দেশে এখন কার্যত কোনো রাজনৈতিক তৎপরতা নেই। করোনা পরিস্থিতির উদ্বেগজনকভাবে অবনতি ঘটছে। সংক্রমণ এবং মৃত্যু কমানো যাচ্ছে না। ঈদুল আজহার পর ২৩ জুলাই থেকে ১৪ দিনের কঠোর লগডাউন শুরু হয়েছে। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বের না হওয়ার আহ্বান না মানার প্রবণতা আছে। দেশের ৮০ শতাংশ মানুষকে টিকা দেওয়ার জন্য ২১ কোটি ডোজ টিকা সংগ্রহের ব্যবস্থা হয়েছে বলে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জানালেও মানুষ যে খুব স্বস্তিবোধ করছে, সেটা বলা যাচ্ছে না। মন্ত্রীর কথায় মানুষের আস্থা কম। আগে তিনি এমন অনেক কথা বলেছেন যা ঠিক হয়নি। স্বাস্থ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ আছে। জাতীয় সংসদেও তার ব্যর্থতার কথা বলে অপসারণের দাবি উঠেছে। তাছাড়া টিকা দেওয়ার আমাদের যে সক্ষমতা তাতে ৮০ শতাংশ মানুষকে টিকা দিতে কয়েক বছর লাগবে। মাস্ক ব্যবহার, নিরাপদ শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা, ভিড় এড়িয়ে চলার জন্য মানুষকে সচেতন করার দায়িত্ব পালন যখন জরুরি তখনও আমাদের দেশে চলছে দোষারোপের রাজনীতি। করোনা নিয়ন্ত্রণে সরকার ব্যর্থ বলে অভিযোগ বিএনপির। আবার সরকারি দলের পক্ষ থেকে অসত্য তথ্য দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য বিএনপিকে দোষা হচ্ছে।
Advertisement
আমাদের দেশের রাজনীতি তিন দশক ধরে মূলত দুই দলের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। হয় আওয়ামী লীগ না হয় বিএনপি— এর বাইরে মানুষ আর কিছু ভাবতে পারে না। মাঝে-মাঝে রাজনীতিতে তৃতীয় বিকল্প বা ধারার কথা শোনা গেলেও সেটা যে মানুষজনের মনে খুব বেশি দাগ কাটে না তা বোঝা যায় এই ধারার দুর্বল অবস্থান দেখেই। ভোটের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির পালাক্রমে ক্ষমতায় ফেরার যে রাজনীতি তার সমালোচনা কেউ কেউ করলেও তৃতীয় ধারা বা তৃতীয় রাজনৈতিক শক্তির অনুকূলে কাউকে সেভাবে সমবেত হতে দেখা যায় না। এরশাদের পতনের পর আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বাইরে আলাদা রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে দাঁড়ানোর প্রথম উদ্যোগ নিয়েছিলেন ড. কামাল হোসেন। একানব্বইয়ে আওয়ামী লীগ ছেড়ে তিনি সাড়া ফেলেছিলেন। গণফোরাম গঠন করে তিনি ব্যাপকভাবে আলোচনায় এসেছিলেন। ধারণা করা হচ্ছিল কামাল হোসেন পারবেন আওয়ামী লীগ এবং বিএনপিকে টেক্কা দিতে। তার সে যোগ্যতা ছিল। একদিকে তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহযোগী, অন্যদিকে ছিলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনজীবী। তাকে ঘিরে একটি বলয় তৈরি হতে শুরু করেছিল। বিশেষ করে সিপিবি ত্যাগ করে অনেকেই গণফোরামে ভিড়েছিলেন। আওয়ামী লীগের বঞ্চিত ও বহিষ্কৃত কিছু নেতাও গণফোরামে নাম লিখিয়েছিলেন। তারা হয়তো আশা করেছিলেন যে কামাল হোসেনের ইমেজের জোরে গণফোরাম রাতারাতি বড় দলে পরিণত হতে পারবে। সাবেক কমিউনিস্টরা ছোট দলের বড় নেতা না থেকে বড় দলের নেতা হওয়ার বাসনা পোষণ করেছিলেন। রাজনীতিতে বি-টিম গিরি করার অভিযোগ থেকে মুক্ত হয়ে এ-টিমে খেলতে চেয়েছিলেন।
কিছু দিন যেতে না যেতেই এটা বোঝা গেলো যে রাজনীতিতে কামাল হোসেন একজন ‘বালক-প্রতিভার’ অধিকারী ব্যক্তি। তিনি বৃত্তের বাইরে যেতে পারেন না। কামাল হোসেন অনেক গুণের অধিকারী হলেও বাংলাদেশে রাজনীতি করতে গেলে যেসব গুণ থাকা দরকার তাতে তার ঘাটতি আছে। বাংলাদেশের মানুষের আস্থা ও ভালোবাসা পেতে হলে তাদের মধ্যে থেকে তাদের জন্য কিছু করতে হয়। কামাল হোসেন হলেন অনেকটা দূর আকাশের তারার মতো। তাকে দেখা যায় অথচ ধরা যায় না বা কাছে পাওয় যায় না। পেশাগত কারণে তাকে ঘনঘন বিদেশ যেতে হয়। দরকারের সময় মানুষ তাকে কাছে পায় না। তার সম্পর্কে কেউ কেউ বলেছেন, তিনি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট অথবা জাতিসংঘের মহাসচিব হতে পারলেও বাংলাদেশের কোনো নির্বাচনে জিততে পারবেন না। তাছাড়া রুগণ রাজনীতি এবং সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কথা বললেও তার দলে এমন কেউ কেউ জায়গা পায় যারা ওই ধারার রাজনীতির সাথেই জড়িত ছিলেন। তিনি নতুন রাজনীতির কথা বললেও তার রাজনীতিতে মানুষ নতুন কিছু খুঁজে পাননি। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বাইরে রাজনীতিতে তিনি একটি নতুন ধারা তৈরি করবেন বলে আশা করা হলেও তার মধ্যে আওয়ামী লীগ তথা শেখ হাসিনার প্রতি বিরাগ এবং বিএনপি তথা খালেদা জিয়ার প্রতি অনুরাগের বিষয়টি গোপন থাকেনি। শেখ হাসিনা বা আওয়ামী লীগের সমালোচনায় যতটা ঝাঁজ ঝরে পড়ে, বিএনপি বা খালেদা জিয়ার বেলায় তা হয় না। মানুষ এসব বুঝতে পারে বলেই কামাল হোসেনের বিকল্প রাজনীতিকে তারা বিএনপি অনুকূল হিসেবেই ধরে নিয়ে তার দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, একজন রাজনীতিবিদ সাহসী ভূমিকা না দেখাতে পারলে মানুষ তার প্রতি আগ্রহবোধ করে না। কামাল হোসেনের মধ্যে সাহসের অভাব দেখে অনেকেই তাকে ছেড়ে চলে গেছেন। কামাল হোসেনের পক্ষে রাজনীতিতে আর বড় কিছু করা সম্ভব বলে এখন আর কেউ মনে করেন না। এখনও রাজনীতি নিয়ে তিনি কথা বলেন, তবে সেগুলো কারো মনে তেমন দাগ কাটে না। নিজে তিনি হয়তো অনেক ওজনদার কিন্তু রাজনীতিতে তিনি সোলার মতো হালকা। তাই তিনি একেবারে না ডুবে এখনো ভাসছেন।
বেশ কয়েক বছর ধরে রাজনীতিতে বাম বিকল্পের কথা বলে আসছে সিপিবি এবং বাসদ। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার পর থেকে বাম রাজনীতির খারাপ সময় যাচ্ছে। একসময় সিপিবি রাজনীতিতে একটি দৃশ্যমান শক্তি হয়ে উঠলেও ভাঙন-পরবর্তীকালে তা আর নেই। বাসদের সঙ্গে সিপিবির রাজনৈতিক লাইন নিয়ে এককালে বিতর্ক ছিল। সিপিবি-বাসদ একসঙ্গে বাম বিকল্পের স্লোগান ওঠানোর পর বাসদে আরেক দফা ভাঙন দেখা যায়। নিজের ঘরই যেখানে নড়বড়ে সেখানে তাদের ডাকে সাড়া দিয়ে বিকল্প রাজনৈতিক ধারা গড়তে কারা এগিয়ে আসবে বলা মুশকিল। বামদের আবার রয়েছে বিতর্ক প্রবণতা। তত্ত্বীয় বিতর্ক এতো জটিল যে তা অনেকের মাথার উপর দিয়ে চলে যায়। সেজন্য দেখা যায় সিপিবি ও বাসদ সমমনাদের নিয়ে একের পর এক সভা করছে কিন্তু বিকল্প কেবল দূরগামী হচ্ছে। খুব সহসা বামশক্তি দেশের রাজনীতির চালকের আসনে বসবে বলে মনে হয় না। ‘পথহারা পাখি কেঁদে ফেরে একা’।
Advertisement
ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী বিএনপি থেকে বিতাড়িত হয়ে বিকল্প ধারা নামের নতুন দল গঠন করেছিলেন। মনে করা হয়েছিল তিনি একজন নামকরা চিকিৎসক এবং একটি রাজনৈতিক পরিবারের মানুষ, তাই রাজনীতিতেও তিনি ভালো করবেন।
বি চৌধুরীর বাবা কফিলউদ্দিন চৌধুরী আওয়ামী লীগের নেতা ছিলেন। জিয়াউর রহমান তাকে রাজনীতিতে টেনে এনে বিএনপির মহাসচিবের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। ভালোই করছিলেন তিনি। শুধু জিয়ার সময় নয়, খালেদা জিয়ার সাথেও খারাপ করছিলেন না। সমস্যা তৈরি হলো তিনি রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর। একটু স্বাধীনভাবে চলতে গিয়ে বিরাগভাজন হলেন খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমানের। অতঃপর বঙ্গভবন থেকে বিদায়। রক্তে তখন তার রাজনীতির নেশা। গঠন করলেন নতুন দল। হয়তো ভেবেছিলেন খালেদাকে টেক্কা দিতে পারবেন। পারলেন না। নতুন দল, নতুন রাজনীতির কথা মুখে বললেও চলতে লাগলেন জিয়া-খালেদার পথেই। মানুষ বিকল্প ধারাকে বিএনপিরই ছাও বলেই ধরে নিলো। রাজনীতিতে নতুন কোনো ছাপ রাখতে না পেরে বিকল্প ধারা এখন বিএনপিরই করুণাপ্রার্থী। খালেদার জোটে ভিড়তে চান। আবার আওয়ামী লীগকেও বেজার করতে চান না।
আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বাইরে আরেকটি রাজনৈতিক দোকান খুলেছিলেন কাদের সিদ্দিকী। একাত্তরের সাহসী যোদ্ধা এবং বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করে ভারতে গিয়ে কিছু ভূমিকা গ্রহণ করায় অনেকের কাছে তার এক ধরনের গ্রহণযোগ্যতা থাকলেও দলত্যাগী হয়ে নতুন দল করে সুবিধা করতে পারলেন না। তার রাজনৈতিক অবস্থানও দোদুল্যমান। আওয়ামী লীগ বিরোধিতায় তিনি মুক্তকণ্ঠ হলেও বিএনপির দিকে ঝুঁকে পড়া ভাব কারো কাছে গোপন থাকেনি। বোন ও ভাবী (শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া) কার প্রতি তার পক্ষপাত বেশি তা নিয়ে মানুষের মনে সংশয় আছে। ঠিকাদারী ব্যবসা করতে গিয়েও তিনি তার অতীত সুনামের সঙ্গে সুবিচার করতে পারেননি। তাই তার কৃষক-শ্রমিক-জনতা লীগ সারাদেশ তো দূরের কথা নিজের জেলা টাঙ্গাইলেও পায়ের নিচে মাটি পেলো না।একসময়ের তুখোড় ছাত্রনেতা,স্বাধীনতার পর জাসদ গঠন করে দেশজুড়ে সাড়া ফেলানো নেতা আসম আবদুর রব নানা পথ ঘুরে এখন যেন ক্লান্ত পথিক এক। রাজনীতিতে তিনি আছেন এটা জানান দিতে মাঝে মাঝে সংবাদমাধ্যমে হাজির হন। নতুন জোট গঠনের তৎপরতাও মাঝে-মধ্যে দেখা যায়। মানুষের মনে এসব কোনো দাগ কাটে না। এগুলোকে মানুষ রাজনৈতিক তামাশা হিসেবেই দেখে। রাজনীতিতে তৃতীয় ধারা নিয়ে মাঠে আছেন সাবেক ছাত্রনেতা ও ডাকসুর একাধিকবারের ভিপি মাহমুদুর রহমান মান্না। রাজনীতিতে তার ঘুরপাক খাওয়ার অভ্যাস। ছাত্রলীগ জাসদ-বাসদ হয়ে আওয়ামী লীগের নৌকোয় উঠেও তীরে ভিড়তে না পেরে এখন আছেন নতুন পথ সন্ধানে। নাগরিক ঐক্য নামে কয়েক বছর ধরে একটি নাগরিক প্লাটফরম নিয়ে তিনি তৎপর আছেন। কিন্তু মান্নার অবস্থান যতটা আওয়ামী লীগবিরোধী ততটাই বিএনপির প্রতি নমনীয়। তাই বিকল্প হয়ে ওঠা তার পক্ষেও সম্ভব হবে না। মানুষের আস্থা পাওয়া কি মুখের কথা? এ ঘাট ও ঘাট করতে থাকলে মানুষ তাকে বিশ্বাস করে না। তাছাড়া রাজনীতিকে সার্বক্ষণিক পেশা হিসেবে নিতে না পারলে কীভাবে চলবে? রাজনীতিকে অবসর সময়ের চর্চার বিষয় ভাবলে মানুষ কোনো ভরসায় তার পেছনে কাতার বাঁধবে?
তাহলে বিষয়টি কি দাঁড়াচ্ছে? রাজনীতিতে তৃতীয় ধারার কোনো সম্ভাবনা চোখের সামনে কেউ দেখতে পাচ্ছেন কি? দেশে নতুন রাজনীতির গোড়াপত্তন করতে হলে দরকার নতুন নেতৃত্ব। কোথায় সে নেতৃত্ব? নেতৃত্ব আকাশ থেকে নাজেল হয় না। মানুষের ভেতর থেকেই চাহিদা অনুযায়ী একসময় ওই নেতৃত্ব বেরিয়ে আসে। ভারতে এরকম দু’চারজনকে— যেমন- দিল্লিতে অরবিন্দ কেজরিওয়াল, পশ্চিমবঙ্গে মমতা (বাংলাদেশের তিস্তার পানি পাওয়ার ব্যাপারে মমতাহীন) বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো কারো কারো উত্থান দেখা গেলেও বাংলাদেশে তা দেখা যাচ্ছে না। জাতীয় ভাবেও না, আঞ্চলিক কিংবা জেলা পর্যায়েও না।তবে ধর্মাশ্রয়ী সাম্প্রতিক দলগুলোর প্রভাব লক্ষণীয়ভাবে বাড়ছে বলে মনে হয়। এই শক্তি ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে। মুক্তিযুদ্ধ, গণতন্ত্র এবং উদারতায় বিশ্বাসী রাজনৈতিক শক্তি না দাঁড়ালে করোনা-পরবর্তী রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ কোন শক্তির হাতে যাবে তা নিয়ে এখনই ভবিষ্যদ্বাণী করা কঠিন।
Advertisement
লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক এবং সহকারী সম্পাদক ,আজকের পত্রিকা।
এইচআর/এএসএম