ভ্রমণ

মুহূর্তেই যেভাবে ধ্বংস হয়েছিল বিশাল এক সভ্যতা

হরপ্পা সভ্যতার কথা কমবেশি সবারই জানা আছে। যা সিন্ধু সভ্যতা নামেও পরিচিত। আকস্মিকভাবে এই সভ্যতার পতন ঘটেছিল। যা ইতিহাসে আজও স্মরণীয় হয়ে আছে। পাঞ্জাব ও সিন্ধু অঞ্চলের সিন্ধু নদ উপত্যকায় ২৬০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ নাগাদ সিন্ধু সভ্যতার শ্রেষ্ঠ দু’টি শহর হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারো গড়ে ওঠে।

Advertisement

এক সুপরিকল্পিত ও উন্নত নগর গড়ে ওঠে। সেখানকার অধিকাংশ রাস্তাই সরল ও সমান্তরাল। আধুনিক ও উন্নত এই শহরের রাস্তার ধারে ছিল বাঁধানো ফুটপাত, বাড়ির নোংরা পানি বের করার জন্য ছিল পয়ঃপ্রণালী, রাস্তার ধারে ল্যাম্পপোস্টও অবস্থিত ছিল।

অধ্যাপক এ. এল. বাসামের মতে, রোমান সভ্যতার আগে অন্য কোনো সভ্যতায় এত উন্নত মানের পয়ঃপ্রণালী ব্যবস্থা ছিল না। গবেষক ডি. ডি. কোশাম্বি মনে করেন, উন্নত পয়ঃপ্রণালী ব্যবস্থাই হরপ্পাকে মেসোপটেমিয়ার সভ্যতা থেকে পৃথক করেছে।

সিন্ধুবাসী কাঠের তৈরি দরজা ব্যবহার করত। তবে জানালার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। দেওয়ালের উপরে ছিদ্র দিয়ে আলো-বাতাস প্রবেশের ব্যবস্থা ছিল। প্রত্যেক বাড়িতে রান্নাঘর ও উঠনের জন্য স্থান সংরক্ষিত ছিল। শহরের গরিব ও খেটে-খাওয়া মানুষ ছোটো ছোটো অস্বাস্থ্যকর কুঁড়েঘরে বাস করত। এইসব এলাকা ছিল বস্তিতুল্য। নগর পরিকল্পনা থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় শহরবাসীর মধ্যে ব্যপক ধনবৈষম্য ছিল।

Advertisement

আধুনিক বিশাল এই শহরে তখন বসবাস করত প্রায় সাড়ে ২৩ হাজার মানুষ। হরপ্পা সভ্যতায় সামাজিক বিভাজন ছিল বিদ্যমান। বাসিন্দারা নাগরিক জীবনের সঙ্গে মানানসই সুন্দর পোশাক ও অলঙ্কার ব্যবহার করত। নাচ, গান, শিকার প্রভৃতি ছিল নাগরিক জীবনের প্রধান বিনোদন মাধ্যম।

এই সভ্যতার বহু মানুষ শহুরে পেশা, যেমন- শিল্পকর্ম, বাণিজ্য প্রভৃতির সঙ্গে যুক্ত ছিল। তবে কৃষি এবং পশুপালনের সঙ্গেও বহু মানুষ যুক্ত ছিল। হরপ্পার নগরজীবন সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালিত করার উদ্দেশ্যে সেখানকার নাগরিকগণ কেন্দ্রীভূত নগর বা পৌরপ্রশাসন গড়ে তুলেছিলেন বলে ঐতিহাসিকগণ মনে করেন।

হরপ্পা বা সিন্ধু সভ্যতার মানুষেরা মূর্তিপূজা করত। তারা বিভিন্ন প্রাকৃতিক শক্তির আরধনা করত বলে ঐতিহাসিকগণ মনে করেন। তখন মাতৃমূর্তির পূজা জনপ্রিয় ছিল। সবই ঠিকঠাক ছিল। তবে হঠাৎই বিশাল এই সভ্যতার পতন ঘটে।

কীভাবে পতন ঘটেছিল?

Advertisement

গবেষণা থেকে জানা যায়, সিন্ধু উপত্যকার নিকটবর্তী অঞ্চলে ভূমিকম্পের উৎসস্থল ছিল। খননকার্যের ফলে প্রাপ্ত, সৎকারের নমুনা না থাকা ক্ষতবিক্ষত নরকঙ্কালগুলো থেকে এ ধারণা করা হয় যে, ভূমিকম্পের ফলে এই সভ্যতার বিনাশ ঘটে।

আবার অনেক ইতিহাসবিদের মতে, হরপ্পা সভ্যতা ধ্বংস হওয়ার কারণ হলো প্রাকৃতিক দুর্যোগ। ভূ-প্রকৃতির পরিবর্তনের ফলে ক্রমে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমে যায়। ফলে সিন্ধু অঞ্চলে মরুভূমির সূচনা ঘটে। ভূস্তরের নীচের জল ক্রমশ নিঃশেষ হয়ে পড়লে কৃষি-উৎপাদন অত্যন্ত কমে যায় এবং খাদ্যাভাব তীব্রতর হয়।

আবার অনেকের মতে, বন্যা ও প্লাবন সিন্ধু সভ্যতার বিনাশ ঘটিয়েছিল। সিল্ধুবাসীরা নদীতে বাঁধ দিয়ে চাষাবাদ করত। ফলে সিন্ধু নদের পানি অবরুদ্ধ হয়ে পলি জমে নদীগর্ভের উচ্চতা বৃদ্ধি পায়। ফলে প্রতি বর্ষাতেই নদীর জল দুই কূল ছাপিয়ে নগরগুলোকে প্লাবিত করতে থাকে| প্লাবনের কারণেই এই সভ্যতা ভেসে যায়।

জানা যায়, আনুমানিক ১৭৫০ খ্রিষ্ট পূর্ব নাগাদ হরপ্পা সভ্যতার অবলুপ্তির সূচনা ঘটে। পরবর্তী ১০০ বা ১৫০ বছরের মধ্যে সমগ্র হরপ্পা সভ্যতার সম্পূর্ণ অবলুপ্তি ঘটে। এই অবলুপ্তির প্রকৃত কারণ নিয়ে মতভেদ থাকলেও অধিকাংশ ঐতিহাসিক এই সভ্যতার পতনের সুনির্দিষ্ট কিছু কারণের ওপর জোর দিয়েছেন।

সিন্ধু বা হরপ্পা সভ্যতা কীভাবে ধ্বংস হল তা নিয়ে আজও গবেষণা চলছে। অধুনা উপগ্রহের মাধ্যমে ভূত্বকের ছবি তুলে এই সভ্যতার বিলুপ্তির প্রকৃত কারণ সম্বন্ধে অনুসন্ধান চলছে। ব্রিটিশ বিশেষজ্ঞ বৈনই পৈসার-এর মতে, সিন্ধু উপত্যকা অঞ্চলে মহাজাগতিক বিস্ফোরণে অথবা ধুমকেতুর ধাক্কায় জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটেছিল।

হরপ্পা সভ্যতার নিদর্শন

১৯২২ খ্রিস্টাব্দে বাঙালি প্রত্নতত্ত্ববিদ রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় তাম্র-প্রস্তর যুগের সভ্যতার সবচেয়ে উন্নত নিদর্শন আবিষ্কার করেন। তিনি জন মার্শালের তত্ত্বাবধানে সিন্ধু প্রদেশের লারকানা জেলায় মহেন-জো-দরোতে মাটি খুঁড়ে বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন আবিষ্কার করা হয়। প্রায় একই সময়ে দয়ারাম সাহানি পাঞ্জাবের মন্টগোমারি জেলার হরপ্পায় এই সভ্যতার নিদর্শন আবিষ্কার করেন।

পরবর্তীকালে মার্টিমার হুইলার, রফিক মুঘল, ম্যাকে, রেইকস্, দিলীপকুমার চক্রবর্তী প্রভৃতি সিন্ধু সভ্যতার উপর ব্যাপক গবেষণা চালান। বর্তমানে মহেঞ্জোদারো, কালিবঙ্গান, কোটডিজি, বনোয়ালি, লোথাল, ধোলিবিরা প্রভৃতি নানা স্থানে এই সভ্যতার নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে।

প্রত্নতাত্ত্বিকরা আগুনে পোড়ানো ইট দিয়ে তৈরি বহুতল বিশিষ্ট অনেক ঘর-বাড়ির অবশিষ্টাংশও পেয়েছেন এই সভ্যতায়। মহেঞ্জোদারোতে একটি স্নানাগার এবং হরপ্পায় একটি শস্যাগার পাওয়া গেছে প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানের মাধ্যমে। পৃথিবীর আর কোথাও এত বড়ো স্নানাগার আবিষ্কৃত হয়নি।

সিন্ধু সভ্যতার অসংখ্য কেন্দ্র আবিষ্কৃত হলেও শহর বলতে অবশ্য মাত্র ৫-৬টি বোঝায়। তবে কোনো লিখিত তথ্য না পাওয়ায় এর রাজনৈতিক ইতিহাস কিছুই জানা যায়নি আজও। সিন্ধুলিপির পাঠোদ্ধার আজও সম্ভব হয়নি বলে এর ধ্বংসাবশেষ থেকেই এর পরিচয় পাওয়া যায়।

সিন্ধু জনগণ পাথর ও তামা উভয়েরই ব্যবহার জানত। এই সভ্যতা কারা নির্মাণ করেছিল তা আজও রহস্যাবৃত। সম্ভবত ভারতীয়রাই এই সভ্যতার জন্ম দিয়েছিল। এই প্রাচীন সভ্যতার সময়সীমা সম্ভবত খ্রিস্টপূব ২৫০০-১৫০০ অব্দ পর্যন্ত স্থায়ী ছিল বলে ইতিহাসে উল্লেখ আছে।

জেএমএস/জেআইএম