দেশজুড়ে

এই দিনে হানাদার মুক্ত হয়েছিল টাঙ্গাইল

একাত্তরের ১১ ডিসেম্বর রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর পাক হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণ ও পলায়নের মধ্য দিয়ে মুক্ত হয়েছিল টাঙ্গাইল। সারা রাত মুক্তিযোদ্ধাদের সারাশি আক্রমণ ও প্রচণ্ড গোলাগুলিতে বিনিদ্র রাত কাটান শহর ও শহরতলির লোকজন। অবশেষে সে কাঙ্খিত মুহূর্তটি ঘনিয়ে এল। ধবংসস্তুপের মধ্য দিয়ে স্বজন হারাদের বিয়োগ ব্যাথা ভুলে হাজার হাজার উৎফুল্ল জনতা রাস্তায় নেমে প্রাণের স্পন্দন আর মুক্তির আনন্দে উদ্বেল হয়ে নবজন্মের সেই মুহূর্তটিকে সবাই মিলে স্মরণীয় করে তোলেন।টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি, জেলা পরিষদের প্রশাসক, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ফজলুর রহমান খান ফারুক বলেন, স্বাধীনতার পর থেকে টাঙ্গাইল মুক্ত দিবসটি মূলত বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকী পালন করে আসছিলেন। কিন্তু গত কয়েক বৎসর যাবৎ এ দিনটি মুক্তিযোদ্ধারা পালন করছেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, টাঙ্গাইলে প্রথম প্রতিরোধ যুদ্ধ হয় ২৩ এপ্রিল ১৯৭১ সালে মির্জাপুর উপজেলার জামুর্কী ইউনিয়নের গুড়ান-সাটিয়াচুড়া নামক স্থানে। আর সে প্রতিরোধ যুদ্ধের নেতৃত্বে ছিলেন তিনি নিজে।  ফারুক বলেন, সে প্রতিরোধে একপর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটতে বাধ্য হন এবং নিরীহ মানুষসহ মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকেই শহীদ হন। সে স্থানে একটি কমপ্লেক্স নির্মাণের উদ্যোগ হাতে নিয়েছেন বলে জানান তিনি। টাঙ্গাইলের কৃতি সন্তানদের মধ্যে প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের আব্দুল মান্নান, টাঙ্গাইল, জামালপুর এলাকার দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংসদ শামছুর রহমান খান শাজাহান ছিলেন অগ্রগণ্য। এক পর্যায়ে টাঙ্গাইলে গঠন করা হয় কাদেরিয়া বাহিনী। এই বাহিনী প্রচণ্ড প্রতিরোধ ও প্রত্যাঘাত শুরু করে পাক সেনাদের উপর। ক্রমান্বয়ে সংগঠিত হতে থাকে হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা। শেষ পর্যন্ত এর সংখ্যা দাড়ায় ১৭ হাজারে। টাঙ্গাইলে ৮ ডিসেম্বর প্রায় পাঁচ হাজার পাক সেনা এবং সাত হাজার রাজাকার আলবদর অবস্থান করে। খান সেনাদের শক্তি বৃদ্ধির জন্য যমুনা নদী পথে পাঠানো হয় সাতটি জাহাজ ভর্তি অস্ত্র ও গোলাবারুদ। কাদেরিয়া বাহিনী গোপনে এই খবর পেয়ে কমান্ডার হাবিবুর রহমানকে দায়িত্ব দেন জাহাজ ধবংস করতে মাইন পোতার কাজে। জীবন বাজি রেখে ভূঞাপুর উপজেলার মাটিকাটা নামক স্থানে ঘটানো হয় জাহাজ বিস্ফোরণ। দু’টি জাহাজে দু’রাত দু’দিন ধরে চলতে থাকে অনবরত বিস্ফোরণ। বাকি জাহাজগুলো থেকে বিপুল পরিমাণ আধুনিক অস্ত্র-শস্ত্র উদ্ধার করে নিয়ে যাওয়া হয় জেলার বিভিন্ন স্থানে। মুক্তি বাহিনীর এ সকল আক্রমণ ও গোলাবারুদ ধ্বংস এবং অস্ত্র উদ্ধারে পাক সেনারা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর ৮ তারিখ পর্যন্ত টাঙ্গাইল, জামালপুর, শেরপুর, কিশোরগঞ্জ, সিলেট, সিরাজগঞ্জ ও পাবনায় বিশাল কাদেরিয়া বাহিনী যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পর্যুদস্ত করে পাক সেনাদের। এসব যুদ্ধে ৩ শতাধিক দেশপ্রেমিক অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। মুক্তিযোদ্ধাদের টাঙ্গাইল অঞ্চলের প্রধান বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী যোদ্ধাদের নিয়ে সখিপুরের সহানন্দা ও কীর্ত্তনখোলায় গড়ে তুলেন দুর্ভেদ্য দূর্গ। একের পর এক আক্রমণের মুখে পাক সেনারা গুটিয়ে জেলার অন্যান্য স্থান থেকে এসে যখন টাঙ্গাইল শহরে অবস্থান নেন তখন উত্তর ও দক্ষিণ টাঙ্গাইল ছিল সম্পূর্ণ মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। ৮ ডিসেম্বর পরিকল্পনা করা হয় টাঙ্গাইল আক্রমণের। মিত্র বাহিনীর সঙ্গে সংর্ঘষ হয় পাক সেনাদের কালিহাতী উপজেলার পুংলি নামক স্থানে। অবস্থা বেগতিক দেখে প্রাণ ভয়ে পাক সেনারা সারা রাত ধরে টাঙ্গাইল ছেড়ে ঢাকার দিকে পালায়। পরিকল্পনা অনুযায়ী চারদিক থেকে সারাশি আক্রমণ চালিয়ে পাক সেনাদের টাঙ্গাইল থেকে বিতাড়িত করতে সক্ষম হয় কাদেরিয়া বাহিনী। ১০ ডিসেম্বর রাতে টাঙ্গাইল প্রবেশ করেন কমান্ডার আব্দুর রাজ্জাক ভোলা। ১১ ডিসেম্বর সকালে কমান্ডার বায়োজিদ ও খন্দকার আনোয়ার টাঙ্গাইল পৌঁছান। আসেন বিগ্রেডিয়ার ফজলুর রহমান। সার্কিট হাউজে অবস্থানরত পাক সেনাদের কাদের সিদ্দিকীর কাছে আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে পুরোপুরি মুক্ত হয় টাঙ্গাইল।এমজেড/পিআর

Advertisement