দেশজুড়ে

করোনা পজিটিভ হয়েও শপথ অনুষ্ঠানে যোগ দিলেন ইউপি চেয়ারম্যান

বরিশালের বাকেরগঞ্জ উপজেলার কবাই ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. জহিরুল হক তালুকদারের বিরুদ্ধে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের তথ্য গোপন করে শপথ নেয়ার অভিযোগ উঠেছে।

Advertisement

মঙ্গলবার (১৩ জুলাই) দুপুরে জেলার ৪৮টি ইউনিয়ন পরিষদের নবনির্বাচিত চেয়ারম্যানদের সঙ্গে তিনি নিজেও সশরীরে বরিশাল সার্কিট হাউজ সম্মেলন কক্ষে উপস্থিত থেকে শপথবাক্য পাঠ করেন। তাদের শপথবাক্য পাঠ করান জেলা প্রশাসক জসীম উদ্দীন হায়দার।

শপথ বাক্যপাঠের পর তিনি অন্যদের সঙ্গে শুভেচ্ছ বিনিময় করেন। জহিরুল হক তালুকদারের করোনা পজিটিভ শনাক্তের বিষয়টি না জানার কারণে অনেকেই তার কাছাকাছি এসেছেন। ছবি তুলেছেন। বুধবার (১৪ জুলাই) দুপুরে তার করোনা আক্রান্তের খবর জানাজানি হলে সমালোচনা শুরু হয়।

শপথবাক্য পাঠ অনুষ্ঠানে ৪৯টি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানরা ছাড়াও জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের স্থানীয় সরকার শাখার উপপরিচালক মো. শহিদুল ইসলাম, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) বরিশাল প্রশান্ত কুমার দাস, সিনিয়র জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মোহাম্মাদ নূরুল আলমসহ অন্যান্যরা উপস্থিত ছিলেন।

Advertisement

নির্ভরযোগ্য একাধিক সূত্রে জানা গেছে, জহিরুল হক তালুকদার ও তার স্ত্রী আসমা বেগমের শরীরে করোনার উপসর্গ দেখা দেয়ায় গত ২ জুলাই নগরীর একটি হাসপাতালের একজন প্যাথোলজিস্টের মাধ্যমে তারা নমুনা দেন। ওইদিনই তাদের নমুনা পরীক্ষার জন্য বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ আরটি-পিসিআর ল্যাবে পাঠানো হয়। ৪ জুলাই তাদের রিপোর্ট পজিটিভ আসে। ওইদিন থেকে তারা নগরীর মধুমিয়ার পোল সংলগ্ন বাসায় কোয়ারেন্টাইনে ছিলেন।

এর আগে গত ২১ জুন অনুষ্ঠিত বাকেরগঞ্জ উপজেলার কবাই ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে জহিরুল হক তালুকদার বিজয়ী হন।

প্রথম ধাপে বরিশাল জেলার আরও ৪৯টি ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই নির্বাচনে জয়ী চেয়ারম্যানদের শপথবাক্য পাঠের জন্য ১৩ জুলাই তারিখ নির্ধারণ করা হয়। বিষয়টি জানতে পেরে তিনি ১১ জুলাই বাকেরগঞ্জ গিয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাধবী রায়ের সঙ্গে দেখা করেন। তিনি করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন বলে জানান। এসময় বলেন এখন তিনি পুরোপুরি সুস্থ। তবে কতদিন আগে আক্রান্ত হয়েছেন সে বিষয় ইউএনও মাধবী রায়কে কিছুই জানাননি জহিরুল হক তালুকদার।

সূত্র আরও জানায়, ইউএনও মাধবী রায় তাকে নমুনা পরীক্ষা করিয়ে নেগেটিভ আসলে শপথ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে বলেন। এসময় ইউএনও মাধবী রায় উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা শঙ্কর প্রসাদ অধিকারীকে মোবাইলে জহিরুল হক তালুকদারের নমুনা পরীক্ষার জন্য বলে দেন। এরপর জহিরুল হক তালুকদার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়ে দ্রুততম সময়ে তার নমুনা পরীক্ষা করে রিপোর্ট দিতে বলেন। দ্রুত সময়ে রিপোর্ট চাওয়ায় র্যাপিড অ্যান্টিজেন পদ্ধতিতে তার নমুনা পরীক্ষা করা হয়। এরপর তিনি রিপোর্ট নিয়ে সেখান থেকে নগরীর মধুমিয়ার পোল সংলগ্ন বাসায় চলে আসেন। মঙ্গলবার (১৩ জুলাই) দুপুরে তিনি বরিশাল সার্কিট হাউজ সম্মেলন কক্ষে শপথ অনুষ্ঠানে যোগ দেন। এ বিষয়ে জানতে বুধবার বিকেল ৪টা থেকে পৌনে ৫টা পর্যন্ত জহিরুল হক তালুকদারের মোবাইলে ছয়বার কল করা হয়। কিন্তু তিনি ফোন রিসিভ করেননি। এরপর তার স্ত্রী আসমা বেগমের মোবাইলে কল করে জহিরুল হক তালুকদারকে চাওয়া হয়। আসমা বেগম বলেন, তার স্বামী কবাই ইউনিয়নের শিয়ালঘুনি গ্রামের বাড়িতে অবস্থান করছেন। গতকাল শপথবাক্য পাঠ করে মোটরসাইকেলে করে তার স্বামী গ্রামে গেছেন।

Advertisement

এসময় জহিরুল হক তালুকদারের শারীরিক অবস্থা কেমন জানতে চাইলে আসমা বেগম বলেন, ‘এখন তিনি অনেকটাই সুস্থ আছেন।’

করোনায় আক্রান্তের বিষয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ইউএনও মাধবী রায় মোবাইলে তার স্বামী জহিরুল হকে নমুনা পরীক্ষার জন্য উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা শঙ্কর প্রসাদ অধিকারীকে বলে দিলে তিনি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়ে নমুনা দেন। ৩০ থেকে ৪০ মিনিটের মধ্যে তার রিপোর্ট নেগেটিভ আসে।’

করোনা পজিটিভ শনাক্ত ব্যক্তি এভাবে অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার কারণে অন্যদের আক্রান্ত ঝুঁকি রয়েছে কি-না জানতে চাইলে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. সাইফুল ইসলাম বলেন, ১৪ দিন পর নমুনা পরীক্ষায় নেগেটিভ আসলে ঘরের বাইরে বের হওয়া উচিত। তবে এক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য ও নির্ভুল রিপোর্ট পেতে ওই ব্যক্তির আরটি-পিসিআর ল্যাবের মাধ্যমে নমুনা পরীক্ষা করানো দরকার। যদি এর ব্যত্যয় ঘটে, তাহলে ওই ব্যক্তির কারণে হয়তো আরও অনেকের মাঝে এ ভাইরাস ছড়িয়েছে।’

বাকেরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা শঙ্কর প্রসাদ অধিকারী বলেন, জহিরুল হক কতদিন ধরে করোনায় আক্রান্ত, তা বলেননি। পাশাপাশি আক্রান্তের পর তিনি দ্বিতীয়বার পরীক্ষা জন্য এসেছেন, সে বিষয়ে চিকিৎসকদের কিছুই জানাননি।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাধবী রায় বলেন, ‘উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তাকে মোবাইলে চেয়ারম্যান জহিরুল হক তালুকদারের নমুনা পরীক্ষার জন্য বলেছিলাম। তবে কতদিন ধরে তিনি আক্রান্ত ছিলেন সে বিষয়ে তিনি আমাকে কিছুই বলেননি। তিনি না বললে আর আমার পক্ষে সেই তথ্য জানাও সম্ভব ছিল না।’

জহিরুল হক তালুকদারকে শপথবাক্য পাঠ করান জেলা প্রশাসক জসীম উদ্দীন হায়দার। তিনি বলেন, ‘আমরা করোনা নিয়ে কোনো ব্যক্তিকে শপথ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে বলিনি। এজন্য তিনিই (জহিরুল হক) দায়ী। তাকেই এর দায়ভার নিতে হবে।’

এদিকে শপথবাক্য অনুষ্ঠান শেষে নবনির্বাচিত চেয়ারম্যানদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে সার্কিট হাউজ সম্মেলন কক্ষে যান জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তালুকদার মো. ইউনুস। এসময় তার পেছনে গিয়ে দাঁড়ান জহিরুল হক তালুকদার। বেশ কিছুক্ষণ তিনি ওই স্থানে দাঁড়িয়ে ছিলেন।

জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তালুকদার মো. ইউনুস এ প্রসঙ্গে বলেন, জহিরুল হক তালুকদার করোনা নিয়ে সেখানে গিয়েছিলেন, এটা তার জানা ছিল না। জহিরুল হক তালুকদার কাজটি ঠিক করেননি।

সাইফ আমীন/এসআর/এআরএ