কুড়িগ্রামে পাওয়ার ডেভলপমেন্ট বোর্ডের (পিডিবি) দেয়া বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করতে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন সাধারণ মানুষ। ভোগান্তি থেকে রেহাই পেতে অনেক গ্রাহক বিদ্যুৎসংযোগ বিছিন্ন করার উদ্যোগও নিয়েছেন ইতোমধ্যে। আর এসব অভিযোগের কথা স্বীকার করেও সমাধানের কোনো উদ্যোগ নেই কর্তৃপক্ষের।সরজমিনে দেখা যায়, শহরের অধিকাংশ বাড়ি এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে মিটার রিডাররা মিটার না দেখেই মনের খুশী মতো কয়েকগুণ বিল দিয়ে থাকেন। আর সেই বিল পরিশোধ করতে হিমশিম খাচ্ছে সাধারণ মানুষ।পৌরসভার হানাগর গ্রামের কৃষক সফিকুল (৩২) জানান, প্রায় ৩ বছর পূর্বে পিডিবি থেকে ফাতেমা বেগম (৫৫) তার মায়ের নামে আবাসিক বিদ্যুৎসংযোগ নেন। গত দু’বছর থেকে স্বাভাবিকভাবে বিদ্যুৎ বিল আসলেও চলতি বছর থেকে অস্বাভাবিক হারে বিল আসছে। চলতি বছরের জানুয়ারি হতে ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রায় ১৬ হাজারের বেশি বিদ্যুৎ বিল দিতে হয়েছে। আমাদের বাড়িতে মাত্র ১শ ওয়াট এনার্জি বাল্ব-৪টি, ৬০ ওয়াট বাল্ব-২টি, ফ্যান-৩টি, টেলিভিশন ২টি ব্যবহার করা হয়। গত ১৬ নভেম্বর ২ হাজার ৬৪৩ টাকা বিদ্যুৎ বিল দিয়েছি। আবারও চলতি মাসের ১০ ডিসেম্বর শেষ তারিখ এক হাজার ৮৭৫ টাকা বিল শোধ করতে হবে। তিনি আরো জানান, গত বছর ডিসেম্বর থেকে চলতি বছরের মে মাস পর্যন্ত মাত্র এক হাজার ৩৪ টাকা বিল পরিশোধ করেছিলাম। পিডিবির লোকজন মিটার না দেখে বিদ্যুৎ বিল দিয়ে যায়। অফিসে অভিযোগ করেও কোনো সুরহা মেলেনি। ওখানকার লোকজন বলে পরের মাসে সর্বনিম্ন বিল ধরে পুষিয়ে দেয়া হবে বলে জানান। আমরা কৃষক মানুষ এভাবে বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করা সম্ভব না। তাই এ মাসের বিল পরিশোধ করে সংযোগ বিছিন্ন করবো।একই এলাকার রাজমিস্ত্রি শরিফ (২২) বলেন, প্রায় দেড় বছর হলো আমার মা সকিনা বেগম (৪৮) বাড়িতে বিদ্যুৎসংযোগ নেয়। ডিসেম্বর মাসে আমাদের বিদ্যুৎ বিল আসে ৪ হাজার ৮৬৩ টাকা। পরে অফিসে যোগাযোগ করে তা কমিয়ে ২ হাজার ৫শ টাকা করে দেয়। যার পরিশোধ করা শেষ তারিখ ১০ ডিসেম্বর। এর আগে ৫ মাসের বাকিতে বিল পরিশোধ করেছি। দিন করে দিন এনে সংসার চালাতে হয়। এভাবে সরকারের দেয়া বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করলে সংসার চালানো দায়। তাই এবারে বিল শোধ করে সংযোগ বিছিন্ন করে দেব। ভেলাকোপা গ্রামের বাসিন্দা সুফিয়া বেগম বলেন, বাহে হামরাতো মুর্খ মানুষ। ইংরেজিত লেখা বিল হামরা বুঝিও না। অমরাগুলা যা বিল দেয় তাই হামাক পরিশোধ করা লাগে। অথচ বাড়ির মধ্যে ৪টা সাদা (এনার্জি) লাইট জ্বালাই তাতে ৫-৬শ টাকা করি বিল আইসে। সেদিন অফিসত কওয়াতে ৩শ টাকা করি দিছে বিল। একই এলাকার চিকিৎসক মোফাচ্ছেল বলেন, পিডিবির কর্মকর্তা ও লাইনম্যানদের কোনো কাণ্ডজ্ঞান নেই। তারা বাঁশ ঝাড় ও আমার বাড়ির জানালার পাশ দিয়ে খুবই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় অন্যের বাড়িতে সংযোগ দিয়েছে। এমন ঝুঁকিপূর্ণ সংযোগের মধ্যে যেকোনো মুহুর্তে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটলে দায়ভার কার কাধে পড়তাবে?স্থানীয় অনেকেই বলেন, একই এলাকায় ২০০৮ সালে ৩টি খুটি গাড়লেও এখনও কোনো সংযোগ দেয়নি খুটিগুলোর মধ্যে। আর অন্যসব এলাকায় কিছু প্রভাবশালী নিয়ে ৪০ থেকে ৫০ জনের কমিটি গঠন করে বৈদ্যুতিক খুটি নিয়ে আসে এবং সেখান থেকে বাড়িতে সংযোগ নিতে গেলে বাড়তি ৪-৫ হাজার টাকা দিতে হয়। টাকাটা পিডিবি ও কমিটির লোকজন ভাগবাটোয়রা করে নেন।পাওয়ার ডেভলপমেন্ট বোর্ড (পিডিবি) অফিস সূত্র জানায়, জেলার প্রায় দেড় লক্ষাধিক মানুষের চাহিদা মোতাবেক গ্রীষ্মকালীন ৮ মেগাওয়াট এবং শীতকালীন ৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ পাওয়া যাচ্ছে। এখানে মোগলবাসা ইউনিয়নসহ সংযোগ লাইন রয়েছে ৩৪১ কিলোমিটার। এতে মোট গ্রাহক সংখ্যা ১৯ হাজার ৫শ। এরমধ্যে আবাসিক গ্রাহক সংখ্যা ১৫ হাজার ৮০, বিদ্যুৎ চালিত সেচ ৮৫৪টি, শিল্পকারখানা ২৪টি, মাঝারি শিল্প ৮টি, বাণিজ্যিক ৩ হাজার ১৫৫টি, অনাবাসিক ১৭৮টি এবং রাস্তাসহ অন্যান্য ২১টি সংযোগ রয়েছে। কয়েকটি ক্যাটাগরিতে বিদ্যুৎ বিল আদায় হয়ে থাকে। এরমধ্যে ক্যাটাগরি আবাসিকে শূন্য ইউনিট হতে ৭৫ ইউনিট ৩ টাকা ৮০ পয়সা, ৭৬ ইউনিট হতে ২শ ইউনিট ৫ টাকা ১৪ পয়সা, ২০১ ইউনিট হতে ৩শ ইউনিট ৫ টাকা ৩৬ পয়সা, ৩০১ হতে ৪শ ইউনিট ৫ টাকা ৬৩ পয়সা, ৪০১ ইউনিট হতে ৬শ ইউনিট ৮ টাকা ৭০ পয়সা, ৬শ ইউনিটের উপরে ৯ টাকা ১৮ পয়সা। ক্যাটাগরি ক্ষুদ্র শিল্প (ক) ফ্ল্যাট ৭ টাকা ২২ পয়সা, (খ) অফপিক টাইম ৬ টাকা ৯০ পয়সা এবং (গ) পিক টাইম ৯ টাকা ২৪ পয়সা। ক্যাটাগরি ডি-আবাসিক বাতি ও বিভিন্ন ৫ টাকা ২২ পয়সা। ক্যাটাগরি ই-বাণিজ্যিক ও অফিস (ক) ফ্ল্যাট ৯ টাকা ৮০ পয়সা, (খ) অফপিক টাইম ৮ টাকা ৪৫ পয়সা এবং (গ) পিক টাইম ১১ টাকা ৯৮ পয়সা। ক্যাটাগরি এফ-(ক) ফ্ল্যাট ৭ টাকা ৫৭ পয়সা (খ) অফপিক টাইম ৬ টাকা ৮৮ পয়সা এবং (গ) পিক টাইম ৯ টাকা ৫৭ পয়সা। ক্যাটাগরি জি-২ (ক) ফ্ল্যাট ৭ টাকা ৩৫ পয়সা, (খ) অফপিক টাইম ৬ টাকা ৭৪ পয়সা এবং (গ) পিক টাইম ৯ টাকা ৪৭ পয়সা। ক্যাটাগরি জি-৩ (ক) ফ্ল্যাট ৭ টাকা ২৫ পয়সা, (খ) অফপিক টাইম ৬ টাকা ৬৬ পয়সা এবং (গ) পিক টাইম ৯ টাকা ৪০ পয়সা। ক্যাটাগরি জে’র মধ্যে রাস্তার বাতি ও পানির পাস্প ৭ টাকা ১৭ পয়সা সরকার গত পহেলা সেপ্টেম্বর থেকে নির্ধারণ করে। আর এসব বিল দেখার জন্য একজন মাত্র মিটার রিডার রয়েছে। মাস্টারোলে ৩০ থেকে ৩৫ জন মিটার রিডারের কাজ করছে।এ ব্যাপারে পিডিবির নির্বাহী প্রকৌশলী (ভারপ্রাপ্ত) আশরাফুল ইসলাম মণ্ডল বিদ্যুৎ বিল অতিরিক্ত আসার বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, এ ধরনের অভিযোগ আসছে আমরা তার সমাধানও করছি। লোকবলের সংকটে এসব ভুল হয়ে থাকে। এছাড়াও মিটার অনেক উঁচুতে লাগানো থাকায় মিটার রিডাররা এমন ভুল করছে। আর আমাদের অফিসে কম্পিউটার বিল হয়না। রংপুর চিফ অফিস কম্পিউটার বিল করে থাকে সেখানেও এমন ত্রুটিপূর্ণ বিল হতে পারে। তিনি বলেন, ইতোমধ্যে অবৈধ লাইন ও বকেয়া বিল আদায় এবং সেচ পাম্প সংযোগ নিয়ে আবাসিকে ব্যবহার করার উপর ৬৩টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এরমধ্যে বকেয়া বিল আদায়ে বিদ্যুৎসংযোগ ব্যবহার করার জন্য ৪০টির মতো মামলা করা হয়েছে।এমএএস/এমএস
Advertisement