বিশেষ প্রতিবেদন

স্বীকৃতি চান বীরাঙ্গনা নূরজাহান

১৯৭১ সাল। বয়স মাত্র ১৩। কিশোরী হলেও আমাকে রেহাই দেয়নি নরপশু রাজাকাররা। মা ও ছোট ভাইকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল তারা। আর আমাকে তুলে দিয়েছিল অবাঙালি বিহারীদের হাতে। একটি বন্ধ ঘরে রেখে রাতের পরে রাত নির্যাতন চালায়। দিনে দু-এক বেলা খাবার দিত। প্রায় দুই মাস অমানবিক নির্যাতন সইতে হয়েছে আমাকে।তিনি আরও বলেন, ওখানে শুধু আমিই না আমার মতো আরও ১০/১২ জনকে সে সময় আটকে রেখে নির্যাতন করা হয়েছিল। তার মধ্যে দুইজন মারাও যায়। যারা বেঁচে ছিলাম তারা সব সময় উপরওয়ালাকে ডাকতাম তুমি কবে এই নরপশুদের হাত থেকে আমাদের রক্ষা করবে। উপরওয়ালা হয়তো আমাদের কথা শুনেছেন। মুক্তিযোদ্ধারা জীবন বাজি রেখে সংগ্রাম করে হায়েনাদের পরাজিত করে এবং আমাদের উদ্ধার করে। এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন বীরাঙ্গনা নূরজাহান বেগম। যিনি বালিয়াকান্দি উপজেলার নবাবপুর ইউনিয়নের সোনাপুর গ্রামের বাসিন্দা।তিনি আরও বলেন, মুক্তিযোদ্ধারা আমাকে উদ্ধার করে বাড়িতে পৌঁছে দেয়ার পর শুরু হয় আরেক জীবন যুদ্ধ। টানা এক মাস চিকিৎসা নিতে হয় আমাকে। সুস্থ হওয়ার পর বুঝতে পারি আমি যেন কোনো জন্তু। প্রতিবেশীরা সামনে কিছু না বললেও লুকিয়ে লুকিয়ে আমাকে দেখতো এবং আলোচনা-সমালোচনা করতো। এজন্য অনেক সময় মনে করতাম পৃথিবী ছেড়ে চলে যাই কিন্তু আমার বৃদ্ধা মার কথা চিন্তা করে সব ভুলে যেতাম। আমাকে নিয়ে পরিবারের সবাই চিন্তা করতো কি হবে আমার ভবিষৎ।যুদ্ধের দুই বছর পর মাগুরা জেলার শ্রীপুর উপজেলার চৌগাছির মোকাররম মোল্লার সঙ্গে বিয়ে হয়। কিন্তু আমার বিষয়ে জানতে পেরে শ্বশুর বাড়ির লোকজন এ বিয়ে মেনে নেয়নি। তাই আমার স্বামীর বাড়িতে থেকে সংসার করার সুযোগ হলো না। তবে আমার স্বামী তার বাড়ি ছেড়ে চলে আসে আমাদের বাড়িতে। সেই থেকে শুরু জীবন নামের সংসার।মা মারা যাওয়ার পর ভাইয়ের দেয়া ১২ শতাংশ জমিতে এক ছেলে ও চার মেয়ে নিয়ে কোনো রকমে ঘর করে বসবাস করছি। সেই সঙ্গে আমার পিছু নিয়েছে নানা অসুখ। একটি ছেলে হলেও একটু ভাল থাকার জন্য ভাইয়ের সহযোগিতায় পাঠিয়েছি বিদেশ এবং ৪ মেয়েকেই বিয়ে দিয়েছি। দেশের জন্য আমার সবকিছু দিয়েছি। শুনেছি ও পেয়েছি মানুষের গঞ্জনা ও লাঞ্চনা। তিনি আরও বলেন, আজও আমি স্বীকৃতি পায়নি। সরকারিভাবে উপজেলা প্রশাসন জমি বন্দোবস্ত করে দিলেও তার দখল বুঝে পায়নি। আর পাব কিনা জানি না। মরণের আগে যদি স্বীকৃতি পেতাম তাহলে গর্বের সঙ্গে সবাইকে বলতে পারতাম আমার সব কিছু বৃথা যায়নি। নুরজাহানের স্বামী মোকাররম হোসেন বলেন, বয়সে কিশোর হলেও স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মাগুরার চৌগাছিতে আমি মুক্তিযোদ্ধাদের অনেক সহযোগিতা করেছি। তাই মুক্তিযোদ্ধা ও বীরঙ্গনাদের প্রতি ছিল আমার ভালবাসা। নূরজাহানের বাড়ির পাশে ছিল আমার এক চাচাতো বোনের বাড়ি। বোনের বাড়িতে বেড়াতে এসে দেখা হয় মাগুরায় কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে। তাদের সঙ্গে কয়েক দিন সময় কাটানোর পর নূরজাহান সম্পর্কে আমি জানতে পারি এবং বিয়ে করি। কিন্তু আমার পরিবার এ বিয়ে মেনে না নিলেও আমি নূরজাহান এর বাবার বাড়িতে এসে সংসার করতে থাকি। এ কারণে অনেকেই অনেক কথা বলে। সে থেকে টেইলারিং এর কাজ করে কোনো রকম সংসার চালাই। বর্তমানে এ কাজই করছি।আমার স্ত্রী যদি স্বীকৃতি পেতো তাহলে আমরা মরেও শান্তি পেতাম।বালিয়াকান্দি উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আ. মতিন ফেরদৌস বলেন, নূরজাহান বেগম একজন বীরাঙ্গনা। সরকারের পক্ষ থেকে তাকে সাহায্য করা হয়েছে। এসএস/আরআইপি

Advertisement