ড. রাফিউদ্দিন আহমেদ উদ্যোক্তা বিষয়ে দেশ-বিদেশের স্বনামধন্য প্রশিক্ষক। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ এবং মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমআইবিতে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। এছাড়াও উদ্যোক্তা বিষয়ে এল এ ট্রোব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করেছেন। তিনি বাংলাদেশের ই-লার্নিং আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ। ১৬ বছর ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক। পাশাপাশি স্ট্র্যাটেজিস্ট বা ট্রেনার, এডুপ্রেনিউর, স্বাস্থ্যসেবা উদ্যোক্তা হিসেবে কাজ করছেন। তিনি ইনোকিডসের (কিডস্প্রেইনারশিপ প্রোগ্রাম) প্রতিষ্ঠাতাও।
Advertisement
সম্প্রতি বিভিন্ন বিষয়ে জাগো নিউজের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ফিচার লেখক বেনজির আবরার—
জাগো নিউজ: প্রথমেই আপনার সম্পর্কে কিছু বলুন—ড. রাফিউদ্দিন আহমেদ: পাঠদান আমার পেশা। তবে আমি উদ্যোক্তাদের সাথে কাজ করি। অস্ট্রেলিয়ার এল এ ট্রোব ইউনিভার্সিটিতে কিডস্প্রেইনার্সে পিএইচডি শেষ করেছি। বর্তমানে ‘উদ্যোক্তা ১০১’ নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং ব্র্যাক ব্যাংক দ্বারা প্রবর্তিত উদ্যোক্তা প্রশিক্ষণে প্রধান নির্দেশক ও প্রশিক্ষক হিসাবে কাজ করছি। আমার কাজের লক্ষ্য হলো—বেকার সমস্যা সমাধানের জন্য নিজেই নিজের বস হওয়া, বর্তমান প্রজন্মকে ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশনের আওতায় আনা, বর্তমান কোভিড পরিস্থিতিতে শিক্ষাব্যবস্থা অচল না রেখে অফলাইন থেকে অনলাইনে স্থানান্তর করা এবং শিশুদের সাথে কাজ করা।
জাগো নিউজ: ‘ইনোকিডস’ প্রথম কীভাবে শুরু করলেন?ড. রাফিউদ্দিন আহমেদ: যখন আমি উচ্চশিক্ষার জন্য অস্ট্রেলিয়া গিয়েছিলাম; তখন তাদের বাচ্চাদের স্বাবলম্বী হতে দেখেছি। ১৪-১৫ বছর বয়সী ছেলে-মেয়েরা তাদের খরচ নিজেরাই চালাচ্ছে। অন্যদিকে, আমাদের দেশের ছেলে-মেয়েরা চাকরি পেতে কমপক্ষে ২৫ বছর অপেক্ষা করে। তাদের চাকরি দক্ষতা ছাড়াই টিকে থাকবে এমন কোনো সুরক্ষা নেই। আবার যারা ২১-২২ বছর বয়স থেকে কাজ করে উদ্যোক্তা হতে চান, তারা পর্যাপ্ত সময়, দক্ষতা এবং পরিবারের সহযোগিতা পান না। এ চিন্তা-ভাবনা থেকেই চাইতাম কীভাবে এর সমাধান করা যায়। তারপর ভাবলাম, যদি আমাদের শিশুরা ১৫-১৬ বছর বয়স থেকে উদ্যোক্তা হয়, চাকরির জন্য না গিয়ে তারা চিন্তা-ভাবনা করে, নিজস্ব কিছু করার পাশাপাশি দক্ষতা বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় সময় বের করে, তাহলে তাদের দিয়েও সম্ভব। এ উদ্দেশে ইনোকিডস ধারণাটি মনে আসে। তাই বাচ্চাদের সাথে কাজ করার জন্য আমি কিডস্প্রেইনারশিপে পিএইচডি করেছি এবং ইনোকিডস শুরু করেছি। প্রথমে অস্ট্রেলিয়ার একটি স্কুলে ৫ম গ্রেডারের সাথে কাজ করেছি। তাদের কীভাবে উদ্যোক্তা হতে হবে, তা শিখিয়েছি। বাচ্চারা কী কী করতে পারে, তা দেখে আমি অবাক হয়েছি। তাই সম্প্রতি আমার নিজের দেশে শুরু করেছি।
Advertisement
জাগো নিউজ: আমরা জানি, আপনি একটি ‘অস্ট্রেলিয়া অ্যালামনাই গ্রান্ট’ পেয়েছেন, এ সম্পর্কে যদি কিছু বলেন—ড. রাফিউদ্দিন আহমেদ: মাস্টার্স ও পিএইচডি অস্ট্রেলিয়ায় করার সুযোগে ইনোকিডস প্রজেক্টটি নিয়ে ‘অস্ট্রেলিয়া অ্যালামনাই গ্রান্টে’ আবেদন করি। অস্ট্রেলিয়া অ্যালামনাই গ্রান্ট জ্ঞান এবং দক্ষতা বাড়ানোর জন্য প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে সিড তহবিল সরবরাহ করে। ইনোকিডস কেবল কাজের নির্ভরতা নয় বরং বাচ্চাদের সাথে দক্ষতা বাড়াতে এবং তাদের ভবিষ্যতের চিন্তা-ভাবনাকে প্রভাবিত করতে কাজ করে। ইনোকিডস নিয়ে আমার ধারণা, তাদের দেশের ভবিষ্যতের শিশুদের জন্য প্রভাব ফেলতে পারে। তাই তারা আমাকে ‘অ্যালামনাই গ্রান্ট’ প্রদান করেন।
জাগো নিউজ: ইনোকিডসে রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়া সম্পর্কে আমাদের বলুন— ড. রাফিউদ্দিন আহমেদ: ছয় মাসব্যাপী কিডস্প্রেনিয়র ১.০ নামে আমাদের সামনে একটি প্রোগ্রাম আছে। যেখানে ৫০ শিশুকে সম্পূর্ণ স্কলারশিপ দিয়ে দক্ষতা (জীবন, সামাজিক, প্রযুক্তিগত ও ব্যবসায়িক দক্ষতা) শেখানো হবে। বুটক্যাম্প, মেন্টরিং সেশন এবং আইডিয়া পিচিং প্রতিযোগিতার ওপর মোট ১২টি সেশন হবে। সেখানে তাদের শেখানো হবে—কীভাবে একজন উদ্যোক্তা হবেন, একজন উদ্যোক্তার মানসিকতা প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে টিকে থাকার জন্য কী রকম দরকার। আমাদের ক্লাসগুলো প্রতি শুক্রবার সকাল ১০-১২টা পর্যন্ত হবে। ১২-১৬ বছর বয়সী যেকোনো শিক্ষার্থী রেজিস্ট্রেশন করতে পারবেন। ৬ মাসের প্রোগ্রামটি চলবে চলতি বছরের জুলাই-ডিসেম্বর পর্যন্ত। প্রথম ৩ মাসে মোট ১২টি ক্লাস হবে। বুটক্যাম্প এবং মেন্টরশিপ সুবিধা পুরো মাস পাওয়া যাবে।
জাগো নিউজ: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের শিক্ষক হিসাবে বর্তমান চাকরির বাজারের অস্থিরতা সম্পর্কে আপনার মতামত—ড. রাফিউদ্দিন আহমেদ: আপনি হয়তো জানেন, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এতটাই দুর্বল যে, আমরা বড় হওয়ার পর সবাই চাকরি পাওয়ার জন্য একই দিকে ছুটি। আশ্চর্যের বিষয় হলো—আমাদের দেশে দেড় কোটি বেকার রয়েছেন। শুধু যারা কাজ করেন না; তারা দক্ষতার অভাবে চাকরি ছেড়ে যান, তা নয়। সুতরাং সবাই সরকারি চাকরির পেছনে চলে, যেখানে গৎবাঁধা কাজ ছাড়া আর কিছুই নেই। এ ক্ষেত্রে উদ্যোক্তা হওয়া ছাড়া বিকল্প নেই। যেখানে ৪ বছরের বিবিএ ডিগ্রি কোনো কাজের গ্যারান্টি দেয় না; সেখানে একটি দক্ষতা এক মাসে ২৫-৩০ হাজার টাকা আয় করার উপায় তৈরি করে। দক্ষতা থাকলে সে কখনোই বেকার থাকবে না।
জাগো নিউজ: আপনি আইডিয়া পেয়েছেন অস্ট্রেলিয়া থাকাকালীন, দুই দেশের পরিবেশ তো ভিন্ন—সমন্বয় করলেন কীভাবে?ড. রাফিউদ্দিন আহমেদ: জ্বি, ঠিক বলেছেন। দুই দেশের পরিবেশ ভিন্ন। তারা আমাদের থেকে অনেক উন্নত। এমনকি তাদের শিক্ষা ব্যবস্থাও। তাদের দেশের সবাই উদ্যোক্তা হতে চান। আমাদের দেশের সবাই চাকরির পেছনে দৌড়ান। তাই সেখানে যতটা সহজ ছিল, আমি মনে করি আমাদের এখানেও অনেকটা সহজ হবে। কারণ সবাই বুঝছে, চাকরির পেছনে না ছুটে অন্য কিছু করা দরকার। আমাদের বাচ্চারা তাদের বড় ভাই-বোনদের দেখে এটাই বুঝছে। তাই পরিবেশ ভিন্ন হলেও আশা করি কাজ করা সহজ হবে।
Advertisement
জাগো নিউজ: আপনারা শিশুদের নিয়ে কাজ করছেন। তারা যখন আপনাদের থেকে শিখে কোনো কিছু করার চেষ্টা করবে; তখন কি পাশে থাকবেন?ড. রাফিউদ্দিন আহমেদ: আমরা সব সময় তাদের পাশে থাকব। আমাদের একটি টিম থাকবে। আমাদের এখান থেকে যারা বের হয়ে আইডিয়া নিয়ে কাজ করবেন, তাদের ‘Incubation’ এ রাখবো।
জাগো নিউজ: শহরভিত্তিক আর গ্রামভিত্তিক শিশুদের মানসিক পার্থক্য আছে, তা নিয়ে ভেবেছেন কি? আপনাদের মডিউল কি তা কভার করতে পারবে?ড. রাফিউদ্দিন আহমেদ: হ্যাঁ, আমাদের দেশে এ পার্থক্য অনেক। আমাদের যে মডিউল রয়েছে, তা সবার জন্যই উপকারী হবে। গ্রামভিত্তিক শিশুর জন্য আলাদা চিন্তা রয়েছে। এখন আপাতত কোভিড-১৯ এর জন্য আমরা অনলাইনেই আছি।
জাগো নিউজ: আমাদের দেশের অনেক বাবা-মা মনে করেন পড়াশোনার পাশাপাশি অন্য কিছু করলে পড়াশোনার ক্ষতি হবে—এটি নিয়ে ভেবেছেন কি?ড. রাফিউদ্দিন আহমেদ: যদি কোনো বাচ্চা রাজি থাকে কিন্তু তার বাবা-মা চাচ্ছেন না, তখন আমরা তার পরিবারের সাথে কথা বলবো এ ব্যাপারে। আমরা বিভিন্ন স্কুল-কলেজে যাব, সেখানে ‘parents meeting’ এ তাদের সাথে একটি সেশন করবো। তাছাড়াও বাবা-মাদের নিয়ে কাজ করার জন্য আলাদা পরিকল্পনা আছে।
জাগো নিউজ: যাদের নিয়ে কাজ করবেন, তারা তো বয়োসন্ধিকাল পার করবে। এ সময় মানসিক অবস্থা অনুকূলে থাকে না। একজন উদ্যোক্তা হিসেবে মানসিক শক্তি দরকার—এ নিয়ে কিছু ভেবেছেন?ড. রাফিউদ্দিন আহমেদ: একজন সফল উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য কখনো হার না মানার মানসিকতা থাকতে হয়। আমাদের একটি কাউন্সিলিং সেশন থাকবে। আপনি হয়তো জানেন, মানুষ উদাহরণ পছন্দ করে। তাই আমরা তাদের সমান বয়সী উদ্যোক্তাদের নিয়ে সেশন করবো ফেসবুক লাইভে। এতে অন্য বাচ্চাও তাদের থেকে শিখতে পারবে।
জাগো নিউজ: আপনারা তো দক্ষতা শেখাবেন। কিন্তু তা ব্যবহার করার জন্য কোনো প্লাটফর্মের ব্যবস্থা করবেন কি?ড. রাফিউদ্দিন আহমেদ: অনেক সুন্দর প্রশ্ন—আপনি শুনে খুশি হবেন যে, আমাদের এখান থেকে যারা বের হবে; তারা আয়ের বিভিন্ন পথের সাথে সুপরিচিত থাকবে। ফলে তারা চাইলেই এ স্কিলগুলো ব্যবহার করে হাতখরচ মেটাতে পারবে স্কুলে থাকা অবস্থায়ই। আমাদের ৪ মাসের প্রোগ্রামে ৭-১১ বছরের বাচ্চা এবং ১২-১৬ বছরের বাচ্চা ভর্তি হতে পারবে। আমাদের ওয়েবসাইটে গেলেই আবেদন করা যাবে। এখানে ক্লাস হয় প্রতি শুক্র ও শনিবার।
এসইউ/এএসএম