গত দুই দশকে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে ব্যাঙের ছাতার মতো বেসরকারি হাজার হাজার কথিত বিভিন্ন স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম (এমআইএস) প্রণীত হেলথ বুলেটিন ২০১৪-এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী বর্তমানে দেশে বৈধ রেজিস্ট্রেশনপ্রাপ্ত ২ হাজার ৯৮৩টি হাসপাতাল ও ক্লিনিক এবং ৫ হাজার ২২০টি ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে। তবে এ সব বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সুষ্ঠুমান নিয়ন্ত্রণে যুগোপযোগি আইন নেই! চিকিৎসা বিশেষজ্ঞদের মতে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সংখ্যা বৈধ সংখ্যার চেয়েও বেশি। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা জানান, বেসরকারি খাতের এতো সংখ্যক প্রতিষ্ঠান সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য দেশে উপযুক্ত আইন নেই। বেসরকারি চিকিৎসা সেবা আইন প্রণয়নে বেশ কয়েকবার উদ্যোগ নেয়া হলেও নীতি-নির্ধারকদের অনেকের স্বার্থ বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কায় (কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট) আইনের খসড়াটি মন্ত্রণালয়ে ফাইল বন্দি হয়ে আছে।৩৩ বছরের পুরোনো ‘দ্য মেডিকেল প্রাকটিস অ্যান্ড প্রাইভেট ক্লিনিকস্ অ্যান্ড ল্যাবরেটরিজ ( রেগুলেশনস্) অর্ডিন্যান্স, ১৯৮২’-এর আওতায় স্বাস্থ্য অধিদফতরের হাসপাতাল ও ক্লিনিক শাখার স্বল্প সংখ্যক কর্মকর্তা-কর্মচারী ও জেলা পর্যায়ে সিভিল সার্জনদের দিয়ে হাজার হাজার প্রতিষ্ঠানের তদারকি চলছে।তারা আরো বলেন, বিজ্ঞানের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে ছোট-বড় হাসপাতালে বিভিন্ন বিশেষায়িত (আইসিইউ, সিসিইউ, এনআইসিইউ) চিকিৎসা সেবা ও উন্নতমানের চিকিৎসা সরঞ্জামাদি স্থাপন করা হচ্ছে। ফলে বর্তমানে প্রচলিত মান্ধাতা আমলের প্রণীত অধ্যাদেশ ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের সীমিত জনবল দিয়ে এসব প্রতিষ্ঠানের মনিটরিং ও সুপারভিশন কোনো ভাবেই সম্ভব নয়।গত বুধবার রাজধানীর পান্থপথের পাঁচ তারকাখ্যাত স্কয়ার হাসপাতালে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান চালিয়ে বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগে ২ লাখ ৬৪ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। ভ্রাম্যমাণ আদালতের ম্যাজিস্ট্রেট হেলাল উদ্দিন সাংবাদিকদের জানান, হাসপাতালটির নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র (আইসিইউ), করনারি কেয়ার ইউনিট (সিসিইউ), এইচডিইউ, এনআইসিইউ, ডায়ালাইসিসের লাইসেন্স নেই। হাসপাতালটির ক্লিনিক এবং ল্যাবের লাইসেন্সও মেয়াদউত্তীর্ণ। এছাড়া ফার্মেসিতে মেডিকেল ডিভাইস ও সার্জিক্যাল অ্যাপেরাটাসের ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন রেজিস্ট্রেশন (ডিএআর) এবং প্রেমিসেস লাইসেন্স নেই। হাসপাতালটির ব্লাড ব্যাংকের লাইসেন্সের মেয়াদও শেষ হয়েছে ২০১৪ সালের জুন মাসে।দেশের অন্যতম বৃহৎ এ হাসপাতাল এমন ক্রটি নিয়ে পরিচালিত হওয়ায় সারাদেশের হাজার হাজার হাসপাতাল ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের দেখভাল ও নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা স্বাস্থ্য অধিদফতরের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০০৪ সালে তৎকালীন বিএনপি জামায়াত জোট সরকারের আমলে বেসরকারি চিকিৎসা সেবা আইনটি জাতীয় সংসদে উত্থাপিত হওয়ার শেষ মুহূর্তে ফেরত আসে। এরপর সেনা সমর্থিত মইনউদ্দিন-ফখরুদ্দিন সরকারের আমলে আইনটি প্রণয়নের উদ্যোগ শুরু হয়। বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের ২০০৯ থেকে ২০১৪ সালের প্রথম দফার শাসনামলে আইনটি খসড়া প্রণীত হয়। বর্তমানে সেটি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে ফাইল বন্দি হয়ে পড়ে রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, বেশিরভাগ বেসরকারি হাসপাতাল ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারই ফ্রি স্টাইলে চলছে। এগুলোর অধিকাংশের মালিকানার সঙ্গে ক্ষমতাসীন দলের মন্ত্রী, সাংসদ, রাজনীতিবিদ ও চিকিৎসক নেতারা জড়িত। ফলে তারা আইন প্রণয়নে উৎসাহি হন না। এ সুযোগে প্রতিষ্ঠানগুলো শয্যা ভাড়ানো থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফি ও অস্ত্রোপচার বাবদ ইচ্ছে মাফিক অর্থ আদায় করছে। এছাড়া স্বাস্থ্য অধিদফতরের হাসপাতাল ও ক্লিনিক শাখা থেকে লাইসেন্স প্রদান করা হলেও প্রয়োজনীয় জনবল সংকটের দোহাই দিয়ে সিংহভাগ প্রতিষ্ঠানই পরিদর্শন করা হয় না। ফলে সাধারণ রোগীদের চরম আর্থিক মাশুল গুণতে হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট শাখার কর্মকর্তাদের মোটা অংকের মাসোহারা দিয়ে চলছে অধিকাংশ হাসপাতাল ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার।দেশে বেসরকারিখাতে হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার নিয়ন্ত্রণ, বেসরকারি চিকিৎসা সেবা আইন প্রণয়ণের প্রয়োজনীয়তা ও বিলম্ব প্রসঙ্গে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলন জাতীয় কমিটির সভাপতি ও বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ)-এর সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশীদ ই মাহবুব জাগো নিউজকে বলেন, বর্তমান অবকাঠামোতে স্বাস্থ্য অধিদফতর ও সিভিল সার্জনদের দিয়ে এতো সংখ্যক প্রতিষ্ঠান সুষ্ঠুভাবে নিয়ন্ত্রণ অসম্ভব ব্যাপার। সরকারি হস্তক্ষেপে নয়, স্বাধীন একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তা পরিচালনা করতে হবে।তিনি আরো বলেন, বেসরকারি চিকিৎসা সেবা আইন প্রণয়নে বিভিন্ন সরকারের আমলে উদ্যোগ নেয়া হলেও এর বাস্তবায়ন হয়নি। খসড়া আইনটি প্রণীত হলেও বহুমাস যাবত তা মন্ত্রণালয়ে পড়ে আছে। বেসরকারি চিকিৎসা সেবা আইন প্রণীত হলে সংশ্লিষ্ট অনেকের স্বার্থ বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কায় আইনটি প্রণয়নে নীতি-নির্ধারকদের অনেকেই উৎসাহি হন না।এমইউ/আরএস/এআরএস/পিআর
Advertisement