শরীরের ত্বক, চোখের সাদা অংশ কিংবা মিউকাস ঝিল্লি হলুদাভ বর্ণ ধারণ করাকেই বলা হয় জন্ডিস। অনেকেই হেপাটাইটিস এবং জন্ডিসকে এক ভেবে থাকেন। আসলে জন্ডিসের একটি কারণ হলো হেপাটাইটিস এবং হেপাটাইটিস ছাড়াও অন্যান্য বিভিন্ন কারণে একজন ব্যক্তির জন্ডিস হতে পারে।
Advertisement
প্রাপ্তবয়স্কদের মতো নবজাতকরাও বিভিন্ন কারণে জন্ডিসে আক্রান্ত হতে পারে। জন্ডিসে আক্রান্ত হলে শিশুর হাতের তালু হলুদ হয়ে যেতে পারে। সাধারণত শিশুর মুখ, হাত ও বুক বা পেটের ওপর পর্যন্ত হলুদ হতে দেখা যায়। পাশাপাশি জন্ডিসে আক্রান্ত নবজাতকের মলের রং সবুজ হতে পারে।
শিশুর শরীরের রং পরিবর্তিত হতে দেখলে রক্তে বিলিরুবিনের মাত্রা পরীক্ষা করে দেখে নবজাতকের শরীরে জন্ডিসের উপস্থিতি নিশ্চিত করা যায়। ৬০ শতাংশ পূর্ণ গর্ভকাল বা টার্ম নবজাতকের এবং ৮০ শতাংশ প্রি-টার্ম অর্থাৎ অকালজাত নবজাতকের মধ্যে জন্মের প্রথম সপ্তাহেই জন্ডিস দেখা যায়।
কম ওজনে ভূমিষ্ঠ শিশু বা সময়ের আগে জন্ম নেওয়া শিশুরাই জন্ডিসে আক্রান্ত হয় বেশি। প্রায় ৫০ শতাংশ ক্ষেত্রে এটি স্বাভাবিক জন্ডিস বাফিজিওলজিক্যাল জন্ডিস অর্থাৎ নির্দোষ জন্ডিস। জন্মের পর শিশুর যকৃৎ পুরোপুরি কর্মক্ষম হয়ে উঠতে একটু দেরি হলে রক্তে বিলিরুবিনের মাত্রা বেড়ে গিয়ে এই জন্ডিস জন্ডিস দেখা দেয়।
Advertisement
এ ছাড়াও বেশ উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নবজাতক জন্মের পর প্যাথোলজিক্যাল জন্ডিসেও আক্রান্ত হয়ে থাকে। মায়ের রক্তের গ্রুপ নেগেটিভ এবং শিশুর রক্তের গ্রুপ পজেটিভ হলে কিংবা গর্ভাবস্থায় মায়ের কোনো সংক্রমণের ইতিহাস থাকলেও শিশুর জন্ডিস হতে পারে।
এ ছাড়াও শিশু জন্মগত কোনো রোগে আক্রান্ত হলে বা জন্মগতভাবে শিশুর যকৃৎ বা পিত্তথলিতে কোনো সমস্যা থাকলে কিংবা জন্মের পর শিশুর রক্তে সংক্রমণ বা সেপটিসেমিয়াহলে আক্রান্ত নবজাতকের প্যাথোলজিক্যাল জন্ডিস হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
ফিজিওলজিক্যাল জন্ডিসের কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে। শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার ২৪ ঘণ্টা পর এই জন্ডিস শুরু হয়। টার্ম নবজাতকের ৩-৫ দিন বয়সে এবং প্রি-টার্ম নবজাতকের ৫-৭ দিনের মধ্যে এ ধরনের জন্ডিসের তীব্রতা বেশি বৃদ্ধি পায়। নবজাতকের ২ সপ্তাহ বয়সের মধ্যেই সচরাচর এটি সেরে যায়।
এ জাতীয় জন্ডিসে রক্তে বিলিরুবিন মাত্রা ১৫ মি. গ্রাম/ডেসিলিটারের নিচে থাকে। এটা এক ধরনের সাময়িক জন্ডিস এবং এর প্রতিকারে কোনো বিশেষ চিকিৎসার প্রয়োজন নেই। নবজাতকের জন্ডিস হকে অনেক মা শিশুকে স্তন্যদান থেকে বিরত থাকেন। তবে কোনো অবস্থায়ই নবজাতককে বুকের দুধ খাওয়ানো থেকে বিরত রাখা যাবে না।
Advertisement
শিশুকে নিয়মিত ২-৩ ঘণ্টা পর পর বুকের দুধ খাওয়াতে হবে। কারণ বিশেষত ফিজিওলজিক্যাল বা স্বাভাবিক জন্ডিসের মূল চিকিৎসাই হচ্ছে শিশুকে ঠিকমতো বুকের দুধ খাওয়ানো। রক্তে বিলিরুবিনের মাত্রা বেড়ে গেলে শিশুকে ফটোথেরাপি বা আলোক চিকিৎসা দেওয়া যায়।
এর উপকারিতা ও কার্যকারিতা নিয়ে মতভেদ থাকলেও এখনো পর্যন্ত এই পদ্ধতি ব্যবহার করা হচ্ছে। এ ছাড়া প্রতিদিন সকালে নবজাতককে আধা ঘণ্টা করে রোদ পোহাতেও পরামর্শ দেওয়া হয়। তবে এর চেয়ে বেশি সময় শিশুকে রোদে না রাখাই ভালো। কারণ সূর্যের কড়া রোদ ও অতিবেগুনি রশ্মি শিশুর ত্বকের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।
নবজাতকের জন্ডিসের ৩৫-৪০ শতাংশ ক্ষেত্রে তা প্যাথোলজিক্যাল বা ঝুঁকিপূর্ণ জন্ডিস হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। প্যাথোলজিক্যাল জন্ডিস নবজাতক ভূমিষ্ঠ হওয়ার প্রথম ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই দেখা দেয় এবং এক্ষেত্রে রক্তে বিলিরুবিনের মাত্রা ১৫ মি. গ্রাম/ডেসিলিটারের বেশি থাকে। এ ধরণের জন্ডিস নবজাতকের ২ সপ্তাহ বয়সের পরও শরীরে বিদ্যমান থাকে।
অন্যদিকে রক্তের বিলিরুবিনের মাত্রা যদি ০.৫ মি. গ্রাম/ডেসিলিটার/প্রতি ঘণ্টায় বাড়তে থাকে বা ২৫ মি. গ্রাম/ডেসিলিটারের বেশি হয়; তবে তা বিপজ্জনক বলে ধারণা করা যেতে পারে।
শিশু খাওয়া বন্ধ করে দিলে বা কমিয়ে দিলে, জ্বর বা সংক্রমণের লক্ষণ থাকলে কিংবা রক্তে বিলিরুবিনের মাত্রা দ্রুত বাড়তে থাকলে অবশ্যই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে৷
এ ছাড়াও যেসব নবজাতক উচ্চমাত্রার জন্ডিসে আক্রান্ত ছিলো, পরবর্তী জীবনে তাদের শ্রবণশক্তি ও বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশ ঘটছে কি-না সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
জেএমএস/জেআইএম