আজ ৪ আগস্ট। আলোচিত পিনাক-৬ লঞ্চডুবির সাত বছর পূর্ণ হলো। ২০১৪ সালের ৪ আগস্ট ঈদ শেষে কর্মস্থলে ফেরা ঢাকামুখী আড়াই শতাধিক যাত্রী নিয়ে কাওড়াকান্দি থেকে মুন্সিগঞ্জের মাওয়াঘাটে আসার সময় উত্তাল পদ্মায় ঢেউয়ে মুহূর্তেই ডুবে যায় পিনাক-৬ লঞ্চটি। ওই লঞ্চডুবিতে শতাধিক যাত্রী জীবিত উদ্ধার হলেও নিখোঁজ থাকেন দেড় শতাধিক। সরকারি হিসাবে নিখোঁজ ১৩৬ জনের মধ্যে সলিল সমাধি হয় ৪৭ যাত্রীর। এখনো নিখোঁজ ৬০ জন।
Advertisement
যাত্রীদের মৃত্যু ও নিখোঁজের ঘটনায় দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি না হওয়ায় প্রিয়জন হারানোর বেদনা বেড়েছে বহুগুণ। স্বজনের লাশ খুঁজে না পেলেও অন্তত বিচারের দাবি স্বজনহারাদের।
মুন্সিগঞ্জের টঙ্গিবাড়ীর বেতকা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য (মেম্বার) আমানুল হক জানান, প্রতি বছর ঈদ এলেই তাদের পরিবারে বিষাদের ছায়া নেমে আসে। ওই লঞ্চডুবিতে তার নাতনি ইমা আক্তার নিখোঁজ হন। তিনি ঢাকার আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের ছাত্রী ছিলেন। দুর্ঘটনার পর টানা ৯ দিন খোঁজ করেও তার মরদেহ পাওয়া যায়নি।
মাদারীপুরের শিবচরের দৌলতপুর গ্রামে ঈদ শেষে ঢাকার পথে পিনাক-৬ এ পদ্মা পাড়ি দিচ্ছিলেন ফরহাদ মাতুব্বর, তার স্ত্রী শিল্পী, এক বছরের সন্তান ফাহিম ও শ্যালক বিল্লাল। এ চারজনের মরদেহ আজও উদ্ধার হয়নি। ফরহাদের বোন প্রিয়া আক্তার জানান, প্রিয়জনের মরদেহ পাওয়ার আশা ছেড়ে দিয়ে তারা এখন বিচারের অপেক্ষা করছেন।
Advertisement
এদিকে দুর্ঘটনায় পাঁচ নারী, দুই পুরুষ, পাঁচ শিশুসহ ১২ যাত্রীর পরিচয় শনাক্ত না হওয়ায় তাদের মরদেহ শিবচরের পাঁচ্চর এলাকায় বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করে প্রশাসন। স্বজনরা জানিয়েছেন, ডুবে যাওয়া পিনাক-৬ এর ভেতরে অনেক মরদেহ রয়েছে। লঞ্চটি উদ্ধার হলে ভেতরে আটকে থাকা যাত্রীদের মরদেহ পাওয়া যেত।
এদিকে দুর্ঘটনার পর পিনাক-৬ লঞ্চের মালিক আবু বক্কর সিদ্দিক কালু, তার ছেলে ওমর ফারুক, কাঁঠালবাড়ী ঘাটের ইজারাদার আতাহার আলীসহ ছয়জনকে আসামি করে মুন্সিগঞ্জের লৌহজং থানায় মামলা হয়। ওই মামলায় র্যাব আবু বক্কর সিদ্দিক কালুকে চট্টগ্রাম থেকে এবং তার ছেলে ওমর ফারুককে ঢাকা থেকে গ্রেফতার করে।
মুন্সিগঞ্জ আদালত সূত্র জানায়, দীর্ঘদিন কারাগারে থেকে পিনাক-৬ লঞ্চের মালিক আবু বক্কর সিদ্দিক কালু ও তার ছেলে ওমর ফারুকসহ আসামিরা জামিনে রয়েছেন। স্থানীয় ও লঞ্চ মালিক সমিতি সূত্রে জানা গেছে, বেশ কিছুদিন আগে আবু বক্কর সিদ্দিক কালু মারা যান।
শিমুলিয়া বাংলাবাজার নৌরুটের লঞ্চ মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মনির হোসেন জানান, দিনটি আসলে শিমুলিয়া ঘাটে শোকের ছায়া নেমে আসে। পিনাক-৬ এর মালিক আবু বক্কর সিদ্দিক কালু মারা যাওয়ার বিষয়টি তিনিও নিশ্চিত করেন।
Advertisement
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) শিমুলিয়া নদী বন্দরের নৌনিরাপত্তা ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা বিভাগের সহকারী পরিচালক মো. সাদাত হোসেন জাগো নিউজকে জানান, পিনাক-৬ ডোবার পর গত সাত বছরে এই নৌরুটের লঞ্চ পরিচালনায় অনেক পরিবর্তন হয়েছে। আগে জেলা পরিষদের তত্ত্বাবধানে একজন কর্মকর্তা ও একজন কর্মচারীর মাধ্যমে লঞ্চ পরিচালনা করা হতো। সেক্ষেত্রে তদারকি কম ছিল। এখন শিমুলিয়া ও বাংলাবাজার দুই ঘাট মিলিয়ে তিনজন কর্মকর্তা ও ছয়জন কর্মচারী মিলিয়ে ৯ জন তদারকিতে আছেন।
তিনি জানান, নৌরুটে বর্তমানে ৮৮টি লঞ্চের অনুমোদন থাকলেও ৮৭টি লঞ্চ চলাচল করছে। লঞ্চের ফিটনেস, রেজিস্ট্রেশন ও সার্ভের রিপোর্ট ঠিকঠাক থাকলেই কেবল তাদের চলাচল করতে দেয়া হয়।
‘আগে রাতদিন ২৪ ঘণ্টায়ই লঞ্চ চলত। প্রতিটি লঞ্চে তিন স্তর নিচে, বিলাসে ও ছাদে যাত্রী নেয়া হতো। এখন রাত ৮টা পর্যন্ত লঞ্চ চলাচল করে। ছাদে যাত্রী নেয়া বন্ধ করা হয়েছে। পাশাপাশি প্রতিটি লঞ্চে ১১০ ফুট রশির সঙ্গে লাইফ বয়া সংযুক্ত করা হয়েছে, যাতে কোনো লঞ্চ দুর্ঘটনায় পড়লে বা ডুবে গেলে তার অবস্থান শনাক্ত করা যায়।’
‘জুলাই-আগস্ট এই দুই মাস পদ্মা নদী উত্তাল থাকে। এ সময় আবহাওয়া খারাপ দেখলেই লঞ্চ চলাচল বন্ধ রাখা হয়, যাতে দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব হয়। নদীতে চলাচলকারী এমভি ও এমএল লঞ্চগুলো এখন অনেক নিয়ম মেনে চলে। ঈদ আসলে তদারকি, ভ্রাম্যমাণ আদালতের উপস্থিতি থাকে’-বলেন সাদাত হোসেন।
লৌহজং থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আলমগীর হোসাইন জাগো নিউজকে জানান, দুর্ঘটনার পর বিআইডব্লিউটিএর পরিবহন পরিদর্শক জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া বাদী হয়ে মামলা করেন। তদন্ত শেষে ২০১৭ সালে আসামিদের বিরুদ্ধে মুন্সিগঞ্জের সংশ্লিষ্ট আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে। এরপর থেকে মামলাটি আদালতে বিচারাধীন।
মুন্সিগঞ্জ আদালতের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) আবদুল মতিন জাগো নিউজকে জানান, পিনাক-৬ লঞ্চডুবির ঘটনায় পাঁচজনকে আসামি করে মামলা করা হয়েছিল। মামলাটি এখনো আদালতে বিচারাধীন। এর মধ্যে মূল আসামি কালু মিয়া মৃত্যুবরণ করেছেন। অন্য চার আসামি জামিনে আছেন।
আরাফাত রায়হান সাকিব/এসআর/এমএস