কৃষিপণ্য রফতানিতে ২০১৯-২০ অর্থবছরের তুলনায় ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৯ দশমিক ২৭ শতাংশ বেশি, যদিও তা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৩ দশমিক ৯১ শতাংশ কম ছিল। গত অর্থবছর কৃষিপণ্যের রফতানি হয়েছে ১০২.৮১ কোটি ডলার। আগের অর্থবছর এ রফতানির পরিমাণ ছিল ৮৬ কোটি ডলারের কিছু বেশি। করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) মহামারিকালে উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি বর্ধিত উড়োজাহাজ ভাড়া ও কৃষিপণ্যের উৎপাদন ব্যয় বাড়ায় কদর থাকার পরও বিশ্ববাজারে বাংলাদেশি কৃষিপণ্যের রফতানিতে ধীরগতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
Advertisement
দেশের কৃষিপণ্যের রফতানি ও বিকাশ নিয়ে কাজ করে বাংলাদেশ ফ্রুটস, ভেজিটেবল অ্যান্ড অ্যালাইড প্রোডাক্ট এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন। সংগঠনটির প্রেসিডেন্ট এস এম জাহাঙ্গীর হোসেন তিন যুগ ধরে আছেন অ্যাগ্রো প্রসেস ইন্ডাস্ট্রিতে। শাক-সবজি, ফল ও প্রসেসড পণ্যের রফতানির খুঁটিনাটি তার নখদর্পণে। গত মেয়াদে ছিলেন ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের পরিচালক। কৃষিপণ্য রফতানির সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়ে তিনি কথা বলেছেন জাগো নিউজের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন নিজস্ব প্রতিবেদক সাইফুল হক মিঠু।
জাগো নিউজ: বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের কৃষিপণ্যের চাহিদা কেমন?
এস এম জাহাঙ্গীর হোসেন: আন্তর্জাতিক বাজারে ভারতের শাক-সবজির দাম কম। এজন্য এখন তারা বাজারে ডোমিনেটিং পজিশনে। কৃষিপণ্যের বড় বাজার তাদের দখলে। ইউরোপের বাজারে ভারতের সবজি ঢুকছে ২০০৬-০৭ অর্থবছর থেকে। অন্যদিকে ১৯৭৩ সাল থেকে লন্ডনে বাংলাদেশের শাক-সবজি যায়। ইউরোপ-মধ্যপ্রাচ্যে আমাদের শাক-সবজির একটা বড় চাহিদা আছে।
Advertisement
বাংলাদেশের সবজি ও ফলের চাহিদা রয়েছে ইউরোপ এবং মধ্যপ্রাচ্যে
জাগো নিউজ: কী কী পণ্য, কোন কোন দেশে যাচ্ছে?
এস এম জাহাঙ্গীর হোসেন: আমাদের শাক-সবজির চাহিদা বিদেশে বেশি। শিম, লাউ, কুমড়া, পেঁপে, করলা, কচুরলতি, কাকরোল, বরবটি, চিচিঙ্গা, লালশাক, ডাঁটাশাক, ঝিঙ্গা, ধুন্দল এগুলোর চাহিদা বেশি আন্তর্জাতিক বাজারে। ফলের মধ্যে আম, কাঁঠাল, লটকন, লিচুর চাহিদাও বেশ। এছাড়া পান, লেবুর চাহিদাও আছে।
আমাদের মূলত বাজার হলো মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপ। ইউরোপের বাজারের মধ্যে রয়েছে- যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, ইতালি, জার্মানি, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড ও গ্রিস। মধ্যপ্রাচ্যের মধ্যে রয়েছে সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার, বাহরাইন, ওমান ও দুবাই। এছাড়া মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরে পণ্য যায়। যুক্তরাষ্ট্র-কানাডায়ও যায় আমাদের ফল-সবজি।
Advertisement
জাগো নিউজ: রফতানির ক্ষেত্রে পণ্যের গুণগত মান নির্ধারণ ও তা নিয়ন্ত্রণ কীভাবে হচ্ছে?
এস এম জাহাঙ্গীর হোসেন: ইউরোপের বাজারের জন্য পণ্যের গুণগত মান নিয়ন্ত্রণ একভাবে হয়, মধ্যপ্রাচ্যের জন্য আরেকভাবে হয়। আমাদের কৃষিপণ্য সব ধরনের কোয়ালিটি পরীক্ষায় পাস করতে পারে। ইউরোপের জন্য সরকারিভাবে সেন্ট্রাল হাউস করা হয়েছে শ্যামপুরে। সেখান থেকে প্যাকেজিং, গ্রেডিং ও কোয়ালিটি কন্ট্রোল করা হচ্ছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের আন্ডারে একটা কোয়ারেন্টাইন সার্টিফিকেট ইস্যু করা হয়। সেখানে থেকে কোয়ালিটি মেইনটেইন করেই বিদেশে পণ্য যায়। মধ্যপ্রাচ্যের জন্য রফতানিকারকরা নিজেরাই কোয়ালিটি কন্ট্রোলের ব্যবস্থা করেন।
পণ্য রফতানিতে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের নির্ভর করতে হয় বিদেশে এয়ারলাইন্সের কার্গো স্পেসে
জাগো নিউজ: আম রফতানি কমে গেল কেন?
এস এম জাহাঙ্গীর হোসেন: ইউরোপের বাজারে এখন ভারত, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনামের প্রচুর আম যাচ্ছে। আমাদের আমের সমস্যা হলো এটা মৌসুমি। বছরের একটা নির্দিষ্ট সময় রফতানি করা যায়। অন্যদিকে পাকিস্তানের আম সারাবছরই যায়। ভারতের আম ৬-৭ মাস পর্যন্ত পাওয়া যায়। এ কারণে আমাদের মার্কেটটা কন্টিনিউ করা সম্ভব হয় না। এছাড়া আমাদের প্রাইসিংয়ের সঙ্গে অন্য দেশের প্রাইসিংয়েরও পার্থক্য আছে। আবার আমাদের আমে কালার আসে না বা কালার একটু কম আসে। অন্যান্য দেশের আমের কালারটা বেশি আসে।
ইন্ডিয়ান চোষা আম বিশ্ববিখ্যাত। এটাকে বলে আলফানজো ম্যাঙ্গো। এই আম বাজারে থাকলে আমাদের আম চলবে না। তার পরও গত বছরের তুলনায় চলতি বছর আমাদের আম রফতানি বেশি। ইউরোপের বাজারে প্রায় ৫০০ টনের মতো আম এ বছর এক্সপোর্ট হয়েছে, আরও হবে। সিজন তো শেষ হয়নি।
জাগো নিউজ: আম রফতানি বাড়াতে করণীয় কী?
এস এম জাহাঙ্গীর হোসেন: অন্য দেশে আমের কস্টিং কম থাকায় প্রাইসও কম। কাস্টমার তো দাম কম যেটায়, সেটাই খাবে। আমের রফতানি বাড়াতে হলে সারাবছর এর জোগান দিতে হবে। সারাবছর পাওয়া যায় এমন ভ্যারাইটি চাষাবাদ হচ্ছে। বারি-৪ ও অন্যান্য ভ্যারাইটি হচ্ছে, যেগুলো সারাবছর পাওয়া যাবে। সারাবছর যদি আমরা আম চাষাবাদ করে বিদেশের মার্কেটে দিতে পারি, তাহলে আমের বাজার ফিরে পাব আমরা। আমাদের আমের চাহিদা আছে। কিন্তু যে সিজনে আমাদের আম যায়, অন্য দেশের আমও যায়। দাম কম থাকায় অন্য দেশের আম তখন মার্কেট দখল করে।’
জাগো নিউজ: বিভিন্ন কৃষিপণ্যে ক্ষতিকর উপাদান থাকায় তা নিষিদ্ধ হয়েছে বিশ্ববাজারে। এক্ষেত্রে করণীয় কী?
এস এম জাহাঙ্গীর হোসেন: লালশাক ও ডাঁটাশাকসহ বিভিন্ন সবজি ও ফলে নিষেধাজ্ঞা ছিল। অনেক দেশ থেকে সেগুলো উঠে গেছে। পান ও অন্যান্য সবজি থেকে ব্যাক্টেরিয়া দূর করতে কৃষকদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে কৃষিসংশ্লিষ্টরা। বিষমুক্ত অর্গানিক কেমিক্যাল দেয়া হচ্ছে। এছাড়া আমাদের সংগঠন থেকেও কৃষকদের নানা ধরনের ট্রেনিং দেয়া হবে। যেন মাঠপর্যায় থেকেই রফতানিযোগ্য শাক-সবজি আমরা পাই।
জাগো নিউজ: কাঠবাদাম, কাজুবাদামের সম্ভাবনা কেমন?
এস এম জাহাঙ্গীর হোসেন: আমাদের দেশের পার্বত্য এলাকায় এসব বাদামের চাষ হচ্ছে। কাঁচা কাঠবাদাম চীন-ভিয়েতনামে রফতানি হচ্ছে। খুব বেশি না হলেও রফতানি শুরু হয়েছে। এ আইটেমের ভবিষ্যৎ ভালো। আমাদের প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ কাজু ও কাঠবাদাম আমদানি করতে হয়। এর চাহিদা যদি দেশেই পূরণ করা যায় তাহলে অনেক বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে।
জাগো নিউজ: রফতানি কমে যাওয়ার মূল কারণ কী? এ বাজারে টিকে থাকার উপায়?
এস এম জাহাঙ্গীর হোসেন: প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৮০০ থেকে ১০০০ হাজার কোটি টাকার কৃষিপণ্য রফতানি হয়। কৃষিপ্রধান দেশ হওয়ার পরও রফতানির এ আকার কম। আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো কার্গো স্পেস। পচনশীল পণ্য বাই এয়ারে (আকাশপথে) শিপমেন্ট হয়। অনেক সময়ই আমরা উড়োজাহাজে পণ্যের জন্য জায়গা পাই না। ফরেন এয়ারওয়েজে কার্গো স্পেস অনেক সময় অ্যাভেইলেবল থাকে না। দেখা যায় আমদানিকারকের চাহিদা আছে কিন্তু কার্গো স্পেস না পেলে তো রফতানি করা সম্ভব হচ্ছে না।
বাংলাদেশি ফলমূলের বেশ চাহিদা ইউরোপ-মধ্যপ্রাচ্যের বাজারে
এছাড়া প্রতি কেজি পণ্যে যে উড়োজাহাজ ভাড়া সেটা অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক বেশি। এ কারণে আমাদের পণ্যের কস্টিং বেশি পড়ে। এসবের প্রভাব পড়ে বিশ্ববাজারে। পণ্যের প্রাইস অন্য দেশের তুলনায় বেশি হওয়ায় আমাদের ফল-সবজি মার খাচ্ছে।
কার্গো স্পেসের জন্য বিদেশি এয়ারলাইন্সের ওপর আমাদের নির্ভর করতে হচ্ছে। অনেক সময় তারা ট্রানজিট পয়েন্ট হয়ে যায়। সেক্ষেত্রে আমাদের সবজি, ফল ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আবার অনেক ক্ষেত্রেই ফরেন এয়ারলাইন্সে কার্গো স্পেস পাওয়া যায় না। প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে এসব সমস্যার সমাধান করতে হবে।
জাগো নিউজ: কৃষিপণ্য রফতানিতে সরকার কতটা আন্তরিক?
এস এম জাহাঙ্গীর হোসেন: কৃষিপণ্যের রফতানি বাড়াতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে কৃষি ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কাজ করছে। প্রধানমন্ত্রী নিজেও কৃষিপণ্য রফতানি বাড়াতে আলাদা বিমান কেনার কথা বলেছেন। সরকার আমাদের সমস্যা সমাধানে সব সময়ই আন্তরিক। আমাদের সঙ্গে প্রতিনিয়তই সরকারের প্রতিনিধিদের আলাপ আলোচনা চলছে।
সরকার চাইছে সহজে কৃষিপণ্য উৎপাদন ও রফতানি করতে। যত বেশি রফতানি হবে তত কৃষকের দোরগোড়ায় তার মূল্যটা পৌঁছবে। সবজি ও ফল রফতানি করে শুধু যে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হবে তা নয়, এখানে কর্মসংস্থানও সৃষ্টি হবে।
এসএম/এমএইচআর/এইচএ/জিকেএস