিগত ব্যবহার্য প্রযুক্তি যতটা সহজলভ্য হয়েছে, পাবলিক পণ্য (pubic goods) ততটা বাড়েনি, বরং অনেক ক্ষেত্রে সীমিত হয়েছে। বড় ব্র্যান্ডেড প্রোডাক্টের উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলো যাদের কাছে বেশি টাকা আছে তাঁদের কাছে নিজের ব্র্যান্ড পৌঁছে দেওয়ার জন্য যত গবেষণা করেছে, দরিদ্র জনগোষ্ঠী অথবা নিম্ন আয়ের লোকদের নিকট তাঁদের ব্র্যান্ডের পণ্য পৌঁছে দেওয়ার জন্য ততটা সচেষ্ট হয়নি। করোনা পরবর্তী বিশ্বে ব্র্যান্ড practitioners রা যদি সাধারণ মানুষ ও সমাজের দিকে বেশি মনোযোগী হন তাহলে সেটা হবে সোশালি রেস্পন্সিবেল মার্কেটিং। এক্ষেত্রে মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা, জনস্বাস্থ্য, শিক্ষা, বাসস্থান, জন নিরাপত্তা ও প্রতিবেশ সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য পাবে এটাই প্রত্যাশা।
গত ৬০ বছর ধরে আধুনিক মার্কেটিং এর গুরু ফিলিপ কটলার মার্কেটিংয়ের তাৎপর্য যেভাবে অনুধাবন করেছেন এবং সারা বিশ্ববাসীকে যেভাবে শিখিয়েছেন সেটা হচ্ছে, সমাজের ক্ষতি না করে ক্রেতাকে সর্বোচ্চ সন্তুষ্টি দানের মাধ্যমে কোম্পানির সর্বোচ্চ মুনাফা নিশ্চিত করা। কোম্পানিগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেটাই অনুসরণ করেছে, কিন্তু অতি সম্প্রতি ফিলিপ কটলার তাঁর ৯০ তম জন্মদিনের উপলক্ষ্যে আয়োজিত অনুষ্ঠানে এক বক্তৃতায় যার উপর বেশি জোর দিয়েছেন সেটা হচ্ছে, "Better Marketing for Better World (BMBW)। 'বেটার মার্কেটিং ফর বেটার ওয়াল্ড' এর দুটি কম্পোনেন্ট। প্রথমটি হচ্ছে- Gross Domestic Happiness(GDH), ভুটানের প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে এই ধারণাটি পেয়েছেন বলে উল্লেখ করেছেন; অপরটি হচ্ছে, Gross Domestic Wellbeing (GDW)।
করোনার কারণে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার কোন বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে না । মানুষের আচরণের পরিবর্তনের কারণে চলমান কৌশলের কিছু পরিবর্তন হলেও বাজারজাতকরণের মৌলিক নীতিমালা অপরিবর্তিত থাকবে। করোনা উত্তর কালেও ক্রেতার চাহিদা শনাক্ত করে তা ভালোভাবে বুঝে যথাযথভাবে সেটা পূরণ করার মাধ্যমে মুনাফা অর্জন করার যে প্রক্রিয়া সেটা অপরিবর্তিত থাকবে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থাটি মুনাফা অর্জনের কাঠামোর ওপর দাঁড়িয়ে আছে, এরমধ্যেই আমাদের থাকতে হবে । সহসা এই ব্যবস্থার মৌলিক কোনো পরিবর্তন হবে না। আচরণে সাময়িক কিছু পরিবর্তন হলেও মানুষের প্রকৃতিতে শত- সহস্র বছরেও পরিবর্তন আসে না। করোনা উত্তর সময়ে বিনিয়োগ, সম্পদ ও পরিকল্পনায় পরিবর্তন হবে।
ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে বাজারজাতকরণের দৈনন্দিন কলাকৌশল প্রতিদিনই পরিবর্তিত হতে হবে, যেটা করোনা পূর্ববর্তী সময়েও হত। ক্রেতাকে অনুধাবন এবং ক্রেতা সম্পৃক্ততার জন্য ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ও সামাজিক চ্যানেলের ব্যাপক ব্যবহার বাজারজাতকরণ কর্ম কৌশলের ব্যাপক পরিবর্তন নিয়ে আসবে। করোনা ক্রেতার ক্রয় পরিক্রমায়ও পরিবর্তন নিয়ে আসবে।
বাজার দ্রুততর ও অধিক সৃজনশীল উদ্ভাবন চাইবে। উদ্দেশ্য তাড়িত (purpose driven) বার্তা এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে কার্যকর পদক্ষেপ আগের চেয়ে অনেক বেশি প্রাধান্য পাবে। স্থানীয় বাজারজাতকরণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ বাড়বে। বাজারজাতকরণ আরো উপাত্ত ও বিশ্লেষণ নির্ভর হবে(Mathilde et.al.;2020)। তবে সকল ক্ষেত্রেই মার্কেটিংয়ের কাজ হবে কোম্পানির স্বার্থ দেখার পাশাপাশি জনস্বার্থকে তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার কেন্দ্রবিন্দুতে রাখা, তাহলেই কেবল বেটার মার্কেটিংয়ের মাধ্যমে বেটার ওয়ার্ল্ড গঠনে মার্কেটিংয়ের তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা সুস্পষ্ট হবে।
*"চতুর্থ বাংলাদেশ মার্কেটিং ডে-২০২১" উপলক্ষে সভাপতির ভাষণের(পরিমার্জিত) অংশবিশেষ।*
লেখক : অধ্যাপক, মার্কেটিং বিভাগ ,ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং সাবেক ভিসি, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
এইচআর/এমএস