মিরপুরের এস এ খালেককে নিয়ে একটি কৌতুক প্রচলিত আছে। তিনি বারবার দলবদল করেন। কেউ একজন জানতে চাইলো, লিডার আপনি বারবার দলবদল করেন, লোকজন নানান কথা বলে। জবাবে এস এ খালেক বলেছিলেন, আপনারা ভুল করেছেন, আমি তো সরকারি দল করি। আমি দল বদলাই না। সরকার বদল হয় গেলে তো আমার কিছু করার নেই।
Advertisement
তো এই সরকারি দল করা লোকের অভাব নেই বাংলাদেশে। নেতা, উপনেতা, পাতিনেতা, কর্মী, কর্মীর চ্যালা সবাই সরকারি দল করে। গত এক যুগে এই সরকারি দলপন্থীদের বিপুল বিস্তার ঘটেছে। সরকারি দলের আড়ালে রীতিমতো কোণঠাসা আওয়ামী লীগ। এখনকার সরকারি দলের নেতাকর্মীদের সুবিধা হয়েছে। দলবদলের চক্ষুলজ্জাটা তাদের দেখাতে হয় না। কারণ এখন তো সরকারই বদল হয় না। সেই সুবাদে এই সুখের পায়রারা আরামেই আছে, বাকবাকুম করছে। যাদের স্মৃতিশক্তি একটু শক্তিশালী তারা একটু রিওআইন্ড করে পেছনে গেলে দেখতে পাবেন, সরকারি দলপন্থীরা তখনও সরকারি দলই করতো। আওয়ামী লীগাররা এখন ব্যাকবেঞ্চার। ছাত্রলীগের হাজার হাজার ত্যাগী নেতার কোনো রাজনৈতিক পরিচয় নেই, আর সাহেদ-হেলেনারা আওয়ামী লীগের উপ-কমিটিতে জায়গা করে নেন। শুধু সাহেদ-হেলেনা, শেখ হাসিনা যদি নিরপেক্ষ কাউকে দিয়ে উপ-কমিটিগুলো পরীক্ষা করান; দেখবেন সেখানে হাইব্রিডরা কিলবিল করছে। কেন ত্যাগীদের না নিয়ে হাইব্রিডদের উপ-কমিটিতে নেয়া হয়, আওয়ামী মহলে তার একটা কারণ নিয়ে আলোচনা হয়- ত্যাগীরা তো পয়সা দিয়ে কমিটিতে যেতে পারবে না। তাই তাদের ঠাঁই হয় না।
আজকের লেখা অবশ্য শুধু হাইব্রিডদের নিয়ে নয়, হাইব্রিড দোকানদারদের নিয়ে। হাইব্রিডরা সরকারি দলে আসে সুযোগ-সুবিধা পেতে, ধান্ধাবাজি আর চান্দাবাজি করতে। তো একটা দোকান থাকলে এই ধান্ধার ব্যবসাটা করতে সুবিধা হয়। সরকারি নানা সুযোগ-সুবিধা, তদবির-ধান্ধাবাজির জন্য সরকার সমর্থক নানা ভুঁইফোড় সংগঠন গড়ে ওঠে। এটা আগেও হয়েছে, এখনও হচ্ছে। আওয়ামী লীগ টানা প্রায় একযুগ ক্ষমতায় থাকায় ভুঁইফোড় সংগঠনে সয়লাব দেশ।
সংগঠনের নামের শেষে ‘লীগ’ বা নামের শুরুতে ‘বঙ্গবন্ধু’, ‘বঙ্গমাতা’, ‘মুক্তিযুদ্ধ’ ইত্যাদি শব্দ বসিয়ে হরেকরকম সংগঠন বানানো হচ্ছে। নামসর্বস্ব এসব সংগঠনের নেতারা সারাদেশ দাপটে বেড়ায়। এদের নানা কর্মকাণ্ডে মূল আওয়ামী লীগ এবং সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয় দারুণভাবে। রাজনৈতিক মহলে এসব সংগঠনকে বলে ‘দোকান’, আর এদের নেতাদের বলে ‘দোকানদার’। এরা মূলত হাইব্রিড আওয়ামী লীগার, মধুলোভী। ক্ষমতা না থাকলে রাতারাতি হারিয়ে যাবে রাতারাতি ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা এসব সংগঠন।
Advertisement
গঠনতন্ত্র অনুযায়ী আওয়ামী লীগের সাতটি সহযোগী ও তিনটি ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন আছে। সহযোগী সংগঠনগুলো হলো- যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, মহিলা লীগ, যুব মহিলা লীগ, কৃষক লীগ, তাঁতী লীগ ও আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ। ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনগুলো হলো- ছাত্রলীগ, জাতীয় শ্রমিক লীগ ও স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ-স্বাচিপ। এতো গেল সহযোগী সংগঠনের হিসাব, 'অসহযোগী সংগঠন'র কোনো হিসাব নেই। পত্রিকায় অন্তত তিনশ আওয়ামী দোকানের অস্তিত্বের কথা লেখা হয়েছে। তবে নামে যতই ‘লীগ’ থাকুক, এই সাত সংগঠনের বাইরে অন্য কোনো সংগঠনের সাথে আওয়ামী লীগের কোনো আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক নেই। নেতারাও মুখে এটা বলেন বটে, তবে তলে তলে সম্পর্ক ঠিকই থাকে। নইলে এরা বছরের পর বছর করে খাচ্ছে কীভাবে?
হাইব্রিড হও, ধান্ধাবাজি করো: দোকান আছে, চান্দাবাজি করো; অসুবিধা নেই। খালি একটু রাখঢাক করে করো। হেলেনা জাহাঙ্গীর পুরো বিষয়টা প্রকাশ্যে নিয়ে এসেছেন। ‘আওয়ামী চাকরীজীবী লীগ' নামে নতুন দোকান খুলে তাতে জেলা-উপজেলা ও বিদেশী শাখায় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে মনোনয়ন দেয়ার ঘোষণা দেয়া হয়, সাথে দেয়া হয় ফোন নাম্বার। একটু ভাবুন, জেলা-উপজেলা, বিদেশ মিলে কতগুলো কমিটি, কতজন সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক!
আহা চাঁদাবাজির কী বিশাল জাল ফেলেছিলেন হেলেনা জাহাঙ্গীর। বেরসিক সরকার সেখানে বাগড়া দিল। অবশ্য দেশে-বিদেশে চাঁদাবাজির নেটওয়ার্কিংটা হেলেনা জাহাঙ্গীর ভালোই পারেন। তার ভুয়া টিভি 'জয়যাত্রা'য়ও প্রতিনিধিদের নিয়োগ পেতে হয় টাকা দিয়ে, নিউজ সম্প্রচার করতে হলেও টাকা দিতে হয়। তবে এক হেলেনা জাহাঙ্গীর শত-সহস্র আওয়ামী দোকানদারকে বেকাদায় ফেলে দিয়েছেন। আগামী কিছুদিন তাদের একটু টাফটাইম যাবে।
অবস্থা দেখে মনে হয়, এই শতিনেক দোকানকে আওয়ামী লীগ অনুমোদন না দিলেও একধরনের প্রশ্রয় দিয়ে রেখেছে। নইলে তারা বছরের পর বছর কীভাবে সরকারি দলের নাম বেঁচে দুই নাম্বারি করে যাচ্ছে। একজন হেলেনা জাহাঙ্গীরকে ধরতে একযুগ লেগেছে। এক দোকানদার কারাগারে গেলেও সহস্র দোকানদার এখনও আছে দেশে। হেলেনা একটু বেশি বাড়াবাড়ি করেছিল বলে ধরা খেয়েছেন, আগে-পরে আর কোনো দোকানদারকে ঝামেলায় পড়তে হয়নি।
Advertisement
এর আগে ওলামা লীগ সরাসরি আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক আদর্শের বিপক্ষে অবস্থান নেয়ায় কিছুটা হইচই হয়েছিল। তখনও আওয়ামী লীগ মুখে অনেক বিপ্লব করেছেন- এরা আওয়ামী লীগের কেউ নয়, এদের সাথে দলের কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয়নি। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়। আওয়ামী লীগের নাম বেচে দোকান চলছে। কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয় না। কেন?
আওয়ামী মহলে দুটি জবাব আছে। এক. এই হাইব্রিড ও হাইব্রিড দোকানদারদের ধান্ধার ভাগ নিশ্চয়ই কেউ না কেউ পান। দুই. ঠগ বাছতে গা উজাড় হয়ে যাবে। যতই উজাড় হোক, ঠগগুলোকে বাছতেই হবে। আগাছা না কাটলে গাছ হয় না। ’৭৫-এর পর যেহেতু আওয়ামী লীগ টিকে ছিল, এখন এই ঠগ হাইব্রিড আর দোকানদারদের ছাড়াও আওয়ামী লীগ টিকতে পারবে।২ আগস্ট, ২০২১
লেখক : বার্তাপ্রধান এটিএন নিউজ।
এইচআর/জিকেএস