করোনাভাইরাসের সংক্রমণরোধে সরকারি নির্দেশনায় পবিত্র ঈদুল আজহার পর আজ সকাল থেকে ফের ১৪ দিনের কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। এ বিধিনিষেধ চলবে আগামী ৫ আগস্ট পর্যন্ত।
Advertisement
বিধিনিষেধ ঘোষণার পর সরকারি প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, এবারের বিধিনিষেধ চলাকালে পোশাক কারখানাসহ সব ধরনের শিল্পকারখানা ও সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে। জরুরি সেবা, গণমাধ্যম ও খাদ্য উৎপাদনে সংশ্লিষ্ট পরিবহন ছাড়া সব ধরনের গণপরিবহনও বন্ধ থাকবে।
বিশেষ করে বাস, ট্রেন, লঞ্চ ও অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট (বিদেশগামী যাত্রী পরিবহনের জন্য শর্তসাপেক্ষে তিনটি এয়ারলাইন্স ছাড়া) বন্ধ থাকবে। রাজধানী ঢাকা থাকবে বিচ্ছিন্ন। জিরো টলারেন্সে থাকবে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেছেন, এবারের লকডাউন আগের লকডাউনগুলোর তুলনায় কঠোর থেকে কঠোরতর হবে। প্রতিমন্ত্রীর কথার সত্যতার আভাস মিলেছে লকডাউনের প্রথমদিনে।
Advertisement
শুক্রবার (২৩ জুলাই) সরেজমিন রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, ভোর থেকেই মাঠে নেমেছে বিজিবি, র্যাব, পুলিশসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। লকডাউন চলাকালে জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বাইরে বের হলে তাদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণে ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে মাঠে নেমেছে ভ্রাম্যমাণ আদালত।
রাজধানীর ধানমন্ডি, নিউমার্কেট, শাহবাগ, মৎস্যভবন, গুলিস্তান, প্রেস ক্লাব, হাইকোর্ট, বঙ্গবাজার, বংশাল, ইংলিশ রোড, সদরঘাটসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, রাস্তাঘাটে মানুষের চলাচল অনেক কম। রিকশা ও ভ্যান ছাড়া কোনো যানবাহন চলছে না।
অধিকাংশ রাস্তাঘাটে জনশূন্য। মাঝে মাঝে কিছু প্রাইভেটকার ও অ্যাম্বুলেন্সকে দ্রুত গতিতে ছুটে যেতে দেখা যায়। বিভিন্ন এলাকায় ব্যারিকেড বসিয়ে পুলিশ সদস্যদেরকে প্রাইভেটকার ও অন্যান্য যানবাহনে তল্লাশি ও জিজ্ঞাসাবাদ করতে দেখা যায়।
রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট ও শাহবাগের সামনে চেকপোস্টে কর্তব্যরত দু’জন পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, বিধিনিষেধের প্রথমদিন শুক্রবার ও ঈদের ছুটি থাকায় রাস্তাঘাটে মানুষের উপস্থিতি খুবই কম। যারা বাইরে বের হয়েছেন, তারা জরুরি প্রয়োজনেই বের হয়েছেন।
Advertisement
পুলিশের এই কর্মকর্তা জানান, বিধিনিষেধের প্রথমদিনে আজ রিকশা ও ভ্যানে করে অসংখ্য মানুষকে চলাচল করতে দেখা যাচ্ছে। তারা গ্রামের বাড়ি থেকে ফিরেছেন। গণপরিবহন সকাল ৬টা থেকে বন্ধ থাকায় তারা রিকশা ও ভ্যানে করে বাসায ফিরছেন। বিষয়টি মানবিক দৃষ্টিতে দেখে তারা আপাতত কিছু বলছেন না।
তবে আগের তুলনায় এবার কঠোর বিধিনিষেধ হবে। কারণ বারবার বিধিনিষেধ দিয়ে তা কঠোরভাবে পালিত না হলে করোনা পরিস্তিতি নিয়ন্ত্রণে আসবে না বরং অর্থনৈতিক অবস্থা আরও খারাপ হবে। সর্বশেষ বিধিনিষেধে নানা অজুহাতে মানুষ বের হতে পারলেও এবার শাস্তির মুখে পড়তে হবে। এমনকি জেলও হতে পারে বলে তারা জানান।
২৩ দফা নির্দেশনায় যা আছে—
১. সব সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি অফিস বন্ধ থাকবে।
২. সড়ক, রেল ও নৌপথে গণপরিবহন (অভ্যন্তরীণ বিমানসহ) ও সব প্রকার যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকবে।
৩. শপিংমল/মার্কেটসহ সব দোকানপাট বন্ধ থাকবে।
৪. সব পর্যটন কেন্দ্র, রিসোর্ট, কমিউনিটি সেন্টার ও বিনোদন কেন্দ্র বন্ধ থাকবে।
৫. সব প্রকার শিল্প-কলকারখানা বন্ধ থাকবে।
৬. জনসমাবেশ হয় এ ধরনের সামাজিক (বিবাহোত্তর অনুষ্ঠান, ওয়ালিমা), জন্মদিন, পিকনিক, পার্টি ইত্যাদি) রাজনৈতিক ও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান বন্ধ থাকবে।
৭. বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট আদালতসমূহের বিষয়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা জারি করবে।
৮. ব্যাংকিং/বীমা/আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক/আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ প্রয়োজনীয় নির্দেশনা জারি করবে।
৯. সরকারি কর্মচারীরা নিজ নিজ কর্মস্থলে অবস্থান করবেন এবং দাফতরিক কাজ ভার্চুয়ালি (ই-নথি, ই-টেন্ডারিং, ই-মেইল, এসএমএস, হোয়াটসঅ্যাপসহ অন্যান্য মাধ্যম) সম্পন্ন করবেন।
১০. আইনশৃঙ্খলা এবং জরুরি পরিষেবা, যেমন- কৃষি পণ্য ও উপকরণ (সার, বীজ, কীটনাশক, কৃষি যন্ত্রপাতি), খাদ্যশস্য ও খাদ্যদ্রব্য পরিবহন/বিক্রয়, ত্রাণ বিতরণ, স্বাস্থ্য সেবা, কোভিড-১৯ টিকা প্রদান, জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) প্রদান কার্যক্রম, রাজস্ব আদায় সম্পর্কিত কার্যাবলি, বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস/জ্বালানি, ফায়ার সার্ভিস, টেলিফোন ও ইন্টারনেট (সরকারি-বেসরকারি), গণমাধ্যম (প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া), বেসরকারি নিরাপত্তা ব্যবস্থা, ডাক সেবা, ব্যাংক, ভিসা সংক্রান্ত কার্যক্রম, সিটি করপোরেশন/পৌরসভা (পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, সড়কের বাতি ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি কার্যক্রম), সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি, ফার্মেসি ও ফার্মাসিউটিক্যালসসহ অন্যান্য জরুরি/অত্যাবশ্যকীয় পণ্য ও সেবার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অফিসসমূহের কর্মচারি ও যানবাহন প্রাতিষ্ঠানিক পরিচয়পত্র প্রদর্শন সাপেক্ষে যাতায়াত করতে পারবে।
১১. বিভাগীয়, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তার কার্যালয় খোলা রাখার বিষয়ে অর্থ বিভাগ প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করবে।
১২. জরুরি পণ্য পরিবহনে নিয়োজিত ট্রাক/লরি/কাভার্ড ভ্যান/নৌযান/পণ্যবাহী রেল/ফেরি এ নিষেধাজ্ঞার আওতাবহির্ভূত থাকবে।
২৩. বন্দরসমূহ (বিমান, সমুদ্র, নৌ ও স্থল) এবং এ সংশ্লিষ্ট অফিসসমূহ এ নিষেধাজ্ঞার আওতাবহির্ভূত থাকবে।
১৪. কাঁচাবাজার এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত স্বাস্থ্যবিধি মেনে ক্রয়-বিক্রয় করা যাবে। সংশ্লিষ্ট বাণিজ্য সংগঠন, বাজার কর্তৃপক্ষ ও স্থানীয় প্রশাসন বিষয়টি নিশ্চিত করবে।
১৫. অতি জরুরি প্রয়োজন ছাড়া (ওষুধ ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি ক্রয়, চিকিৎসা সেবা, মৃতদেহ দাফন/সৎকার ইত্যাদি) কোনোভাবেই বাড়ির বাইরে বের হওয়া যাবে না। নির্দেশনা অমান্যকারীর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
১৬. টিকা কার্ড প্রদর্শন সাপেক্ষে টিকা গ্রহণের জন্য যাতায়াত করা যাবে।
১৭. খাবারের দোকান, হোটেল-রেস্তোরাঁ সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত খাবার বিক্রয় (অনলাইন/টেকওয়ে) করতে পারবে।
১৮. আন্তর্জাতিক ফ্লাইট চালু থাকবে এবং বিদেশগামী যাত্রীরা তাদের আন্তর্জাতিক ভ্রমণের টিকিট/প্রমাণক প্রদর্শন করে গাড়ি ব্যবহার করে যাতায়াত করতে পারবেন।
১৯. স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে মসজিদে নামাজের বিষয়ে ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয় নির্দেশনা প্রদান করবে।
২০. ‘আর্মি ইন এইড টু সিভিল পাওয়ার’ বিধানের আওতায় মাঠ পর্যায়ে কার্যকর টহল নিশ্চিত করার জন্য সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ প্রয়োজনীয় সংখ্যক সেনা মোতায়েন করবে। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট স্থানীয় সেনা কমান্ডারের সঙ্গে যোগাযোগ করে বিষয়টি নিশ্চিত করবেন।
২১. জেলা ম্যাজিস্ট্রেট জেলা পর্যায়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নিয়ে সমন্বয় সভা করে সেনাবাহিনী, বিজিবি/কোস্টগার্ড, পুলিশ, র্যাব ও আনসার নিয়োগ ও টহলের অধিক্ষেত্র, পদ্ধতি ও সময় নির্ধারণ করবেন। সেই সঙ্গে স্থানীয়ভাবে বিশেষ কোনো কার্যক্রমের প্রয়োজন হলে সে বিষয়ে পদক্ষেপ নেবেন। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়/বিভাগ এ বিষয়ে মাঠ পর্যায়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করবে।
২২. জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় মাঠ পর্যায়ে প্রয়োজনীয় সংখ্যক নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগের বিষয়টি নিশ্চিত করবে।
২৩. ‘সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইন, ২০১৮’ এর আওতায় স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক ব্যবস্থা নিতে জেলা প্রশাসন ও পুলিশ বাহিনীকে আইনানুগ কার্যক্রম গ্রহণের প্রয়োজনীয় ক্ষমতা প্রদান করবেন।
এমইউ/এএএইচ/এমএস