‘স্থানীয় বাজার থেকে রেজিন (কাঁচামাল) কিনে নিজেরাই বিভিন্ন খাদ্যপণ্যের জন্য টিউব-কাপ তৈরি করি। সেই রেজিন এখন কিনতে পারছি না। আবার জেলির কিছু অর্ডার রয়েছে, কিন্তু জেলির প্যাকিং ম্যাটারিয়ালস ডেলিভারি হচ্ছে না, ওদের ফ্যাক্টরি বন্ধ। অন্যদিকে কার্টনের অভাবে প্রথম দিন (রোববার, ২৫ জুলাই) আধা শিফট প্রোডাকশন বন্ধ রাখতে হয়েছে।’
Advertisement
ঈদুল আজহার পরে খাদ্যপণ্য উৎপাদনের কারখানা খুলে প্রথম দিনের অভিজ্ঞতা এভাবেই বর্ণনা করছিলেন ছৈয়দ মুহাম্মদ শোয়াইব হাছান। তিনি হিফস অ্যাগ্রো ফুড ইন্ডাস্ট্রিজের প্রধান নির্বাহী।
কঠোর লকডাউনের মধ্যে সরকার খাদ্য ও খাদ্যদ্রব্য উৎপাদন এবং প্রক্রিয়াজাতকরণের মিল কারখানা চালু রেখেছে। এ খাতেরই ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ শিল্পের (সহযোগী শিল্প) কারখানা বন্ধ থাকায় নানা সমস্যা হচ্ছে খাদ্য উৎপাদন ও প্রক্রিয়াকরণে।
ছৈয়দ মুহাম্মদ শোয়াইব বলেন, ‘এভাবে কিছুদিন ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ কারখানা বন্ধ থাকলে আমাদের উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাবে। কারণ প্রসেসিং, প্যাকেজিং ম্যাটারিয়ালস ছাড়া কোনো পণ্যই রফতানি উপযোগী করা সম্ভব নয়। রফতানিও করা যাবে না।’
Advertisement
শুধু হিফস অ্যাগ্রো ফুড ইন্ডাস্ট্রিজই নয়, কঠোর লকডাউনের মধ্যে খাদ্যদ্রব্য উৎপাদন এবং প্রক্রিয়াজাতকরণের প্রায় ২০ হাজারের বেশি কারখানা খোলা থাকলেও তারা পড়েছেন নানা দুশ্চিন্তায়। ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ পণ্য না পাওয়ার পাশাপাশি কর্মী আনা-নেয়ায় সমস্যা এবং ফ্রেইট (মালামাল পরিবহন) জটিলতায় উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন অনেকে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের বেশিভাগ খাদ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ছোট-মাঝারি পর্যায়ের। এমনকি অধিকাংশ বড় প্রতিষ্ঠানও কমপ্লায়েন্স নয়। ফলে তাদের পণ্য প্রক্রিয়াকরণের জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতা নিতে হয়। সেসব সহযোগী প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। সে কারণে সম্পূর্ণরূপে পণ্য প্রস্তুত করে বাজারজাতকরণে সমস্যা হচ্ছে।
এ বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (জেলা ও মাঠপ্রশাসন অনুবিভাগ) শেখ রফিকুল ইসলামের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘প্রজ্ঞাপনে যেটা আছে ব্যাখ্যা আসলে সেটাই। এর বাইরে আমাদের যাওয়ার সুযোগ নেই।’
লকডাউনে ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ কারখানা বন্ধ থাকায় অনেক খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ কারখানায় প্যাকিং ম্যাটারিয়ালসের অভাব দেখা দিয়েছে
Advertisement
অবশ্য একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, ‘এভাবে যোগসূত্র খোঁজা হলে অনেক কিছুই খুলে দিতে হবে। কিন্তু করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতি এমন যে, আরও কঠোর হওয়া প্রয়োজন ছিল। নিজেদের ভালোর জন্য কয়েকটা দিন আমাদের ত্যাগ স্বীকার করতেই হবে।’
সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান না থাকলেও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে ছোট বড় মিলিয়ে প্রায় ২০ হাজারের বেশি প্রতিষ্ঠান কৃষি ও খাদ্য প্রক্রিয়াকরণের সঙ্গে জড়িত। এ খাতেরই ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ কারখানা আছে দুই থেকে তিন হাজার। এসব কারখানায় উৎপাদিত পণ্য দেশের চাহিদা মিটিয়ে রফতানি হয় বিদেশে। গত বছর বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের যে ভয়াল থাবা অর্থনীতিতে আঘাত করেছে, তার ধাক্কা লেগেছে এই কৃষি ও খাদ্য প্রক্রিয়াকরণশিল্পেও।
যদিও মহামারিকালেই দেশের কৃষি প্রক্রিয়াকরণ শিল্পের ইতিহাসে হয়েছে সর্বোচ্চ রফতানি আয়ের রেকর্ড। সদ্যসমাপ্ত অর্থবছরে (২০২০-২১) এ শিল্পের রফতানি আয় ১০০ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক পার করেছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে ১০২ কোটি ৮১ লাখ ডলারের পণ্য বাংলাদেশ থেকে বিদেশে রফতানি হয়েছে। আগের অর্থবছর যে অংক ছিল ৮৬ কোটি ডলারের কিছু বেশি।
কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্পের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাগ্রো-প্রসেসরস অ্যাসোসিয়েশনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক মো. ইকতাদুল হক জাগো নিউজকে বলেন, ‘বিধিনিষেধ চলাকালে খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্পকে চালু রাখার সিদ্ধান্তকে আমরা সাধুবাদ জানাই। কিন্তু সহযোগী প্রতিষ্ঠান খোলা না থাকলে, যে উদ্দেশ্যে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, তা পুরোপুরি সফল হবে না। মোড়কজাতকরণে সমস্যা হলে দেশের বাজারের চেয়ে বেশি সমস্যা হবে রফতানিতে। যারা রফতানি আদেশ পেয়েছেন তারা পণ্য দিতে পারবেন না। ফলে বিদেশি ক্রেতা হারানোর শঙ্কা তৈরি হবে।’
খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ কারখানায় প্রস্তুত পণ্য দেশের চাহিদা মিটিয়ে রফতানি হয় বিদেশে
ইকতাদুল হক বলেন, ‘দেশে করোনার প্রকোপ থাকলেও প্রধান রফতানিবাজার ইউরোপ, আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশে করোনার প্রকোপ নেই। এমনকি ভারতেও করোনা কমে এসেছে। সবাই এখন তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যে জোর দিচ্ছে। নতুন নতুন ক্রেতা এবং অর্ডার আসছে। এ সময় অল্প কিছুদিনের জন্য রফতানি থমকে গেলে তার প্রভাব হবে দীর্ঘমেয়াদি।’
বাপার তথ্য বলছে, সংগঠনটির বর্তমান সদস্য সংখ্যা ৫৬৯। এর মধ্যে দেশে তিন শতাধিক উদ্যোক্তা সক্রিয়ভাবে উৎপাদন কার্যক্রম চালু রেখেছে। যার মধ্যে ৭০-এর বেশি বড় প্রতিষ্ঠান রয়েছে। রফতানি করছে শতাধিক প্রতিষ্ঠান।
এছাড়া বাপার সদস্যদের বাইরে ছোট-বড় মিলিয়ে ১৯ হাজারের বেশি প্রতিষ্ঠান কৃষি ও খাদ্য প্রক্রিয়াকরণের সঙ্গে জড়িত। দেশের ২০ শতাংশ মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এ কাজে জড়িত। প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্য খাত বাংলাদেশের জিডিপিতে ২ শতাংশেরও বেশি অবদান রাখছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে প্রচুর কৃষিপণ্য, দুধ, ডিম,মাংসসহ অন্যান্য খাদ্য নষ্ট হয়ে যাবে যথাযথ প্রক্রিয়াকরণ সম্ভব না হলে। এছাড়া নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্য উৎপাদন, বিপণন ও রফতানি ব্যাহত হলে ভোক্তার কাছে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্য পৌঁছানো সম্ভব হবে না। ফলে দেশে ভয়াবহ খাদ্য সঙ্কট হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। পাশাপাশি প্রান্তিক পর্যায়ে কৃষক ও খামারিরা ব্যাপক লোকসানে পড়বেন।
এদিকে করোনাকালে এ খাতে চরম শ্রমিক সংকটের কথা বলছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের বক্তব্য, ঈদের ছুটিতে যাওয়া অধিকাংশ শ্রমিক এখনো কাজে ফিরতে পারেননি। পাশাপাশি কন্টেইনারের বাড়তি ভাড়ার কারণে বিপর্যয়ে পড়েছে খাতটি। আগের তুলনায় এখন কন্টেইনার ভাড়া ১০ গুণ বেড়েছে। অনেক পণ্য এজন্য রফতানি করা যাচ্ছে না। এক্ষেত্রেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নজর দেয়ার দাবি জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
এনএইচ/এইচএ/এএসএম