ঈদ-কোরবানি, জীবন-জীবিকা কোনোটাই ফেলনা হয়নি। ঈদ উদযাপন হচ্ছে। করোনাও রেস্টে বা ছুটিতে যায়নি, বিরতি দেয়নি। দাপটের সঙ্গে বীরত্ব দেখিয়ে যাচ্ছে। মানুষও দমেনি। অবিরাম জিতে চলছে সবাই। করোনা নামের দুনিয়া কাঁপানো মহামারিতে মৃত্যুঝুঁকি মাথায় নিয়ে জীবন-জীবিকার সব ক্রিয়াকর্মই চলমান। ঈদে বাড়তি মোজ-ফূর্তি। সমান্তরালে মৃত্যুও। একদিকে দাফনকাফন, আরেকদিকে রুটি, মাংস, পোলাও। গাসহাভাবে জীবন-জীবিকার অংশ হয়ে গেছে সবই। কোরবানির গরু বেচাকেনা, গরু হাইজ্যাক, গরু বেপারিকে হত্যাও বাদ পড়েনি। সীমিত জীবনের মধ্যে সবই সহ্যসীমার আওতায়। কিছুই যেন অস্বাভাবিক নয়।
Advertisement
এমন স্বাভাবিকতার জেরে কোরবানির হাটকে 'করোনার হাট' পড়তেও ভুল ঠেকে না। লকডাউন, কঠোর লকডাউন, শাটডাউন, বিধিনিষেধ ইত্যাদি আরোপ-প্রত্যাহারও যাপিত জীবনের অংশ হয়ে গেছে। এসব নিয়ে যে যা বলছেন সবই শুদ্ধ। আবার সবই প্রশ্নবিদ্ধ। সরকার গঠিত টেকনিক্যাল কমিটির বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ বলছেন, লকডাউনের এই শিথিলতার পরিণতি ভয়ংকর হবে। সংক্রমণ ৫০% বেড়ে যেতে পারে। মৃত্যু দ্বিগুণ হয়ে যেতে পারে। একই সময়ে ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক, প্রভাবশালী মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, বিশেষজ্ঞ-মতামতের ওপর ভিত্তি করেই প্রধানমন্ত্রী করোনা-নিয়ন্ত্রণে সিদ্ধান্ত নেন। যে যাকে পারছেন বরাত দিচ্ছেন। কোথাও আটকাচ্ছে না। শক্ত আপত্তিও আসছে না। টুকটাক এলেও তা ধোপে টিকছে না।
এমন নানান দিবস বা উপলক্ষের মতো এই কোরবানি দেয়া- না দেয়া নিয়ে কথা জমানোর চেষ্টা হয়েছিল এবারও। ইনিয়েবিনিয়ে বলার চেষ্টা চলেছে কোরবানি কী? না দিলেই বা কী? ধর্মবিষয়ে জ্ঞান না থাকলেও সময়ের ফোঁড় ও যুক্তিবলে কেউ কেউ কোরবানি না দিয়ে টাকাটা দানখয়রাত করার পরামর্শ দিতে শুরু করেছিলেন। করোনার কারণে গেলবার এবং এবার পরামর্শটা একটু বাজার পাওয়ার জো উঠবে বলে ধারণা থাকলেও শেষতক তা হয়নি। সামর্থ না থাকলেও কোরবানি দিতেই হবে-এমন বাধ্যবাধকতা ধর্মে নেই। যিনি দুঃস্থদের পাশে থাকেন, তিনি কোরবানি দিয়েও থাকেন। থাকতে পারেন। থেকেছেনও। আর যিনি থাকেন না, তিনি কোরবানি না দিয়েও থাকেন না। কোরবানি একটি এবাদত। নামাজ-রোজা আলাদা ইবাদত। আর দান-সদকা আলাদা আরেকটি। একটির বিকল্প আরেকটি হয় না।
দান-ত্রাণে সদিচ্ছা থাকতে হয়। ভাগে কোরবানিদাতা অথবা সীমিত আয়ের বেসরকারি চাকরি বা ছোট ব্যবসায়ীদের অনেকে সঙ্গত কারণে এ বছর কোরবানি দিতে পারেননি। অনেকে কোরবানির জন্য জমানো টাকা পরিবারের খরচ মেটাতে কিংবা কোভিড চিকিৎসায় খরচ করে ফেলছেন। তাদের জন্য মোটেই এই ইবাদতটি ফরজ নয়। কোরবানির একটা অর্থনীতিও আছে। এ সময় টাকার বিশাল লেনদেন হয়। কেউ গরু বিক্রি করে ছেলেমেয়ের বিয়ে দেন। কেউ ঘর বানান। ঋণ শোধ দেন। বন্দকী জমি ছাড়ান। সব জায়গায় বিশেষ করে যে কোনো ধর্মীয় দিবস বা উপলক্ষ নিয়ে বাড়তি চর্চা না করাই ভালো। তাতে কখনো কখনো মূর্খতার পাশাপাশি হিংস্রতা-নীচতার পরিচয় প্রকাশ পায়।
Advertisement
ত্যাগের মহিমায় জবাই হওয়া পশুর সংখ্যা বিবেচনায় কোরবানি কমেনি। কেউ কেউ ডাবল-ট্রিপলও দিয়েছেন। ফ্রিজ, রেফ্রিজারেটর বিক্রিও কমেনি। দেশে গরু-ছাগলের সংখ্যা বেড়েছে তথ্য-সাবুদ দিয়ে ঈদের আগে বলা হয়েছিল কোরবানির পশু নিয়ে কোনো সংকট হবে না। সত্যিই হয়নি। নাদুস-নুদুস গরু-ছাগলে ঈদে ঝাঁপিয়ে পড়েছে মানুষ। জবাই, কাটাকুটিতেও সমস্যা হয়নি। কতো নিত্যুনতুন ব্যবস্থা উদ্ভাবন হয়েছে। কোরবানির হাটে না গিয়েও পছন্দসই গরু-ছাগল মিলেছে। মানুষের উদ্ভাবিত বুদ্ধিতে গরু-ছাগলরা এবার পুরোপুরি ডিজিটাল প্লাটফর্মে উঠে গেছে। অনলাইনে এরা পৌঁছে গেছে ক্রেতার ঘরে। একেবারে জবাই এবং প্যাকিং করে ঘরে পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থাও প্রাতিষ্ঠানিকতা পেয়েছে। রান্নাটা বাকি এখনো। ভবিষ্যতে হতেও পারে। কন্ট্রাক্ট অনুযায়ী কেউ রান্না করা মাংস ঘরে ঘরে পৌঁছে দেয়ার সেবাবাণিজ্যের উদ্যোগ নিলে ব্যর্থ নাও হতে পারেন। বরং বাণিজ্যিক সাফল্যের সম্ভাবনা উজ্জ্বল।
গোটা পরিস্থিতি ও বাস্তবতা জীবন নির্ভরের পাশাপাশি জীবিকানির্ভরও। দিনশেষে অনেককিছু করোনা বান্ধবও। বড় সত্য হচ্ছে কোনো কিছুই ধ্রুব নয়। কোনো কথা শেষ কথা নয়। কোনো পরামর্শ এমনকি কোনো চিকিৎসাও আপেক্ষিক হয়ে গেছে। আজ এটা সত্য তো কাল আরেকটা সত্য। যোগফলে কেউ কারও জন্য অপরিহার্য নয়। কেউ চলে যাচ্ছে। কেউ বেঁচে যাচ্ছে। এরমাঝে আবার জন্মবিস্তারও হচ্ছে। বিয়ে-সাদীতো হচ্ছেই। অর্থটা দাঁড়াচ্ছে বেঁচে থাকার দায়িত্ব ব্যক্তিগত। আর মরে গেলে যিনি মরেছেন তিনিই দায়ী। অথবা বিধির বিধান। বিধি মানেই বিধান। বিধির প্রতিশব্দ ব্যবস্থা বা নিয়ম। আবার বিধি অর্থ নিয়তি। এরপরও করোনার এই উত্তপ্ত কড়াইতেও বড়াই কেবল বেমানান নয়। চরম মূর্খতার সঙ্গে খামখেয়ালিও।
বিশ্বে বিভিন্ন শতকে হানা দেয়া কলেরা, ম্যালেরিয়া, প্লেগ ইত্যাদি মহামারি রূপ পাল্টে দুর্বল হয়েছে। আর করোনা রূপ পাল্টে হচ্ছে আরো শক্তিধর। অবশ্য এই তোড়ে মহামারিটি আপাতত আমাদের হাত-মুখ ধোয়ার অভ্যাস গড়ে দিতে পেরেছে। কোনো রাষ্ট্রের পক্ষে তার নাগরিকদের অবিরাম বেত মেরে সিধা-সচেতন বানাতে পারে না। নাগরিকদেরও সভ্য হওয়ার ইচ্ছা থাকতে হয়। সুস্থ থাকা ও রাখার চর্চাও করতে হয়। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর জনগণকে উদ্দেশ করে বলতে হয় হাত-মুখ ধুয়ে পরিষ্কার থাকতে। কোন তলানিতে জনসচেতনতা? তবে হাঁচি-কাশি দিতে দিতে, দাঁত খোঁচাতে-খোঁচাতে সরকারের ভুলত্রুটি ধরার ওস্তাদিতে কেউ কারো চেয়ে কম নই।
ব্যক্তি পর্যায়ে মানুষকে সাফসুতরা রাখার দায়িত্ব সরকারের নয়। সরকারের পক্ষে সেটা সম্ভবও নয়। নিজেরা ভাইরাস ছড়ালে, জন্ম দিলে সরকার কী করবে? যত্রতত্র থুতু ফেলা, পানের পিক ফেলা এবং নাক ঝাড়া বন্ধ করতে সরকারের আদেশ-অনুরোধ লাগছে। তাও কাজে দিলে একটা কথা ছিল। গত কয়েক শতকেও মানবজীবনের গতিতে এমন ধকল আর আসেনি। করোনায় ২০২০ সাল থেকে জীবন-জীবিকায় জেঁকে বসা এমন দুর্গতি ১৯২০ সালে স্প্যানিশ ফ্লু, ১৮২০ সালে কলেরা বা ১৭২০ সালে প্লেগের সময়ও হয়নি। এরপরও কৌশল আর পরিকল্পনায় এগিয়ে গেছে মানুষ।
Advertisement
লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।
এইচআর/জেআইএম