আজ ১০ ডিসেম্বর (বৃহস্পতিবার)। বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ মো. রুহুল আমিনের ৪৪তম শাহাদাত বার্ষিকী। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য যে ৭ জন বীরশ্রেষ্ঠ খেতাবে ভূষিত হয়েছিলেন তাদের অন্যতম নোয়াখালীর সোনাইমুড়ী উপজেলার দেওটি ইউনিয়নের বাগপাঁচড়া গ্রামের রুহুল আমিন। যুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয়ের মাত্র ৬ দিন আগে এ দিনে খুলনার রূপসায় শাহাদাত বরণ করেন এই বীর যোদ্ধা। স্বাধীনতার ৪৪ বছরের মধ্যে এ বীরের নামকরণে কিছু স্থাপনা ও প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করা হলে নানা সমস্যা, অযত্ন আর অবহেলার কারণে এগুলো দিন দিন ম্লান হয়ে যাচ্ছে।বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ মো. রুহুল আমিনের ৪৪তম শাহাদাত বার্ষিকী উপলক্ষে সকাল ১০ টায় বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ মো. রুহুল আমিন গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর মিলনায়তনে জাতীয় পতাকা উত্তোলন, বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ রুহুল আমিনের মুর্যালে পুস্পস্তবক অপর্ণ, তার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এক মিনিট নিরবতা পালন, আলোচনা সভা, মিলাদ মাহফিল ,দুস্থদের মাঝে খাবার বিতরণ করা হবে। স্বাধীনতার ৩৬ বছর পর নুতন প্রজন্মের মাঝে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছড়িয়ে দিতে এবং বীর সন্তানদের অবদানকে স্মরণীয় করে রাখতে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উদ্যোগে নোয়াখালীর সোনাইমুড়ী উপজেলার দেওটি ইউনিয়নে রুহুল আমিননগর গ্রামে নির্মাণ করা হয় বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ মো. রুহুল আমিন গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর। ২০০৮ সালের ১১ মার্চ (স্বাধীনতার মাস) আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয় গ্রন্থাগারের। তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মো. আনোয়ারুল ইকবাল বিপিএম(বার), পিপিএম প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। স্মৃতি জাদুঘর ও পাঠাগারের উদ্বোধন করেন মুক্তিযুদ্ধের উপ-সর্বাধিনায়ক বর্তমানে পরিকল্পনা মন্ত্রী এয়ার ভাইস মার্শাল একে খন্দকার বীরত্তম (অব.)। নোয়াখালী জেলা পরিষদ ও এলজিইডি এর মাধ্যমে ৬২ লাখ ৯০ হাজার টাকা ব্যয়ে বীরশ্রেষ্ঠ রহুল আমিনের পরিবারের দেয়া ২০ শতাংশ জমিতে এই জাদুঘরের নির্মাণ কাজ ২০০৭ সালের ২০ জুলাই শুরু হয়। আর তখন এর ভিত্তিপ্রস্তর ফলক উন্মোচন করেন সাবেক সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল মইন উ আহম্মেদ। এদিকে স্বাধীনতার ৩৬ বছর পর সোনাইমুড়ী উপজেলার দেওটি ইউনিয়নের বাগপাঁচড়া গ্রামে বীরশ্রেষ্ঠ রহুল আমিনের জন্মস্থানে আধুনিক ও উন্নতমারে গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে পশ্চাদপদ এ গ্রাম বর্তমানে কিছুটা হলেও আলোকিত হয়েছে। পাশাপশি এ অঞ্চলের তরুণ ও যুব সমাজ বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী প্রজন্ম মহান মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদদের অবদান এবং সঠিক ইতিহাস সর্ম্পকে ধারণা পাচ্ছে। প্রতিদিন জেলা উপজেলা ও দূর দূরান্ত থেকে অসংখ্য শিক্ষার্থী-মুক্তিযোদ্ধাসহ বিভিন্ন পেশার লোকজন সপরিবারে এ গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর দেখার জন্য আসছেন। আগত দর্শনার্থীরা ঘুরে ঘুরে গ্রন্থাগার ও জাদুঘরের রাখা বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিনের বিভিন্ন দুর্লভ ছবি দেখের এবং মহান মুক্তিযুদ্ধ সর্ম্পকে লেখা দেশের বিভিন্ন নামকরা লেখকের বই পড়ে মুগ্ধ হন। এছাড়া ২০০৭ সালের ১৮ ডিসেম্বর তৎকালীন নৌবাহিনীর প্রধান ভাইস এডমিরাল সরওয়ার জাহান নিজাম এনডিইউ,পিএসসি ও বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ রুহুল আমিন গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর পরিদর্শন করেছেন। তিনি এ সময়ে গ্রন্থাগারের জন্য দুটি কমপিউটার, বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিনের ছোট ছেলে শওকতের হাতে ১ লাখ টাকা চেক, বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিন দারুর উলুম এতিমাখানার জন্য ৫০ হাজার টাকার আর্থিক অনুদান প্রদান করেন।বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিনের আত্মীয়রা জানান, ১৯৩৪ সালে বাগপাঁচড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন রুহুল আমিন । তারা ছিলেন ৭ ভাই বোন। শিক্ষা জীবন শুরু করেন বাগপাঁড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তারপর তিনি ভর্তি হন আমিশাপাড়া কৃষক বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ে। ১৯৫১ সালে নৌবাহিনীতে নায়েক হিসেবে চাকরি জীবন শুরু করেন। যুদ্ধকালীন অসুস্থ হয়ে মারা যান তার বাবা আজহার মিয়া এবং মা জাকিয়া খাতুন। বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিনের তিন মেয়ে ও দুই ছেলের মধ্যে বড় ছেলে মারা গেছেন। তিন মেয়ে চট্রগ্রামের পাহাড়তলিতে ফিরোজ শাহ কলোনিতে নৌবাহিনীর দেয়া বাড়িতেই থাকেন।চট্রগ্রাম বিভাগের মধ্যে একমাত্র বীরশ্রেষ্ঠ খেতাবপ্রাপ্ত রুহুল আমিনের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বেগমগঞ্জ উপজেলার চৌরাস্থায় একটি স্মৃতিস্তম্ভও তৈরি করা হয়েছে। পুরাতন সে স্মৃতিস্তম্ভ ভেঙে ওই স্থানে নুতন ও আধুনিক আরও একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু স্মৃতি স্তম্ভটি বছরের বেশির ভাগ সময় রাজনৈতিক দল আর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ব্যানার পোস্টারের দখলে থাকে। প্রশাসনের উদ্যোগে বছরে দুইবার এটি পরিষ্কার করা হলে বাকী সময় থাকে ধুলো-বালিতে ঢাকা। প্রশাসনের নাকের ডগায় মহান মুক্তিযুদ্ধের বীরের প্রতি এমন অসম্মানে অপমানিতবোধ করছে বীরশ্রেষ্ঠের পরিবার ও মুক্তিযোদ্ধারা। এ নিয়ে এলাকার মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে ক্ষোভ রয়েছে। সরেজমিন বীরশ্রেষ্ঠ রহুল আমিন স্মৃতি জাদুঘর ও গ্রন্থাগারে গেলে এর কেয়ারটেকার আলাউদ্দিন বলেন, ২০১২ সালের পর থেকে গ্রন্থাগারে নতুন কোনো বই আসেনি। তাছাড়া প্রথমে দুই তিনটি পত্রিকা রাখা হলেও এখন টাকার অভাবে রাখা হচ্ছে না। ফলে দূর দূরান্ত থেকে দর্শনার্থীরা এসে হতাশ হন। এছাড়া জাদুঘরটিও নাম মাত্রই আছে।দশনার্থী মোহাম্মদ সবুজ বলেন, এখানে শহীদ রুহুল আমীনের ও মুক্তিযুদ্ধের সর্ম্পকে বিভিন্ন ধরনের বইয়ের স্বল্পতা রয়েছে। আরও বেশি বই থাকা দরকার। বীরশ্রশ্রেষ্ঠ শহীদ রুহুল আমিনের নাতি সোহেল চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, বিভিন্ন সঙ্কটের পাশপাশি এখানে দীর্ঘ দিন ধরে লাইব্রেরিয়ান নিয়োগ দেয়া হয়নি। বার বার আবেদন করে কোনো ফল পাওয়া যায়নি। বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সোনাইমুড়ী অন্ধ কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক গোলাম মোস্তফা ভূঁইয়া বলেন, ৭ জন বীরশ্রেষ্ঠের মধ্যে শহীদ মো. রুহুল আমিনের জন্ম স্থান আমাদের এই উপজেলায় হওয়াতে আমরা সব সময় গর্ববোধ করি।তিনি আরও বলেন, বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিন স্মৃতি গ্রন্থাগার ও জাদুঘর যে লক্ষে তৈরি করা হয়েছে সে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নতুন প্রজন্মের কাছে ছড়িয়ে দিতে হলে বিদ্যমান সমস্যাগুলো সমাধানে সরকার দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন। প্রসঙ্গত, শহীদ মো. রুহুল আমিন ১৯৫১ সালে পাকিস্তান নৌবাহিনীতে আর্টিফিসার পদে যোগদান করেন এবং দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন। পাকিস্তান নৌবাহিনীর জাহাজ পিএনএস বাবর এবং পিএনএস খাবারে যোগ্যতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করা শুভেচ্ছা সফরে ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মান, অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশ ভ্রমণের সুযোগ লাভ করেন। ১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় তিনি চট্রগ্রাম নৌঘাঁটির অধীনে পিএনএস আর এ-১ ইঞ্জিন অফিসার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ৯ডিসেম্বর `৭১সালে খুলনার পাকিস্থানি নৌঘাঁটি তিতুমীর দখলের জন্য মুক্তিবাহিনীর রণতরী ‘পলাশ’, ‘পদ্মা’ এবং ভারতীয় রণতরী ‘ পারভেন’ বীরবিক্রমে হিরন পয়েন্টে প্রবেশ করে। ১০ ডিসেম্বর সকাল ৭ টায় বিনা বাধায় রণতরীগুলো মংলা বন্দরের কাছাকাছি পৌঁছে গেল। বিজয় প্রায় অবধারিত। কিন্তু দুপুর ১২টার দিকে কিছু হানাদার জঙ্গী বিমান আকাশে উড়ে এলো। মুক্তিবাহিনীর অসীম সাহসী নৌযোদ্ধাদের রণতরী হতে জঙ্গী বিমানের উপর গুলি করার অনুমতি চাইল। কিন্তু অনুমানে ভুল করে ভারতীয় অধিনায়ক গুলি করার অনুমতি দিলেন না। ততক্ষণে শত্রুর জঙ্গী বিমান হতে মুক্তিবাহিনীর রণতরীর উপর গোলাবর্ষণ শুরু হয়ে গেল। শত্রুর আক্রমণে রণতরী পদ্মা ধ্বংস হয়ে গেল।বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিন তখনও রণতরী পলাশের ইঞ্জিন পরিচালনা করে যাচ্ছেন। পলাশের ভারতীয় অধিনায়ক রণতরী ত্যাগের আদেশ দিলেন। নাবিকেরা রণতরী ত্যাগ করলো। কিন্ত বীরমুক্তিযোদ্ধা রুহুল আমিন রণতরী ত্যাগ করে পরাজয়ের গ্লানি বরণ করতে রাজি হলেন না। রণতরী ফিরে এসে শত্রুদের উপর গুলিবর্ষণ করার জন্য তিনি সহযোদ্ধাদের প্রতি আকুল আবেদন জানালেন। রুহুল আমিনের আহ্বানে সাড়া দিতে যাচ্ছিল সহযোদ্ধারা কিন্তু ততক্ষণে পশ্চিম দিক হতে একটি জঙ্গী বিমান এসে পলাশের ইঞ্জিন রুমে গোলাবর্ষণ করলো। শক্রর গোলার আঘাতে পলাশের ইঞ্জিন রুম বিদগ্ধ হয়ে গেল। রণতরীতে রক্ষিত গোলাবারুদে আগুন ধরে গেল। রক্তাক্ত হয়ে গেলেন রুহুল আমিন।গোলার আঘাতে তার ডান হাত ভেঙে গেল। এ অবস্থায় ইঞ্জিনে থাকা নিরাপদ নয় ভেবে তিনি নদীতে ঝাঁপ দিলেন এবং আহত অবস্থায় ডাঙায় উঠতে চাইলেন। কিন্তু পাকিস্তানী হানাদার দোসর বাঙালির শত্রু ঘৃণ্য রাজাকারেরা তাকে বাঁচতে দিল না। তাদের অমানুষিক নির্যাতন আর অত্যাচারে শহীদ হলেন বাংলার শ্রেষ্ঠ সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধা রুহুল আমিন। তারপর খুলনার রূপসার বাঘমারা গ্রামের হৃদয়বান আবদুল গাফফার গ্রামবাসীদের সহযোগিতায় পূর্ব রূপসার চরে বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিনকে কবরস্থ করেন। পরবর্তীতে সরকার স্বাধীনতা যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য তাকে বীরশ্রেষ্ঠ উপাধিতে ভূষিত করেন।এসএস/পিআর
Advertisement