ধর্ম

করোনায় কুরবানি ‘দেওয়া- না দেওয়া’য় করণীয় কী?

প্রাণঘাতী বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের এ সময়ে ঘনিয়ে আসছে কুরবানি। চাঁদের হিসাব অনুযায়ী আগামী ২১ জুলাই অনুষ্ঠিত হবে এ কুরবানি। কুরবানির প্রাদুর্ভাবের দ্বিতীয় ধাপে এবারের কুরবানির রূপরেখা কেমন হবে? কিংবা মহামারির এ সময়ে মানুষের কুরবানির ভাবনাই বা কেমন হওয়া উচিত? করোনায় কুরবানির করণীয় কী?

Advertisement

কুরবানি

ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত কুরবানি। আল্লাহর সঙ্গে বান্দার ভালোবাসার অনন্য প্রতীক এটি। এ কুরবানির মাধ্যমেই আল্লাহর নির্দেশ পালন ও ভালোবাসার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন মুসলিম জাতির পিতা হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম। হিজরি বছরের জিলহজ মাসের ১০, ১১ ও ১২ তারিখে  এ কুরবানি নির্ধারিত। মুসলিম উম্মাহর কাছে এটি খুশির দিন। এ দিনকে ঈদুল আজহা বলা হয়।

বিশ্বনবির ভাবনায় কুরবানি

Advertisement

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘ঈদুল আজহার দিনে পশু কুরবানির চেয়ে প্রিয় কোনো আমল আল্লাহ তাআলার কাছে নেই।'

কুরআনুল কারিমের ঘোষণা কুরবানি করাকে ইসলামের অন্যতম নিদর্শন বলা হয়েছে। অন্য যেসব আমলগুলো ইসলামের নিদর্শন, সেসব আমলগুলোর মধ্যেও কুরবানি অন্যতম। কুরআনুল কারিমে মহান আল্লাহ ঘোষণা করেন-

وَلِكُلِّ أُمَّةٍ جَعَلْنَا مَنسَكًا لِيَذْكُرُوا اسْمَ اللَّهِ عَلَى مَا رَزَقَهُم مِّن بَهِيمَةِ الْأَنْعَامِ فَإِلَهُكُمْ إِلَهٌ وَاحِدٌ فَلَهُ أَسْلِمُوا وَبَشِّرِ الْمُخْبِتِينَ

‘আমি প্রত্যেক উম্মতের জন্যে কুরবানি নির্ধারণ করেছি, যাতে তারা আল্লাহর দেওয়া চতুস্পদ জন্তু জবেহ কারার সময় আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে। অতএব তোমাদের আল্লাহ তো একমাত্র আল্লাহ সুতরাং তাঁরই আজ্ঞাধীন থাক এবং বিনয়ীগণকে সুসংবাদ দাও।’ (সুরা হজ : আয়াত ৩৪)

Advertisement

মুসলিম উম্মাহর জন্য পশু কুরবানি করা হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালামের সুন্নাহ। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে কুরবানি করেছেন। তাঁর উম্মতকে কুরবানি করতে উৎসাহিত করেছেন।

মানুষের জিজ্ঞাসা

করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের মধ্যে দ্বিতীয় বারের মতো ঘনিয়ে আসছে কুরবানি। চাঁদের হিসাব অনুযায়ী আগামী ২১ জুলাই অনুষ্ঠিত হবে এ করবানি। এবারের কুরবানি নিয়েও রয়েছে মানুষের অনেক জিজ্ঞাসা। তাহলো-

১. কুরবানির পশুর হাট মানুষের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে । তাই সেক্ষেত্রে বিকল্প কী পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে?

২. এবার করোনায় কুরবানি না করে এ টাকা গরিব-অসহায়দের মাঝে দান করায় কুরবানির হক আদায় হবে কি?

৩. অনেকেই প্রতি বছর স্বাভাবিকভাবেই কুরবানি করতেন, এবার অর্থ সংকটের কারণে কুরবানি করা সম্ভব হচ্ছে না, তাদের জন্য করণীয় কী হতে পারে?

৪. দেশের বাইরে প্রবাসে এমন অনেক লোক আছেন যারা এবার পরিস্থিতির কারণে কুরবানি করতে পারছেন না, তারা এ দায় থেকে কীভাবে বেঁচে থাকবেন?

করোনায় কুরবানিতে করণীয় হলো-

ইসলামিক স্কলারদের মতে, কুরবানি মুসলিমদের এমন একটি ইবাদত, যা বছরে একবার হয়ে থাকে। এর কুরবানির সঙ্গে প্রায় সব মুসলিমদের সম্পৃক্ততা রয়েছে।

যারা কুরবানি দিতে পারেন তাদের যেমন সম্পৃক্ততা রয়েছে তেমনি যারা কুরবানি দিতে পারে না এমন সব অভাবি মানুষের সম্পর্কও রয়েছে এ কুরবানির সঙ্গে। তারা সারা বছর গরু/খাশির গোস্ত কিনে খেতে পারেন না। কুরবানির সময়ই তারা চাহিদা মিটিয়ে গোশ্ত খেতে পারেন। আর এতে ধনী-গরিবের মিলন হয় বৈষম্য দূর হয়। ভ্রাতৃত্বের বন্ধন ও আন্তরিকতা তৈরি হয়।

সুতরাং কুরবানি হচ্ছে- ইবাদত। গরিব-দুঃখীর অধিকার। ব্যবসায়ীদের জীবন-জীবিকায় বিনিয়োগ। তাই এসব বিবেচনায় কুরবানির সময় যথাযথ স্বাস্থ্য নিরাপত্তার মাধ্যমে এটি অব্যাহত রাখাই জরুরি।

বিকল্প পদক্ষেপ…

করোনায় নিরাপদ থাকতে প্রয়োজনে সম্ভব হলে বাজারে না গিয়ে অনলাইনে পশু কেনাবেচা করা যেতে পারে। সম্প্রতি সময়ে দেশের বাস্তবতায় এটি সব ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। তবে এ দাবিটিও সম্পূর্ণ রূপে উড়িয়ে দেয়া না গেলেও এটি এখনও শহর থেকে শহরতলী ও গ্রাম-পল্লীতে সেভাবে বিকশিত হয়নি। গ্রামের মানুষ অনলাইনে কেনাবেচার বিষয় ও পদ্ধতি সেভাবে এখনও বুঝে উঠতে পারেনি। এ পদ্ধতিতে কেনাবেচাও অনেকটাই কঠিন হয়ে যাবে।

এক্ষেত্রে করণীয় ও ইসলামিক স্কলারদের প্রস্তাবনা হলো-

বড় বড় শহরগুলোতে অনলাইনে পশু কেনাবেচা করলে বড় বড় শহরের এসব ব্যস্ত জনপদ অনেকটাই নিরাপদ থাকবে।

আর গ্রামাঞ্চলে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে পশুর হাট বসবে। তবে সেখানে অবশ্যই যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ব্যবস্থা করতে হবে। যাতে কারো স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়তে না হয়। আর তাতে আশা করা যায়, মানুষ নিরাপদ থাকবে।

কুরবানি না করে দান করার বিষয়টি কী?

যদি কেউ কুরবানি না করে সে অর্থ (টাকা-পয়সা) দান করে দেয় তাতে পশু কুরবানির দায়িত্ব থেকে অব্যহতি পাওয়া যাবে কি না। আর তাতে আমাদের করণীয় কী?

ইসলামি শরিয়া ও স্কলারদের মতে, এ বিষয়টিতে সুস্পষ্ট ও সরল উত্তর হলো- কুরবানি না করে এ টাকা দান করে দেয়া হলে কুরবানির আমল বা ইবাদত থেকে দায়মুক্তি হবে না। তাতে কুরবানির হক আদায় হবে না।

করোনার আগে কুরবানি দেয়া ব্যক্তি অর্থকষ্টের কারণে কুরবানি দিতে পারছে না, এতে তার করণীয় কী?

তাদের জন্য সহজ উত্তর : অন্য বছরগুলোতে কুরবানি দিয়েছেন। কিন্তু এখন অর্থকষ্ট বা অভাবের কারণে কুরবানি দিতে পারছে না, তারা এ বছর কুরবানি দেবেন না। ইসলামি শরিয়াহ কারো সাধ্যের অতিরিক্ত কোনো আমল বা চাপিয়ে দেয় না। ওই আমল করতে বাধ্য করে না।

কুরবানিকে সামাজিক ইস্যু মনে না করা

এমন অনেক লোক আছেন যারা স্বাভাবিকভাবে কুরবানি দেয়ার ক্ষমতা রাখে না। কিন্ত সামাজিক লোক-লজ্জার ভয়ে চরম চাপ নিয়ে কুরবানি করে থাকেন। আসলে সামাজিক লোক-লজ্জার ভয় বা ইজ্জত-সম্মানের কারণে কুরবানি দিতে হয়, এমনটি সঠিক নয়, বরং এটি মানুষের ভুল ধারণা। সুতরাং অর্থকষ্ট থাকলে এবং সামর্থ্য না থাকলে কুরবানি না করায় কোনো সমস্যা নেই।

তবে তাদের জন্য সুসংবাদ

যারা সামর্থ্য থাকাকালীন সময় কুরবানি পালন করে ইবাদত করেছেন, এখন সামর্থ্য না থাকার কারণে যদি কুরবানি করতে না পারেন, তাতেও আল্লাহ তাআলা ওই ব্যক্তিকে কুরবানির সাওয়াব দিয়ে দেবেন। এটি নিয়ে সাময়িক সামর্থ্যহীন ব্যক্তিদের মন খারাপ করার কোনো কারণ নেই।

প্রবাসে অবস্থানকারীদের কুরবানি

বিদেশে এমন অনেক মুমিন মুসলমান রয়েছেন, যারা এমন জায়গায় আছেন যেখানে হয়তো কোনো বিধি-নিষেধ, আইনি জটিলতা বা করোনার সংক্রান্ত কোনো কারণে কুরবানি দিতে পারছেন না। তাদের করণীয় কী?

তাদের করণীয় হলো-

যেখানে অবস্থান করছেন, যদি সেখানে কুরবানি করতে না পারেন তবে নিজ নিজ দেশে কিংবা পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তে কুরবানি করার সুযোগ রয়েছে এবং আপনার লোকজন রয়েছে তাদের মাধ্যমে দায়িত্ব দিয়ে কুরবানি আদায় করা। কুরবানির জন্য নির্ধারিত পরিমাণ টাকা পাঠিয়ে দিলে তার পক্ষ থেকে যে কেউই কুরবানি দিতে পারবেন। কুরবানির গোশ্তগুলো নির্দেশিত ব্যক্তিদের মাঝে বণ্টন করে দিয়েও কুরবানি আদায় করা যাবে। এভাবে তারা কুরবানির ইবাদত ও আমল থেকে মুক্ত হতে পারবেন।

সুতরাং মুসলিম উম্মাহর উচিত, মহামারি করোনার প্রাদুর্ভাবের দ্বিতীয়ধাপের এ সময়ে যথাযথ নিয়ম মেনেই কুরবানি করার ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি।

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে করোনাকালীন এ সময়ে যথাযথভাবে কুরবানি করে তার নৈকট্য ও সন্তুষ্টি লাভের তাওফিক দান করুন। করোনাকালীন সময়ে যথাযথ নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য সচেতনার প্রতি লক্ষ্য রাখার তাওফিক দান করুন। করোনার অজুহাত দিয়ে কুরবানি না করে দান খয়রাত করে কুরবানি হক আদায় হয়ে গেছে মনে করা থেকেও বিরত থাকার তাওফিক দান করুন। আমিন।

এমএমএস/জেআইএম