মতামত

ভারতীয় আবদারে গরু খামার যেন হুমকিতে না পড়ে

২৮ জুলাই জাগো নিউজসহ কয়েকটি নিউজ পোর্টালে ‘অবিক্রীত একটন ওজনের ‘কালা মানিক’ মারা গেছে’ শিরোনামে একটি রিপোর্ট দেখে মন খারাপ হলো। পরক্ষণেই এবারের ঈদে ঢাকায় গরু-ছাগল ব্যাপারীদের ‘ভাব’ দেখার অভিজ্ঞতা মনে করে কষ্টটা স্থায়ী হয়নি। অতিদ্রুত মোটাতাজা করার লোভে নানা মেডিসিন খাওয়ানো, অতিলোভে সীমাহীন দাম হাঁকানোর কারণে বিক্রি না হওয়ায় এবার কিছু গুরু ব্যবসায়ী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন এটা সত্য। কিন্তু করোনাকালে অর্থনৈতিক সমস্যার মধ্যেও মানুষ প্রচুর পশু কোরবানি দিয়েছে, উচ্চমূল্যে কিনেছে।

Advertisement

খবরটিতে বলা হয়েছে- ২৭ জুলাই ভোরে কোরবানির জন্য লালন-পালন করা ব্রাহমা জাতের একটন ওজনের ‘কালা মানিক’ মারা গেলে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের বসন্তপুর গ্রামে দরিদ্র কৃষক দ্বীন মোহাম্মদের বাড়িতে শত শত মানুষ নাকি ভিড় জমায়। দুপুরে গর্ত খুঁড়ে কালা মানিককে পুঁতে ফেলা হয়েছে।

কৃষক দ্বীন মোহাম্মদ বলেন, ঈদের আগে ঢাকার এক ব্যবসায়ী গরুটি আট লাখ টাকায় ক্রয় করেছিলেন। এরপর গরুর শরীরে রোগ ধরা পড়ার খবর ওই ব্যবসায়ীকে জানানোর পর ব্যবসায়ী আর গরুটি নেননি। এতে তার আট লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতিটা ব্যবসায়ীরা নিজেদের হাঁকানো দাম বা কেউ একজন যে সর্বোচ্চ দাম দিতে চেয়েছে তাকে মাথায় রেখে বলছেন।

ঈদে ঢাকায় গরু আনার সময়ও অনেক গরু মারা পড়েছে গরমে। সেটাতো অবশ্যই ক্ষতি। সেই খবরও ছিল পত্রিকায়। আরেক খবরের শিরোনামে দেখলাম ‘হিরো আলম’কে চার লাখ টাকায় বিক্রি করা হয়। ‘শাকিব খান’ ও ‘ডিপজল’কে বিক্রি করতে পারেননি খামারিরা। টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলার বহুল আলোচিত ৩১ মণ ওজনের ষাঁড় গরু ‘হিরো আলম’কে লোকসানে বিক্রি করা হয়েছে। ঈদের আগের দিন গাবতলী হাটে ষাঁড়টিকে চার লাখ টাকায় বিক্রি করা হয়। যদিও দাম হাঁকানো হয়েছিল ১২ লাখ টাকা। এদিকে টাঙ্গাইলের আলোচিত ‘শাকিব খান’ ও ‘ডিপজল’কে বিক্রি করতে পারেননি খামারিরা।

Advertisement

সাদাকালো রঙের ৩২ মণ ওজনের ‘রাজা বাবু’ নামক ষাঁড়টি ঈদ বাজারে বিক্রি হয়নি। নড়াইল সদর উপজেলার মাইজপাড়া ইউনিয়নের উড়নী গ্রামের আবদুল কাদের মোল্লা তিন বছর ধরে এই ষাঁড় লালন-পালন করেছেন। উদ্দেশ্য ছিল, কোরবানিতে ষাঁড়টি বিক্রি করবেন। কিন্তু বিক্রি করতে পারেননি। ফলে ষাঁড় নিয়ে এখন পড়েছেন বিপাকে। খামারি আবদুল কাদের দাবি করেন, তার রাজা বাবুর প্রতিদিন খাবার লাগে প্রায় ৬০০ টাকার। কোরবানিতে ষাঁড়টি বিক্রি করতে না পারায় এখন তা গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এ রকম আরও অসংখ্য কাহিনি পত্রিকায় এসেছে। কিন্তু কেন এটা হয়েছে- সেটা নিয়ে কোনো যুক্তিনির্ভর রিপোর্ট চোখে পড়েনি বরং ঈদের আগের দিন কোরবানির পশু সস্তা যাচ্ছে বলে অসত্য খবর প্রচার করেছে। সস্তা কীসের ভিত্তিতে! করোনার মধ্যে সব মানুষের আর্থিক সঙ্গতি কোরবানি দেয়ার বা অন্যবারের মতো অধিক দামে গরু কেনার মতো ছিল না। কিন্তু বাজারে গরুর অভাব ছিল না, দামও কোনোভাবেই গতবারের চেয়ে কম নয় বরং গড়ে ৫০ শতাংশ বেশি ছিল।

বাজারমূল্য যাচাইয়ের জন্য নানা ব্যারোমিটার আছে। আগে দেশে পর্যাপ্ত গরু ছিল না বলে কোরবানির জন্য বা সারাবছর মাংসের চাহিদা মেটাতে ভারত থেকে গরু আসতো। ওই গরু দেশি গরুর চেয়ে কম মূল্যে পাওয়া যেত। ওই সময় অনেকাংশে বাংলাদেশে ঈদুল আজহার পশুর জন্য ভারতের ওপর নির্ভর করতে হতো। কিন্তু নরেন্দ্র মোদি ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর ভারতে থেকে বাংলাদেশে গরু আসা অনেকটাই কমে গেছে। গরু পাচারে দু’দেশের চোরাকারবারিরা জড়িত থাকলেও ভারত নিরীহ বাংলাদেশিদের সীমান্তে গুলি করে হত্যা করতো। এখন গরু পাচার কমেছে, হত্যাও কমেছে।

প্রথমবারের মতো ২০১৪ সালে কোরবানির পশু নিয়ে ব্যাপক সংকট তৈরি হয়। তখন থেকেই বাংলাদেশের সরকার এবং খামারিরা উপলব্ধি করেন যে দেশের ভেতরেই গবাদি পশুর সংখ্যা বাড়াতে হবে। ব্রাহমা জাতের গরুর মাধ্যমে মাংস উৎপাদনে পদক্ষেপ এবং গরু মোটাতাজাকরণ প্রযুক্তির মাধ্যমে সংকট সামাল দিয়েছে বাংলাদেশ। বিদেশ থেকে ব্রাহমা গরুর বীর্য কিনে এনে দেশি গরুকে প্রজনন করিয়ে দ্রুতবর্ধনশীল গরুর জাত উদ্ভাবনের উদ্যোগ নিয়েছে। ফলে ভারত থেকে গরু আসা ব্যাপকভাবে কমে যাওয়ায় বাংলাদেশের জন্যই লাভই হয়েছে। ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে কয়েকবছর সময় লাগলেও এখন বাংলাদেশের গ্রামের অর্থনীতির অন্যতম ভিত হয়ে দাঁড়িয়েছে এটি। গ্রামে-শহরতলীতে প্রচুর গরুর খামার হয়েছে। এমনকি গ্রামেও এবার খামারিরা অনলাইনে ঈদের গরু বিক্রি করেছে।

Advertisement

অবস্থা যখন এমন বাংলাদেশি কৃষক-খামারিতে প্রটেকশন দেয়ার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। ভারতীয় গরু এবং গরুর মাংস দুটোই আমদানি বন্ধ করার দরকার হয়ে পড়েছে। পত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশে এখন চাহিদার চেয়ে বেশি মাংস উৎপাদন করছে। প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, দেশে প্রতিবছর প্রায় আড়াই লাখ টন মাংস উদ্বৃত্ত হয়। কোরবানির শতভাগ চাহিদা পূরণ হচ্ছে নিজেদের উৎপাদিত পশু দিয়েই। রফতানি বাজারেও দেশের মাংসের বেশ কদর। তারপরও দেশে বৈধ ও অবৈধ পথে আসছে পশুর মাংস। প্রতিবেশী চীন, মিয়ানমার ও নেপাল থেকে দেশে মাংস এলেও প্রধান উৎসই ভারত। ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশে ৫৭ লাখ কেজি মাংস আমদানি হয়েছে।

‘আজকের পত্রিকা’র এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, সরকার চলতি বাজেটে মাংস আমদানির ক্ষেত্রে ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করায় ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার বিক্রম দোরাইস্বামী গত ২৪ জুন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালকে একটি চিঠি দিয়ে তা কমানোর অনুরোধ করেছেন। এনবিআর এ ব্যাপারে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। তবে শুল্ক কমিয়ে ভারতীয় মাংস আমদানির অবাধ সুযোগ দেয়া হলে বাংলাদেশের পশুপালন খাতের জন্য তা আত্মঘাতী হবে মনে করে বাংলাদেশ মাংস ব্যবসায়ী সমিতি।

ক্রমবর্ধমান এই সেক্টরকে নার্সিং করা এখনই জরুরি। আর খামারি কৃষকদের উচিত ঈদের জন্য বড় বড় গরু প্রস্তুত না করে ছোট ও মাঝারি সাইজের গরু তৈরি করা। তাতে ক্রেতা-বিক্রেতা দু’পক্ষই লাভবান হতে পারেন।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট, ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত।anisalamgir@gmail.com

এইচআর/বিএ/জিকেএস