মতামত

একজন কিশোয়ার এবং বাঙালির আত্মপরিচয়

নাদেরা সুলতানা নদী

Advertisement

আমাদের সুগন্ধী আতপ চালের পোলাও যখনই সুযোগ এসেছে ভিনদেশি বন্ধুদের চিকেন কোর্মা বা রোস্ট দিয়ে যতবার খেতে দিয়েছি সবাই শুধু বলেছে এই রকম মজার কোন খাবার হয় তাঁদের জানাই ছিল না। সুযোগ এলেই যেন আবার করি। আমাদের আগ বাড়িয়ে বলতে হয়, এই চাল শুধুই আমাদের। আমাদের বলতে হয় এই খাবারগুলো শুধুই বাঙালির, বাংলাদেশিদের। এইগুলো ভারতীয় বা অন্য এশিয়ান খাবার থেকে আলাদা।

এই গল্পগুলো বোধ হয় প্রবাসে থাকা অনেকেরই গল্প। থাক এই গল্প তোলা আজ। বলতে এলাম, হঠাৎ অস্ট্রেলিয়া থাকা বাংলাদেশীদের সামনে ঘটে যাওয়া এই খাবার নিয়েই যা রচিত হয়ে গেল, সেই গল্প। যার নাম ‘’কিশোয়ার চৌধুরী’’। মাস্টার শেফ অস্ট্রেলিয়া ২০২১ এ অংশ নেয়া একজন হয়েই তিনি নিজেই হয়ে উঠেছেন এক গল্প।

যাদের জানা নেই, ছোট করে বলে নেই ভূমিকাটা। কিশোয়ার চৌধুরী, বাংলাদেশি বাবা, মুক্তিযোদ্ধা কামরুল চৌধুরী এবং বাঙালি মা লায়লা চৌধুরীর অস্ট্রেলিয়ান বাংলাদেশি মেয়ে। যে থাকে আমি যে শহরে আছি সেখানেই। মেলবোর্ন, ভিক্টোরিয়া। মূলতঃ তিনি বাবার বিশাল প্রিন্টিং বিজনেস দেখাশুনা করেন এবং রান্না নিয়ে পরিবার থেকেই পেয়েছেন সকল অনুপ্রেরণা। আগ্রহ ছিল বিশেষভাবে বাংলা খাবারে। যখনই দেশে বেড়াতে গেছেন তখনই দেখেছেন খুব কাছ থেকে এবং সেই বিয়ের পর যখন বরকে নিয়ে বেড়াতে গেছেন রাঙ্গামাটি সেখানে গিয়ে খেয়েছেন এমন একটি আইটেমও তিনি তুলে নিয়ে এসেছেন রান্নার এই প্রতিযোগিতায়।

Advertisement

ফাইনাল পর্বটি ছিল দুইদিন ব্যাপী। মূল বিচারক তিন জন ছাড়াও সাথে যোগ দেন বিভিন্ন সময় সেরা মাস্টারশেফসহ আরো অনেক নামকরা শেফ, তাঁদের আনা কোন না কোন উপকরণ এবং লটারির মাধ্যমে উঠিয়ে আনতে হয়েছে রান্নার মাধ্যম ও নিজস্ব কোন আইটেম। এরই এক পর্বে সেরা ডিশের একটি ছিল, আলু ভর্তা, পান্তা ভাত, যাকে স্মোকি রাইস বলা হয়েছে, সাথে সার্টিন মাছ ভাঁজা, সরিষার তেলে পেঁয়াজ কাঁচা মরিচের অপরূপ গার্নিস... যা তিন বিচারকের কাছে দশে দশ পেয়ে পুরো ৩০ পেয়েছে এবং প্রথম পর্বের পর তার প্রাপ্ত মূল নাম্বারে সে ছিল দ্বিতীয় অবস্থানে।

বলে নেই চূড়ান্ত পর্বের আগে পারি দিতে হয়েছে ৫৭টি পর্ব, প্রমাণ করতে হয়েছে একের পর এক আইটেম দিয়ে নিজের বিশেষত্ব। এর আগে যে রান্নাগুলো নিয়ে এসেছেন বিচারকদের বেঁধে দেয়া নিয়মের মাঝেই তার মাঝে নজর কেড়েছে লাউ চিংড়ি, পোড়া বেগুন ভর্তা, মাটন কোর্মা, চাটনি এবং খিচুড়ির মত বেশ কিছু খাঁটি বাংলা খাবার।

গতকাল ফাইনালের চূড়ান্ত পর্বে নামকরা শেফ পিটার গিলমোরের বেঁধে দেয়া রেসিপি অনুযায়ী নাট ক্যারামেল গোল্ডেন ক্র্যাকল কেক এবং স্কুইড কাস্টার্ড নুডুলস বানাতে হল। সময়মতো শেষ করতে পেরেছে কিশোয়ার এবং পেয়েছে বিচারকদের প্রশংসাও। কিন্তু ফলাফল বিচারে ফিজিয়ান ইন্ডিয়ান বংশোদ্ভূত জাস্টিন নারায়ণ জিতে নিলো এবারের মাস্টারশেফ শিরোপা। প্রথম রানার আপ অস্ট্রেলিয়ান আরেক তরুণ পিট এবং দ্বিতীয় রানার আপ হয়েছে আমাদের কিশোয়ার চৌধুরী।

এই ফলাফল বা এর অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতার বিস্তারিত আর নাই বলি, যে কথা বলতেই চাই, এই প্রথমবার এই রকম একটি শোয়ের মাধ্যমে যা উঠে এসেছে কিশোয়ার চৌধুরী, আমাদের আত্মপরিচয়ের গুরুত্ব নূতন করে অনুধাবন করার অনুপ্রেরণামূলক এক নাম। খাবার সংস্কৃতি, যা কিছু আমাদের শেকড়, আমাদের নিজস্বতা, স্বকীয়তা, বাংলার, বাংলাদেশের, তা প্রথমবারের মত অস্ট্রেলিয়ার বুকে কেউ এত গৌরবের সাথে অনন্য এক উচ্চতায় তুলে আনলেন।

Advertisement

প্রবাসী বাংলাদেশি, অস্ট্রেলিয়ান বাংলাদেশিদের কাছে তো বটেই কিশোয়ারের নাম বাংলাদেশসহ পুরো বিশ্বে বাংলাদেশিদের কাছে যে নূতন পরিচয় বহন করছে তা দেখে গত কদিন ধরেই কিশোয়ারের শহরে থাকা বাংলাদেশি হিসেবে অনেক বেশি রোমাঞ্চিত হয়ে আছি লাখো বাংলাদেশিদের একজন হয়ে।

কিশোয়ার, এক সাহসের নাম, ভালোবাসার নাম এবং আমাদের কাছে মাস্টার শেফ, অস্ট্রেলিয়া ২০২১ টপ থ্রি এক ফাইনালিস্ট হয়েই সে চ্যাম্পিয়ন!! কিশোয়ার যে পথ দেখিয়ে গেছে আমি নিশ্চিত এই পথে কাল, পরশু অন্য অনেকেই হেঁটে যাবে বহুদূর! কিশোয়ার, আমাদের বাংলা খাবারকে আলাদা করে চিনিয়েছে এবং যে সম্মাননা এনে দিয়েছে তাতে সেই হয়ে থাকবে অন্যতম পথ প্রদর্শক।

কিশোয়ার তার প্রতিটি পরিবেশনায়ই এনেছে বাংলা বাংলাদেশ এই পরিচয়কে। উচ্চারিত হয়েছে বিচারকদের মুখে বাংলা কুইজিন আলাদা করে। জানিয়েছে সে একজন অস্ট্রেলিয়ান, তার বাবা মা যেসব খাবার বাংলাদেশে খেয়েছে তার অনেক কিছু তাকে স্পর্শ করেছে বলেই সে এইসব রান্না ভালোবেসেছে এবং সে আবেগ আপ্লুত হয়ে সব সময়ই বলেছে সে চায় তার সন্তানদের জন্যে একটি রেসিপি বুক সে রেখে যাবে যেখানে তার অস্ট্রেলিয়ান বাচ্চারা তাঁকেও খুঁজে পাবে।

কিশোয়ার শুরু থেকেই ভীষণ রকমের আবেগী হয়ে অনেকবারই তার ছোট ছোট প্রকাশে চোখ ভিজিয়েছে, অনেকবার তার সেই প্রকাশ বিচারকদেরও ছুঁয়ে গেছে এবং সবটুকু একাত্মতা প্রকাশও করেছে। তার কণ্ঠের উপচে পড়া আবেগ ছলছল চোখের মানে আমাদের মত সকল প্রবাসী পরবাসীদের খুব জানা, আমরাই জানি কেন ভেজে চোখ যখন তখন!

মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া

এইচআর/জিকেএস