মতামত

ফকির আলমগীর: বেঁচে থাকবেন অন্তরে

আমাদের সবার প্রিয়, সদা হাস্যোজ্জ্বল ও প্রখ্যাত গণসংগীতশিল্পী বীর মুক্তিযোদ্ধা ফকির আলমগীর শুক্রবার (২৩ জুলাই) রাত ১০টা ৫৬ মিনিটে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। আমরা তার আত্মার মাগফিরাত কামনা করি।

Advertisement

কয়েক বছর আগে একটি দৈনিক পত্রিকার প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে তার সাথে দেখা হয়েছিল। তখনই বুঝেছি তিনি মানুষকে খুব কম সময়ে অনেক আপন করে নিতে পারতেন। হাসিমুখে কথা বলতেন। খুব কম সময়ে মানুষকে আপন করে নেয়া ছিল তার এক বিশেষ গুণ। তার এই বিশেষত্বই দেশের মানুষের হৃদয়ে এক বিশেষ স্থান করে দিয়েছে। তিনি সেই অনুষ্ঠানে গান গেয়েছিলেন ‘মায়ের এক ধার দুধের দাম কাটিয়া গায়ের চাম, পাপোশ বানাইলেও ঋণের শোধ হবে না, এমন দরদী ভবে কেউ হবে না আমার মা গো।’

আহা, কি অসাধারণ কণ্ঠ। উপস্থিত সবাইকে তিনি মুগ্ধ করেছিলেন আর জয় করেছিলেন সবার মন। এ গানটি যতবার শুনি ততই ভালো লাগে। গানটি ফকির আলমগীরের কণ্ঠে একেবারে শহর-গঞ্জ-গ্রামে সবখানে ছড়িয়ে গিয়েছিল। এখনো গানটি কোটি কোটি মানুষের হৃদয়ের স্পন্দনে জায়গা করে আছে। গানটি অমর হয়ে থাকবে চিরকাল।

জগন্নাথ কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে পরবর্তী পর্যায়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাংবাদিকতায় এমএ পাস করেন তিনি। ১৯৬৬ সালে ছাত্র ইউনিয়ন মেনন গ্রুপের সদস্য হিসেবে ছাত্র রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। এরই ধারাবাহিকতায় ক্রান্তি শিল্পীগোষ্ঠী ও গণশিল্পী গোষ্ঠীর সদস্য হিসেবে ষাটের দশকে বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে সংগীত বলয়ে প্রবেশ করেন। ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে এক বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে শিল্পী একজন শব্দসৈনিক হিসেবে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে যোগ দেন।

Advertisement

তার উল্লেখযোগ্য গানের মধ্যে রয়েছে ‘ও সখিনা গেছোস কিনা ভুইলা আমারে’, ‘নাম তার ছিল জন হেনরি’। ‘কালো কালো মানুষের দেশে, ঐ কালো মাটিতে/ রক্তের স্রোতের শামিল/ নেলসন ম্যান্ডেলা তুমি অমর কবিতার অন্ত্যমিল/ তোমার চোখেতে দেখি স্বপ্ন-মিছিল/ অগুন্তি মানুষের হৃদয়ের মিল।’

পৃথিবীর বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের পুরোধা নেলসন ম্যান্ডেলাকে নিয়ে ১৯৮৯ সালে এই অসাধারণ গানটি কণ্ঠে তোলেন ফকির আলমগীর। গানটি বেশ জনপ্রিয়তা পায়।

‘আবহমান বাংলার লোকসংগীত’ নামে গতবছর একটি বইও লিখেছেন তিনি।

তিনি শুধু গান গেয়ে মানুষের হৃদয় জয় করেননি বরং তার কণ্ঠে ফুটে উঠতো অধিকার বঞ্চিত মানুষের কথা। গানে গানে আজীবন অন্যায়-অনিয়মের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন তিনি। তিনি গাইতেন মানুষের জন্য, দেশের জন্য। মানবতার কথা, বঞ্চিত মানুষের অধিকারের কথা নিয়েই গানে গানে হাজির হতেন এ গণসংগীতশিল্পী। তার গান অন্তরের কথা বলতো। হৃদয় নাড়া দিত। অবলিলায় চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ত। কি অসাধারণ কণ্ঠই না ছিল তার।

Advertisement

এছাড়া যখনই দেশে সাম্প্রদায়িক অপশক্তি মাখাচাড়া দেয়ার চেষ্টা করেছে তখনই তাদের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন সোচ্চার। বিভিন্ন সময় আমরা দেখেছি তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে দেশে সাম্প্রদায়িক অপশক্তির বিরুদ্ধে তার অবস্থান কতটা দৃঢ় ছিল। সাম্প্রদায়িক বর্বরতার বিরুদ্ধে দলমত, ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে সম্মিলিত প্রতিরোধ, সম্প্রীতি ও মানবতার শক্তি জোরদার করার লক্ষ্যে তিনি ছিলেন নিবেদিত।

আমৃত্যু বঞ্চিত মানুষের পক্ষে গান গাওয়া এ মানুষটি বেঁচে থাকবেন কোটি মানুষের হৃদয়ে। তার আত্মার মাগফিরাত কামনা করি এবং শোক সন্তপ্ত পরিবারের প্রতি জানাই গভীর সমবেদনা।

এইচআর/এমকেএইচ