শিক্ষকদের ১৩তম গ্রেডে সিনিয়র ও প্রশিক্ষিত শিক্ষকের বেতন কমে যাচ্ছে। সত্যই কি শিক্ষকের বেতন না বেড়ে কমে যাচ্ছে? একদম ঠিক, নতুন স্কেলে বেতন কারো কারো কমে যাচ্ছে। যারা সিনিয়র শিক্ষক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের, বিশেষ করে যারা ট্রেনিংপ্রাপ্ত, তাদের বেতন কমে যাচ্ছে। কারণ ফিক্সেশনের নিয়ম অনুযায়ী এটা হচ্ছে।
Advertisement
২০২০-এর ৯ ফেব্রুয়ারি ১৩তম গ্রেডে বেতন দেবার সিদ্ধান্ত জানিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। সেই থেকে ওই মন্ত্রণালয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন ফিক্স করার কাজ করছেন, কিন্তু পেরে উঠছেন না। সমস্যা দেখা দিচ্ছে নতুন আর পুরোনো শিক্ষকদের বেতন নিয়ে। চাকরিবিধি বিএসআর ৪২ (১), (২), ধারা অনুয়ায়ী বেতন উচ্চতর গ্রেডে হলেও ধাপে না মেলায় নিচের ধাপে বেতন নির্ধারণ করা হয়। এর ফলে শিক্ষকদের মূল বেতন এক টাকাও না বেড়ে কমে যায়। এই ফিক্সেশন সমস্যা এখন বলতে গেলে প্রকট। ধারণা করি গত দেড় বছর ধরে ওই কাজ নিয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় হিমশিম খাচ্ছে। এ-সমস্যার সমাধান আজো হচ্ছে না।
আমার ধারণা হলো এই সমস্যার মূলে আছে দুটি বিষয়। এক. প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক ও প্রশিক্ষণবিহীন শিক্ষক। দুই. চাকরিবিধান। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগের পর তাদের প্রশিক্ষণে পাঠানোর নিয়ম। কিন্তু তাদের প্রশিক্ষিত করে তুলতে স্কুলিং সংকটের কারণে সবাইকে সেখানে যায় না। এ-ভাবে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অপ্রশিক্ষিত শিক্ষকদের সংখ্যা বেড়ে যায়। তারা প্রশিক্ষণ না নিয়েই পেশায় থাকছেন। এখন, ওই প্রশিক্ষিত শিক্ষক ও প্রশিক্ষণবিহীন শিক্ষকের গড় ৬০/৪০এর মতো। সিনিয়র ও প্রশিক্ষিত শিক্ষকদের বেতন নতুন ১৩তম গ্রেডে ফিক্স করতে গেলে এই সমস্যাটি ধরা পড়ে।
এর মাধখানে সরকার আরো একটি সিদ্ধান্ত নিয়ে তা কার্যকর করেছে। তাহলে উচ্চতর গ্রেডে বেতন হবার সুবাদে ‘প্রশিক্ষণ গ্রেড বা স্তরটি উঠিয়ে দেওয়া হয়। এর ফলে সিনিয়র ও প্রশিক্ষিত শিক্ষকগণের বেতন ফিক্সেশন বিপাকে পড়ে। চাকরিবিধি অনুযায়ী ‘ধাপে’ মেলে না বিধানের ফলে নিচের ধাপে তাদের বেতন ফিক্সেশন করার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। গোলটা বেঁধেছে এখানেই। সিনিয়র ও প্রশিক্ষিত শিক্ষকদের বেতন কেন উপরের ধাপে ফিক্স না করে নিচের ধাপে ফিক্স করার বিধান রাখা হলো? তারা তো সিনিয়র এবং প্রশিক্ষিত শিক্ষক। এটা মনে রেখে কেন তাদেও বেতন উপরের ধাপে ফিক্স না কওে নিচের ধাপের এনে ফিক্স করার বিধান রচিত হয়েছে?
Advertisement
যখন দেখা গেলো নিচের ধাপে ফিক্স করতে গেলো বেতন কমে যাচ্ছে, তখন উপরের ধাপে তাদের তুলে দেয়ার বিধান করা হয়নি কেন? সেটা করা হলে আজ আর বেতন ফিক্সেশন সংকট থাকতো না। চাকরি বিধি যারা তৈরি করেছেন, তারা কি সংকট তৈরি করার জন্যই এটা করেছেন নাকি সংকট থেকে শিক্ষকদের মুক্তি দেবার জন্য? প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা যে জাতির মেরুদণ্ড নির্মাতা, সেটা কি চাকরিবিধি তৈরিকারীরা মনে রাখেননি। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ‘কম শিক্ষিত, কম জ্ঞানী, তাই কি তাদের বেতন এতোটা কম, যা ১৩তম গ্রেডে উন্নীত করার চিন্তার সাথে তাদের [বিশেষ যোগ্যতা ] প্রশিক্ষণের দক্ষতাকে তুলে দেয়া হলো। ফলে প্রশিক্ষিত ও অপ্রশিক্ষিত শিক্ষক একই সরণীতে এসে মিলিত হলেন। [অতিরিক্ত সচিব আর সচিব কি একই স্তরের, নাকি একই মর্যাদার, তাদের বেতন কাঠামো কি একস্তরের?]
যারা বেতনবিধি তৈরি করেছেন তাদের মূল্যবান মগজ খাটিয়ে, এটা যে বৈষম্যময় হয়ে উঠেছে, তা কি একবারও তাদের মনে হয়নি? যে সংকটটি তারা সৃজন করেছেন, তা দূর করবেন কেমন করে সেটা নিয়ে আগে ভাবুন। কারণ বেতন সরকার দেন। আর সরকারের অর্থ জনগণের। জনগণের ছেলেমেয়েদের যারা পড়ান তারা জাতীয় স্তরের ‘মানুষ’ নির্মাতা। এই মানুষ নির্মাতা জাতির ব্যাকবোন। শিরদাঁড়া শক্ত-পোক্ত করে গড়ে তুলবেন যারা সেই সব শিক্ষকদের সামান্য বেতন দিয়ে কি তা সম্ভব?
বাংলাদেশে প্রাথমিক বিদ্যালয় সরকারি খাতায় ৬৫ হাজার ৬২০টি। আর প্রশিক্ষিত ও অপ্রশিক্ষিত শিক্ষকের সংখ্যা ৩ লাখ ৫২ হাজার। এর বাইরে দেশে কি আর কোনোরকম প্রাইমারি স্কুল নেই? এটা আমাদের প্রশ্নই কেবল নয়, যে সব শিশু-কিশোর বিভিন্ন ‘এনজিও’র প্রাইমারি স্কুলে পড়াশোনো করছে, তাদের শিক্ষকরা কি এই হিসাবের মধ্যে পড়ে? নাকি তারা বাইরে? সত্যই আমরা জানি না।
আমরা জানি, দেশে ৮৫ হাজার গ্রাম আছে। আগে জানতাম গ্রামের সংখ্যা ৬৮ হাজার। এখন তা বেড়েছে। ৬৫ হাজার ৬২০টি স্কুলে ৩ লাখ ৫২ হাজার শিক্ষক কি সমগ্র দেশের শিশুদের শিক্ষা দিতে পারছে? বা পারে? না ,পারে না। আরো ২৫ হাজার গ্রামে কোনো প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই। তাহলে ওই সব স্কুলবিহীন গ্রামগুলোর শিশু-কিশোরদের শিক্ষার দায় কে পালন করছে? ওই সব গ্রামে যদি প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকতো তাহলে অন্তত পক্ষে আরো এক লাখ মানুষের শিক্ষকতার চাকরি মিলতো। কমে আসতো ওই পরিমাণ বেকারত্বের সংখ্যা।
Advertisement
আমার নিজস্ব একটি ভাবনা আছে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকদের নিয়ে। তাহলো : শিক্ষকরা যখন জাতির মেরুদন্ড নির্মাতা হন, তাই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সবচেয়ে [উচ্চশিক্ষিত ও ডিগ্রিধারী ] শিক্ষিত ও ডিগ্রিধারীদের ওই গ্রামীণ স্তরের স্কুলে নিয়োগ দেয়া হোক। তাদের বেতন কাঠামো দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা যে বেতনকাঠামোর অন্তর্গত, তাদের বেতনও হবে সেই অনুযায়ী। আপনারা ভাবছেন, উচ্চশিক্ষিত যুবকেরা কেন যাবে ওই চাকরিতে। তারা কি বেকার পড়ে থাকবে? এই সিস্টেমটা চালু হবে না, কারণ যারা সরকারের এ-সব চাকরিতে নিয়োজিত তারা ভাববেন, প্রাইমারি স্কুলের একজন ‘সামান্য শিক্ষক’ তার পদমর্যাদার সমান হবে, এটা মেনে নেয়া যায় না। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক সামান্যজন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই, কিন্তু সেই সামান্য শিক্ষকের কাছেই কিন্তু আজকের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী-মিনিস্টার, এমপি, ব্যবসায়ী, শিল্পপতিগণ জীবনের প্রথম অক্ষর-জ্ঞান পেয়েছেন।
আমরা জানি আমাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকদের জ্ঞানের অনেক সীমাবদ্ধতা আছে, তারপরও তাদেরই কড়ে আঙুল ধরে আজকের জ্ঞানীরা উঠে এসেছেন আলোকিত পৃথিবীর বিশাল মঞ্চে। জাতিকে পশ্চাৎপদতার অন্ধকার থেকে প্রকৃত জ্ঞানের আলোতে নিয়ে আসতে হলে ওই মৌলিক স্তরে শিক্ষক হতে হবে সব থেকে উচ্চশিক্ষিত মানুষদের। সেক্রেটারি স্তরের বেতনভাতা পেলে দশ লাখ যোগ্য মানুষ পাওয়া যাবে, যারা দেশের মেরুদণ্ড নির্মাতার দায়িত্ব নিয়ে গ্রামে যাবে। শিক্ষা ক্ষেত্রে গ্রাম ও মহানগরের বেতনের ফারাক ঘুঁচে গেলে গ্রামোন্নয়নের গতি বেড়ে যাবে অনেকগুণ, যা আমরা এখনও অনুমান করতে পারছি না। কারণ, আমরা এক ভোগবাদী অন্ধ শিক্ষা কাঠামোর উল্টোরথে চড়ে বসে আছি। আমাদের ভাবনার গাড়িটাকে গ্রামের দিকে চালিত করতে হবে। তা নাহলে বৈষম্য ও বেকারত্ব যেমন কাটবে না, তেমনি আমাদের সৃষ্টিশীলতাও পাবে না নতুন গতি-পথ।
লেখক : কবি, চিন্তক ; সাবেক অ্যাসোসিয়েট এডিটর, যুগান্তর, ঢাকা।
এইচআর/এমকেএইচ