সাহিত্য

কবি ওমর আলী : ক্যালেন্ডারের বিবর্ণ পাতায় ফোটা লাল ফুল

বঙ্গ রাখাল

Advertisement

কবি হওয়ার বাসনায় ঘুরে ফেরা শহরের অলিগলির আড্ডায় কবি ওমর আলীর নাম প্রথম শুনি। শোনার পর থেকেই তার কবিতা পড়ার আগ্রহ তীব্র হয়। তার কাব্যগ্রন্থের নাম ‘এদেশে শ্যামল রঙ রমণীর সুনাম শুনেছি’। নামের মধ্যেই কবির একধরনের কল্পনার জগৎ নিজের মধ্যে ধাক্কা খায়। একধরনের কম্পন সৃষ্টি হয়। আমিও সেদিন ধাক্কা খেয়েছিলাম। নামেই কবি সার্থক। সে সময়ে হাতের কাছে থাকা কিছু সংকলন এবং সাময়িকীতে কবি ওমর আলীর কবিতা পড়েছিলাম। তার কবিতা পড়লেই নিটোল-নিরেট গ্রামের চিত্র চোখের সামনে দোল খায়। ভাগ্যক্রমে এ সময় আমার শিক্ষক মাহমুদ শাহ কোরেশী স্যারের বাসায় কিছু কাজে গিয়েছিলাম। স্যারের বাসায় গেলেই আমি তার বইয়ের তাকের দিকে তাকিয়ে কী কী বই আছে দেখতে থাকি। দেখতে দেখতে পেয়ে গেলাম ‘ডাকছে সংসার’ নামে কবিতার বইটি।

জীবনের ক্ষয়িত রাজধানীতে আগমন এসব হারানো কবি ওমর আলীর। যিনি প্রকৃতির সন্তান হয়ে জন্মেছেন, জীবনের সাথে যা অবিচ্ছেদ্য হয়ে মিশে আছে। বাংলার জল-কাদার জীবন কী করেই বা থাকতে পারে শহরের এ ইট-পাথরের দানবীয় জীবনে। প্রকৃতিই যেন তাকে ডাকে, তিনি ফিরে যেতে চান নিজের গ্রামে। কারণ তিনি তো গৃহি; সংসার তাকে ডাকছে। এ ঘর-সংসার থেকে বিচ্ছিন্ন জীবন তাঁর কাছে মোটেই জীবন মনে হয়নি। গ্রাম মানেই তো বাংলাদেশ। তাই তো একজন ওমর আলী বলতে পারেন—এখানে শিবরামপুর কোশাখালী গা’র আনোয়ারা রহিমারহাতে কিন্তু গোবরের কণামাত্র নেইফেনায়িত দুধের সুস্বাদ আর সুমিষ্ট ঝর্ণাযুগল হাঁটুতে ধরা মাটির দেনায় সাদা চন্দ্রকিরণ টেনে নামছে যে জনকালো এক গাভীর ওলান থেকে কলিমের বউ সোনাভান...(সবুজ সুনীল মাছরাঙার দেশে)

কবির শহর জীবনের সাথে সাথে তিনি তাঁর গ্রামীণ জীবনের তুলনা করে নিজেকে দেখাতে চেয়েছেন—নিজের সীমাবদ্ধতা রয়েছে কোথায়। এই সংকীর্ণ জীবন নিয়ে তিনি কোনভাবেই শহরে টিকে থাকতে পারছেন না। বারবার মনের গহীনে হাজার প্রশ্ন—গ্রামের স্মৃতিকে তিনি মন্থন করছেন। যেখানে বিস্তৃত মাঠ ছিল—স্মৃতিময় গ্রাম—শহরের এই সংকীর্ণতাকে তার কবিতায় তিনি প্রকাশ করার ভাষা যেন তার কবিতা। কবিতাকে আশ্রয় করেই তিনি পাড়া-পড়শিকে খুঁজে নিতে চান—চলে যেতে চান শিবরামপুরের কোশখালী,বাথরুমে এসে দেখি আমি খুব সীমাবদ্ধতায়ট্যাপের পানির মতো অত্যন্ত দুঃখিত।

Advertisement

অতি সহজ-সরল এবং কথকীয় সুরে বর্ণনা করে যান কবি তার কবিতা। ‘আশ্চর্য পিঠা’ কবিতাটা যেন এক নিশ্বাসে আমরা পড়ে ফেলতে পারি কোথাও কোন ধাক্কা খেতে হয় না। এই কবির অতি সরলীয় বয়ানই যেন কবিকে দিনকে দিন প্রজ্জ্বলিত করে তুলছে। কবি নিজেকে টুকরো টুকরো কাশফুল করে ভাসিয়ে নিয়ে চলেছেন গ্রামীণ কোন এক কৃষকের বাড়ির উঠানে। বিজ্ঞাপন দিচ্ছেন বাড়িতে বাড়িতে কিংবা পাড়ায় পাড়ায় আবার কিছু সময়ের মধ্যেই তিনি নবতরঙ্গে শুরু করছেন জীবনেরই জটিল কথামালার বয়ান—আমার প্রতিটি পিঠা কেমন অক্ষত নক্ষত্রের মতো অমলিনপ্রতিটি পিঠা কলঙ্কহীনএকটাও পোড়েনিএকখানা পিঠাও পোড়েনি এই দ্যাখো...

‘আমি মানুষ, আমি কি বিমর্ষ’—মানুষ নামক জীব আসলেই বিমর্ষতার অধিকারী। আকার ইঙ্গিতে মানুষ হলেও আমরা আসলে তেমন কোন মানুষ না। আমরা সবাই প্যাঁচা। নিজের বিমর্ষতাকে ঢাকতেই যতসব রঙ-তামাশা—সময় সময় এই আমাকে দেখাসময় সময় এই আমাকে আমার কল্পনাসময় সময় এই আমাকে আমার অদ্ভুতচেহারা দেখা।(প্যাঁচা)

কবিকে হয়তো নিঃসর্গের সন্তান বললেও অত্যুক্তি হয় না। কেননা তিনি প্রকৃতিকে যেভাবে আমাদের চোখের সামনে চিত্রায়িত করে তুলেছেন এভাবে হয়তো কেউ তুলতে সক্ষম হননি। জসীম উদদীন কিংবা বন্দে আলীর লেখায় গ্রামীণতার অবায়ব খুঁজে পাওয়া গেলেও এভাবে ছায়াময় নিটোল চিত্র ফুটে ওঠেনি। এ যেন চিত্রশিল্পীর তুলেতে আঁকা ছবির গ্রাম নয় জীবন্ত গ্রাম মূর্ত হয়ে ওঠে। যুবতী উজ্জ্বল বউ হামিদার মাত্র পাঁচ হাত লেপা উঠোনেই/সারারাত ঢেলে পড়ে সমস্ত শুভ্রতা পৃথিবীর। ওমর আলীর এ একধরনের তুলনা নির্ভরতার প্রতীক বলেও ধরে নেওয়া যেতে পারে। কারণ আমরা তার কবিতা অনুধাবনে একটা জিনিস বিশেষভাবে দেখতে পাই যে, তিনি যখনই কোন জিনিসের বর্ণনায়রত; ঠিক তখনই গ্রামীণতা বা আঞ্চলিক জীবন-যাপনকে তুলনা করে আমাদের দুটো জিনিসকে নিজ থেকেই বুঝে নেওয়ার ব্যবস্থা করছেন। যাকে আমরা বলতে পারি, তিনি একজন অনুঘটকের দায়িত্ব পালন করছেন মাত্র। বাবলা জিকের আঠায় যেন গোলাকার মেহেদী পাতা/এঁটে ছিলো... কবির প্রাণোচ্ছল অধিক আবেগী জীবন যেন থামতে জানে না। আপন মনে বলে যেতে পারে নিজের চোখে দেখা কিংবা মনে জমা কিছু কথা ছুঁড়ে দিয়ে জানাতে পারেন নিজের অভিব্যক্তির কথা। শক্তি চট্টোপাধ্যায় কবি বিনয় মজুমদারকে নিয়ে বলেছিলেন, বিনয় গু-মূত্র নিয়েও কবিতা লেখতে পারে। এখানে আমার এই কথার সূত্র ধরেই বলতে ইচ্ছে করছে, ওমর আলী এমন একজন কবি; যিনি যেকোনো বিষয়কেই নিজের কবিতার উপকরণ বানিয়ে কবিতা লিখে ফেলতে পারেন—সবাই যখন লাল তরমুজের মতো গেলাস গেলাস শীতল পৃথিবী পান করে শীতল হচ্ছেআমি শুধু তোমার যৌবন টলটলে আঙ্গুলগুলোএক গোছা কাঁঠালি চাপা থেকে এক গেলাস সুবাসিত শীতল মৃত্যুআমার বৈশেখ জ্যৈষ্ঠ ভরা পিপাসার্ত আঙ্গুলগুলোতে নেবো তুলে...

কবিতার এক মোহময় শক্তি আছে—যা অতি-সহজেই একজন পাঠককে আষ্টেপিষ্ঠে নিজের সাথে সঙ্গী করে নিতে পারে আর শক্তিমান কবি মাত্রই তারা তাদের মন্ত্রবুলির মায়াজালে জড়িয়ে ফেলতে পারেন যেকোনো নারী—হোক সে অন্যের স্ত্রী কিংবা প্রেমিকা। কবির কবিতার প্রেমে পাগল হয়ে ছুটে আসে কবির কাছে। যেমন এসেছে কৃষক বউ ফুলজান, দিলারা বেগম, জবেদা খাতুন, জাহেদা, আনোয়ারা, আনেছা, হাজেরা, সাজু খাতুন, সালেহা, জাহানারা, শাহানারা, রহিমন, করিমন। তাদের প্রেমময় অবয়ব বা চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য কবি তার নিজের কল্পনায় ফুটিয়ে তুলেছেন— হাতখানা রেখে বসেছিলে আমার সামনেঊনিশ বছর আমরা বসেছিলাম মুখে মুখের দিকেঊনিশ বছর তুমি শুধু মিষ্টি হাসতেযেন পান খেয়ে কৃষকের যুবতী স্ত্রী ফুলজানেরকিংবা লিপস্টিকে লাল হতো দিলারা বেগমের ঠোঁট দুটোঊনিশ বছর ধরে সন্ধ্যাবেলার কুসুম পুরের আকাশের মতোভয়ানক লাল হয়ে উঠেছিলো...

Advertisement

ওমর আলীর কবিতায় প্রেম নানাভাবে ধরা দিয়েছে—তিনি তার বহিঃপ্রকাশও ঘটিয়েছেন ভিন্নভাবে। তিনি তার কামনাময় মনকে দমিয়ে রাখতে পারেন না বলেই বলতে পারেন, ঊনিশ বছর ধরে পলাশ ডাঙার একটা লাল ঠোঁট পাখি/আমাকে কামড়াচ্ছে... কবির কবিতায়ই নিজের জীবনের বাস্তবিকতার কথা বলছেন—মরচে খায় লোহা আর সমাজ, সংসার, নারী, দেশ আমাকে খায়... জীবনে যা কিছুই ঘটুক না কেন, তবুও কবি সেসব কিছু মেনে নিয়েই সোনালি সকালের দৃঢ়তা নিয়ে বেঁচে থাকেন। এ কবির জীবন বা কবিতাকে পর্যালোচনা করলে একটা বিষয়ই আমাদের সামনে প্রতীয়মান হয়, তিনি একজন কাদা-জল শরীরে মেখে চলা মানুষ। কোন কপটতা-ভণ্ডামীকে তিনি আশ্রয় করে চলতে জানেন না। তিনি যা কিছুই বলুন না কেন, তা অতি-অনায়াসে সরলবাক্যে বলে দেন। এমনকি তিনি কোন নারীর নিতম্ব, স্তন দেখে কামার্ত হলেও বলে দেন। অন্যের স্ত্রীর স্তন বা নিতম্বে কার না রাত্রির ঘুম হারিয়ে জেগে ওঠে মন। কোন কৃষকের বউয়ের কোমর কিংবা পেটের বর্ণনাও তিনি তাঁর কবিতায় তুলে ধরতে কুণ্ঠাবোধ করেননি। তার কবিতায় নারীর অবয়ব যেন এক অন্যলোকায়ত চিত্র হয়ে আমাদের সামনে উপস্থিত হয়েছে—করিমন জবেদা খাতুন আঁকে নিজেদের শান্তি গেরস্থালীলাল নীল সবুজ সাদা সূতো স্বপ্ন আর স্নেহে অলংকৃত অবসর দিয়েঘামে ভেজা রহিম চেতন মাঝি রহমত কিংবা পেলু কাজীসপ্তাহের সাতটি সূর্যকে তুলে নেয় মুঠোর ভেতরে...(স্বাধীনতা)

কবি ওমর আলীর হৃদয়ের মধ্যে প্রথিত রয়েছে গ্রাম। এই গ্রামের সরলতায় যেন দিনকে দিন তার হৃদয়ের মধ্যে বড় হয়েছে এক মহিরুহ। কিন্তু গ্রামহীন জীবন তিনি মেনে নিতে পারেননি বা এই জীবনের সাথে শহরের জীবনকে তিনি সামঞ্জস্য করতে চাননি। চোখের মধ্যে গ্রামের তৃণলতা কিংবা কৃষকের হাতে খেলা করে ধানের চারা। কী করে ভুলে থাকতে পারেন এ কৃষিজীবী মানুষদের। যাদের চোখ খুললেই তিনি দেখতে পারেন চিরায়িত বাংলার প্রতিচ্ছবি, গ্রামীণ জীবন-যাপনের বাস্তবিক চিত্র; যা আমাদের সবার জীবনেই প্রত্যক্ষমান—আমার চোখের মধ্যে একটি ধানের চারা শুধু জন্ম নিকএকটি কালো ধানের কোমল অশ্রুর ছায়াতলে ফিরে যেতে...একটি পাখির কণ্ঠে ডুব দিয়ে ওপারের কদম ফোটারকাছে যাব কিংবা এই আমের ফুলের গন্ধে ভিজব দাঁড়িয়ে...(দুহাত বাড়ানো ফুলপাতা)

কবির জীবন একরাশ দুঃখকে ধারণ করে চলার জীবন। এ জীবনে থাকে না কোন আফসোস। কবির জীবনে দুঃখ-জরা আছে বলেই তারা এ দুঃখ জাগানিয়া গান গাইতে পারেন। কবি ওমর আলীর জীবনেও দুঃখের অভাব ছিল না। দারিদ্র্যের মধ্যে জীবনাতিপাত করেছেন। শেষজীবনে পথের কাগজ কুড়িয়ে তাতেই লিখে ফেলেছেন কবিতা। জীবন-যাপনের বা কবিজীবনের সব যাপনই কবি ওমর আলী তার জীবন দিয়ে অনুভব করে গেছেন। তবুও এ জীবন মেনেই গেয়েছেন—অবশিষ্ট চোখ দুটো খুব কষ্টে আছে এই কথাজেনে ফেলার পরেও কিভাবে জনসভায় বক্তব্য রাখবে... ভিতরের কষ্ট মুখে কিংবা চোখেই প্রতীয়মান হয়। কোনভাবেই দুঃখকে লুকিয়ে রাখা যায় না। তবুও তিনি ক্ষান্ত হননি, নিজের কাজ আপনমনেই করে গেছেন—বলুক না কিছু লোক পাগল বা অসভ্য কবি—ভেতরে ফাঁপা অনর্থক আধুনিক হাসপাতাল নিষ্প্রাণ ধূর্ত সভ্যতায়রোগ ও অভাবে শোক-সন্তপ্ত মানুষের মতোকোনো চীৎকার কোনো আহত পাখি কিংবা নারীকে বলিনিএখানে এসে বসো... দু’দণ্ড বসো...(এই রকম পীড়িত সংসার)

সংসার নামের জটিলতায় মানুষের জীবন পিষ্ট হলেও সংসার কিন্তু থেমে থাকেনি। চলছে... অল্প অল্প করে জীবনের চাকা গড়িয়ে চলছে মহাকালের দিকে। এই ঝঞ্ঝাময় জীবনে সবকিছু অসহ্য মনে হলেও কবি তার প্রিয়তীকে আগের চেয়ে এখন বেশিই ভালোবাসেন। তবুও ভালোবাসার পরিবর্তে তিনি পেয়ে যান জীবন অপচয়ের মর্মান্তিক ঘাত-প্রতিঘাত—আজকাল তোমাকে আগের চেয়ে বেশি ভাল লাগছেঅথচ এখন তুমি প্রতি দিন ঘণ্টা অন্তর দু’তিন ফোঁটা বিষ আমার ভেতরে মেশাচ্ছে...(এসব পছন্দ অপছন্দ-১)

প্রশ্নবোধক কবিতাও কবি ওমর আলী লিখে পাঠকের ভেতর থেকে উত্তর বের করে আনার চেষ্ট করেছেন অতি সহজ-সরল বর্ণনায়। মানুষের জীবন ধারণের জন্য চাহিদার শেষ নেই। বেঁচে থাকার জন্য প্রতিনিয়ত নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দরকার হয়ে থাকে, যা না পেলে মানুষের বেঁচে থাকাই দুষ্কর। এই যে সাংসারিক নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের অভাববোধ কবিকে দিনকে দিন কম প্রভাবিত করেনি—দয়া নামের লোকটিও আমাদের সাথে যাক শুধু—প্রত্যেকে সদয় হলে তার প্রতি তবেই তো হলো!ভেসে যাচ্ছে মাটি কিংবা আমাদের অনেকেরই পায়েমাটি লেগে আছে অর্থাৎ মাটিও যাচ্ছে আমাদের সাথে!(দয়া)

তীব্র বিদ্রুপাত্মক কবিতার চরণ রয়েছে তার কবিতার মধ্যে। তিনি ব্যঙ্গ করেও সমাজের আসল চেহারা পাঠকের সামনে হাজির করতে চেয়েছেন। নিজের স্বকালকেই যেন কবিতায় ধরার চেষ্টা করেছেন। আসলে এ সামাজিক সমস্যাগুলো চিয়ায়ত। এটা কোন একদিনের সমস্যা নয়। যা এ সমাজ থেকে একদিনে নির্মূল করা সম্ভব।কবির মতো কেঁদে বলি নিঃসঙ্গ পুরুষের আলনা বোজাইনারীর পোষাক আমি দেখিনিঅতএব সে যতো দামেই হোক দুঃখ কিনবে দেবে না ভিক্ষেতাতে কার কি? কোন নারীর কি?(দুঃখ না কিনে)

চিরন্তন কথা, সমাজ বাস্তবতাকে প্রতিস্থাপন করার প্রয়াস পেয়েছেন কবি—সমাজ মানবতা বা বাস্তবতা কবির কবিতার উপকরণ হয়ে বারবার আমাদের সম্মুখে হাজির হয়েছে। মানুষের সীমাহীন দুঃখ তবুও তো মানুষ নিজেকে মৃত্যুর হাতে তুলে দিতে চায় না। নিজে মৃত্যুদূতের সাথে টক্কর করেও বেঁচে থাকার চেষ্টা করতে চায়। তবুও নীলকষ্টের দিন... ওড়ার প্রত্যাশা থাকলেও গরিবিয়ানার মানুষেরা ভাঙা কপোতের মত পড়ে থাকে ধূলিতে—হতাশাগ্রস্ত হয়ে কবি নিরাশায় পথ চলেন—সবকিছুর পরেও কবি সচেতন থেকেছেন এবং সচেতন থাকার জন্য সচেতনবার্তা ছড়িয়েছেন। বলেছেন, এই সব স্বপ্নচারী তবুও বাঁচতে জানে—খুবই কষ্ট নীল দারিদ্র তবু জীবন জীবন তৃষ্ণানুন আনতে ফুরোয় পান্তা তবু শান্তি স্বাধীন সত্তাখুবই কষ্টে পাখা নষ্ট (ভাজ) পায়রা হাট পায়রা এবার শেষ?(পায়রা)

নিজের শেকড়কে যারা ভুলে যায় কিংবা ভোলার জোর প্রয়াস চালিয়ে আভিজাত্যের বাহাদুরিতে নিজেকে জাহির করে; তারা নিজেদেরই সর্বনাশ ডেকে আনে। এ সর্বনাশ তাদের ক্ষণে ক্ষণে ব্যথিত করে, কাঁদায়, দুঃখ দেয়। কিন্তু কবি ভালোবাসেন নিজের গ্রামকে। আলোমাখা মেঠোপথকে। কবির গ্রামীণ জীবনের হৃদয় খোড়া ভালোবাসা প্রকাশ পায়—গ্রামকে আমরা ভুলে গেছি পুকুর ভরা মাছগোয়ালভরা গরু এখানে কি নেই?মনে হয় কতোকাল আমি সবুজ প্রকৃতিকে ভালোবাসিনিগ্রামকে ভালোবাসিনি...(গ্রামে যাইনি)

সেই সাথে তিনি দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ প্রতিটি গ্রামকে সবুজগঞ্জ, কুসুমনগরী বানাবেনই। মানুষের সভ্যতা জ্বলছে খুব কাছে... আকাশে ঝুলে আছে মৃতের খুলীর মতো চাঁদ... শূন্যতাকে তিনি পুণ্যে রূপান্তিত করতে চান। মানুষটি তার সংকল্পে থেকেছেন অটুট। কোনদিন অটুটতাহীন থাকেননি। দৃঢ়তার সাথে সাক্ষাৎকারে বলেছেন, আমিই রবীন্দ্রনাথের পরে একমাত্র কবি যিনি নোবেল পাওয়ার যোগ্যতা রাখি। একজন কবিকে লেখার সাথে সাথে দৃঢ়চিত্তের অধিকারীও হতে হয়। তবে মানুষের ব্যক্তিজীবন নিয়ে যে আমাদের সমাজে দু’চারটা কথা চালাচালি হয় না তা কিন্তু নয়। তবুও মানুষ নামের কবিই তো জীবনকে অতিক্রম করে কবি হয়ে ওঠে। কত মানুষ কত কথা বলেছেন, জীবনে কোন আদর্শ বা কবি কবির জীবন মেনে চলা কি চারটেখানি কথা? সহ্য করে এগিয়ে যেতে হয় নিজের সাধনার পথে। এ পথের আড়েই তো লুকিয়ে থাকে মণিমুক্তা—ক্ষমা করে দিলাম তাকে যে হৃদয় না বলে নিয়ে গিয়ে আর ফিরিয়ে দিয়ে যায়নিক্ষমা করে দিলাম নিষ্ঠুরতার খাঁচাকে এবং খোঁচাকে....(ক্ষমা করে দিলাম)

কষ্টে কেনা আমাদের মাতৃভাষা। এ ভাষার জন্যও প্রাণ দিতে হয়েছে। পথে পথে ব্যারিকেড দিয়ে আটক করা হয়েছে। সোনার ছেলেদের লাশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এখানে সেখানে। তিনি এ ভাষার অধঃপতনকে মেনে নিতে পারেন না। প্রত্যেকটি শব্দের মধ্যেই পাওয়া যায় লাশের গন্ধ, গড়িয়ে চলে রক্তের প্রবাহ। এ কবির কাছে গোলাপের অধঃপতন মানেই যে সভ্যতার অধঃপতন। কল্পনার ধীশক্তিই যেন একজন ওমর আলীকে মহান কবিতে পরিণত করেছে—পথে আর ব্যারিকেড নেই হবে না মাথার খুলি আর ভয়ংকরমাতৃভাষার কাছে চলে যাওয়া এমন সহজ—হয়তো সোনার মতো খেতভরা ফুটে আছে কোথাও সামান্য কাদাপানি...(মাতৃভাষার কাছে)

কবি ওমর আলীর কবিতা মানেই আমাদের গ্রামীণ বাস্তবিক চিত্র। যা কবি অতি সহজ আর সাবলীল বয়ানে উপস্থাপন করে গেছেন। এ যেন সাদা মুখোশের মতো হেসে হেসে আলো দিচ্ছে... তীব্র চিত্রকল্পেও কবির কবিতার কোন তুলনা নেই। চিয়ায়ত প্রতীক এবং রূপকতার মাধ্যমেই যেন কবির নিজস্ব জগৎ সৃষ্টি হয়েছে। যা আমাদের দিনকে দিন আগ্রহের একমাত্র রসদ—শাণিত ধারালো নখের নীচে রক্তাক্ত ছিন্নক্ষত-বিক্ষত একটি চরম পরাজয়ের সাথে...(দেখা হল)

মুক্তিযুদ্ধ আমাদের সব হারানোর পাশাপাশি অর্জনেরও বিষয়। শত্রুর কাছ থেকে ছিনিয়ে এনেছি মা-মাটিকে। এই ৭১ এর মধ্যে লুকিয়ে আছে কত আহাজারি, লাশের গন্ধ কিংবা মায়ের বুকফাটা আর্তচিৎকার। বুকের তাজা রক্তে ভেসে গেছে নদী সাগর সমুদ্র। নিজের কবর নিজেকে দিয়ে খুড়িয়ে করেছে গুলি। সেদিন কবির জীবনেও ঘটেছে নানা বিপর্যয়। চোখের সামনে পুড়িয়ে দিয়েছে কবির ভিটেবাড়ি। এই মানুষ বেঁচে থাকলেও কি আমরা তাকে জীবিত মানুষ বলতে পারি? না তাকে জীবিত কোন আদম বলতে পারি না। সেই কবির তো ৭১ সালেই মৃত্যু হয়েছে। সেই দিনের কথা আমরা ভুলে গেলেও কবি ভুলে যাননি—তোমরা ভুলে যেতে পার আমার সব খোয়ানো সব পোড়ানো/আমি ভুলিনি আমি আজো ভুলিনি উদ্গত অশ্রু অন্তর্গত—আগুনের কথা... তিনি এ ক্ষয়িত জীবনে জ্বলন্ত একাত্তর—তাই চোখে জ্বল জ্বল করে প্রিয় মানুষদের হারানো পরিচিত মুখ—ওরা আমাকে আমার সমস্ত পুড়িয়ে কালো কোরতে আগুন তুলে দেয় আমার হাতে...(এসবের কোনো কিছুর জন্যে)

এই গ্রামীণতার ধারক কবি ওমর আলীর কবিতার পরতে পরতে একধরনের রোমান্টিকতার বাস। যা আমাদের বুঝে নিতে বেগ পেতে হয় না। কিংবা হৃদয় খুড়লে বাল্যের স্মৃতিময়তা বা বয়স্ককালেও তিনি পেছন ফিরে অতীতকে বারবার খুড়ে দেখতে চেয়েছেন। কতটুকু নিজের মধ্যে অতীত বাসা বেঁধে আছে। সেই সাথে তিনি মাতৃভাষা, মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধিকার-স্বাধীনতা, নিসর্গসুখ, কামুকতা, প্রেম-হতাশা বোধ, দৃঢ়প্রতিজ্ঞা, সময়-সচেতন হয়েও অতীতকে হাতড়ে চলার সারাৎসার যেন কবি ওমর আলীর কবিতা। তাই বারবার ছুটতে হয় কবির কবিতার কাছে। যা একরাশ নিসর্গসুখ নিয়ে হাজির হয় আমাদের প্রত্যেকের জীবনে। এ জন্যই কবি দৃঢ়প্রতিজ্ঞতায় বলতে পারেন—ক্যালেন্ডারের বিবর্ণ পাতা ছাপিয়ে একটি ভীষণ সুন্দর লাল ফুল—শুধু ফোটে...

এসইউ/এএসএম