ডা. উম্মে হুমায়রা কানেতা
Advertisement
বর্তমানে সবচেয়ে আতঙ্কিত হওয়ার মতো রোগ কোনটি? শারীরিক কেন উপসর্গে আপনি বেশ চিন্তিত ও ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে উঠবেন? উত্তর একটাই- জ্বর।
এখন জ্বর আসলে আর আগের মতো স্থির থাকা যায় না। জ্বর বা শরীরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়া কেবলমাত্র একটি উপসর্গ। এর কারণ কোভিড-১৯, ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া না-কি টাইফয়েড?
কোভিড ১৯ নিয়ে বিগত দেড় বছর ধরে সারাবিশ্বে তোলপাড় অবস্থা। এদেশে সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার দিন দিন বেড়েই চলেছে। সবাই যখন কোভিডের সঙ্গে লড়াই করতে ব্যস্ত; তখন যুক্ত হয়েছে নতুন ত্রাস ডেঙ্গু।
Advertisement
ডেঙ্গু ফিভার। যার অন্য নাম ঢাকা ফিভার। ২০১৯ সালের ডেঙ্গুর ঘূর্ণিঝড়ে ঝরে পড়েছিল অসংখ্য তাজাপ্রাণ। ২০২১ এ কোভিড মহামারির সঙ্গে ডেঙ্গু মিলে কি যে বিপর্যয় নিয়ে আসবে; তা ভাবতেও ভয় হয়।
ডেঙ্গু ও করোনা
দুটো রোগের উপসর্গ এক হলেও চিকিৎসা পদ্ধতিতে আছে বিস্তর পার্থক্য। কারো যদি দুটি রোগ একইসঙ্গে হয়; সেক্ষেত্রে স্বাস্থ্য জটিলতা বাড়তে পারে। পাশাপাশি চিকিৎসা পদ্ধতির জটিলতা ও অনেক। অনেকেই প্রশ্ন করতে পারেন কেন?
কোভিড এ রক্ত জমাট বাঁধার প্রবণতা বেড়ে যায়। এজন্য রক্ত পাতলা করার ওষুধ ব্যবহার করা হয়। অন্যদিকে ডেঙ্গুতে রক্তপাত হওয়ার সম্ভাবনা বা ব্লিডিং টেনডেনসি থাকে। তাই রক্ত পাতলা করার ওষুধ দিলে আরো মারাত্মক পরিস্থিতি হবার আশঙ্কা থাকে।
Advertisement
এরই মধ্যে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে সারাদেশে বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি প্রায় হাজার খানেক রোগী। যার অনেকেই আবার ভুগছেন কোভিডেও। দুটি রোগের লক্ষ্মণ যেহেতু কাছাকাছি, তাই জ্বর আসলে এখন আর কোন অবহেলা করা যাবেই না। জ্বর আসলে অবশ্যই পরীক্ষা করাতে হবে।
কোভিড এ সাধারণত জ্বরের সঙ্গে গলাব্যথা, নাকে ঘ্রাণ না পাওয়া, মুখে স্বাদ না পাওয়া, শ্বাসকষ্ট- এই উপসর্গগুলো থাকে। অপরদিকে ডেঙ্গুতে জ্বর, আর তার সাথে তীব্র গা ব্যথা, মাথাব্যথা, শরীরে র্যাশ আসতে পারে।
দুটো রোগের প্রাথমিক চিকিৎসা ঘরে বসে টেলিমেডিসিনের মাধ্যমে নেওয়া যায়। জ্বরের জন্য প্যারাসিটামল ছাড়া অন্য কোনো ব্যথার ওষুধ (এসপিরিন বা আইবুপ্রফেন) খাওয়া যাবে না। প্রচুর তরল খাদ্য গ্রহণ করতে হবে। কোভিড ও ডেঙ্গু শনাক্তকরণ এর জন্য টেস্ট করাতে হবে।
যারা গর্ভবতী, শিশু, বৃদ্ধ, স্থূল স্বাস্থ্যের অধিকারী, দীর্ঘদিন যাবত ডায়াবেটিস, হাইপারটেনশন, কিডনি, হার্ট, লিভার বা অন্য কোন দীর্ঘমেয়াদি শারীরিক সমস্যায় ভুগছেন, তারা খুব সতর্ক থাকবেন ও নিজ চিকিৎসক এর পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ সেবন করবেন।
কখন হাসপাতালে যাবেন?
ওয়ার্নিং সাইন যেমন- পেট ব্যথা, বমি, অতিরিক্ত দুর্বলতা, শ্বাসকষ্ট বা কনসাস লেভেল অলটারড হলে দেরি না করে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে। যারা উভয় সমস্যায় ভুগছেন; তারা কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে যাবেন।
আর যারা শুধু ডেঙ্গুতে ভুগছেন; তারা অন্য হাসপাতালে সেবা নিন। কখন কি করতে হবে? বা কোথায় যেতে হবে? এই সঠিক ধারণার অভাবে অনেক রোগী বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে থাকেন। চিকিৎসা নিতে দেরি হয়। ফলশ্রুতিতে রোগীর অবস্থা সংকটাপন্ন হয়ে ওঠে। তাই করণীয়গুলো জানতে হবে সবার৷
টেস্ট করানোর ক্ষেত্রে কোন অনীহা রোগীর জন্য সুফল বয়ে আনবে না। দুটো রোগের কারণ ছোট ছোট দু’টি ভাইরাস। তবে এদের কাছেই আজ আমরা অসহায়। তাই সবাই মিলে প্রতিরোধ গড়ি তুলি৷
ডেঙ্গু ও করোনা প্রতিরোধের উপায়
কোভিডের জন্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে, বাইরে গেলে মাস্ক পড়ার বিকল্প নাই। ভ্যাকসিন গ্রহণ করতে হবে। সামাজিক দূরত্ব যতটুকু সম্ভব মেনে চলতে হবে। প্রয়োজন ছাড়া বাসার বাইরে না যাওয়াই শ্রেয়।
আর ডেঙ্গুর জন্য প্রতিহত করতে হবে এর বাহক এডিস মশাকে। ডেঙ্গুর কোনো ভ্যাক্সিন নেই। ডেঙ্গু ভাইরাস ৪ ধরনের। ডেঙ্গু জ্বর প্রতিরোধের মূল উপায় হলো, এর বাহকের বিস্তার রোধ করা। যাতে মশা কামড়াতে না পারে; তার ব্যবস্থা করা।
মনে রাখতে হবে, এডিস একটি এলিট মশা, ময়লা দুর্গন্ধযুক্ত ড্রেনের পানিতে এরা বসবাস করে না, বরং অভিজাত এলাকায় বড় বড় সুন্দর সুন্দর দালান কোঠায় এদের বাস। স্বচ্ছ পরিষ্কার পানিতে এই মশা ডিম পাড়ে।
তাই ডেঙ্গু প্রতিরোধে এডিস মশার ডিম পাড়ার উপযোগী স্থানগুলোকে পরিষ্কার রাখতে হবে এবং একই সাথে মশক নিধনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। এই রোগ থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় হলো ব্যক্তিগত সতর্কতা এবং এডিস মশা প্রতিরোধ।
এডিস মশা মূলত দিনের বেলা, সকাল ও সন্ধ্যায় কামড়ায়, তবে রাত্রে উজ্জ্বল আলোতেও কামড়াতে পারে। তাই দিনের বেলা যথাসম্ভব শরীর ভালোভাবে কাপড়ে ঢেকে রাখতে হবে, পায়ে মোজা ব্যবহার করা যেতে পারে।
বাচ্চাদের হাফপ্যান্টের বদলে ফুলপ্যান্ট বা পায়জামা পড়াতে হবে। মশার কামড় থেকে বাঁচার জন্য দিনে ও রাতে মশারী ব্যবহার করতে হবে। দরজা-জানালায় নেট লাগাতে হবে। প্রয়োজনে মসকুইটো রিপেলেন্ট, স্প্রে, লোশন বা ক্রিম, কয়েল, ম্যাট ব্যবহার করা যেতে পারে।
যেহেতু এডিস মশা মূলত জমে থাকা স্বচ্ছ পানিতে ডিম পাড়ে, তাই বাড়ি-ঘরে এবং আশপাশে যেকোনো পাত্র বা জায়গায় জমে থাকা পানি ৩-৫ দিন পরপর ফেলে দিলে এডিস মশার লার্ভা মারা যাবে। ঘরের কোথাও জমানো পানি ৫ দিনের বেশি যেন না থাকে। একুরিয়াম, ফ্রিজ বা এয়ার কন্ডিশনারের নিচে এবং মুখ খোলা পানির ট্যাংকে যেন পানি জমে না থাকে সে ব্যবস্থা করতে হবে।
বাড়ির ছাদে অনেককে বাগান করতে দেখা যায়, সেখানে টবে বা পাত্রে যেনো জমা পানি ৫ দিনের বেশি না থাকে, সেদিকেও যত্নবান হতে হবে। বাড়ির আশপাশের ঝোপ-ঝাড়, জঙ্গল, জলাশয় ইত্যাদি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। বসতবাড়ির বাইরে মশার বংশ বিস্তার রোধ করার দ্বায়িত্ব প্রশাসনে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গের।
একমাত্র সচেতনতা ও প্রতিরোধের মাধ্যমেই এই কোভিড - ডেঙ্গুর হাত থেকে মুক্তি সম্ভব। কেউ কারো থেকে কম নয়। দুটো রোগই সমানে সমান।
লেখক: মেডিকেল অফিসার, মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।
জেএমএস/জেআইএম