ভালোবাসার অনন্য নির্দশন হজের মাস চলছে। বিশ্বব্যাপী মুসলিম উম্মাহ জিলকদ মাস থেকে পবিত্র নগরী মক্কায় আল্লাহর ভালোবাসায় মত্ত হয়ে জড়ো হতে থাকে। মহামারি করোনার কারণে বাইতুল্লায় ব্যাপক উপস্থিতি ও লাব্বাইক ধ্বনির মোহনীয় ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত মুসলিম উম্মাহ। ইসলাম পাঁচটি ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত। হজ তার পঞ্চমটি। যা আর্থিক, শারীরিক ও মানসিক ইবাদত। এই ইবাদত কী ও কেন? এমনকি কোন প্রেক্ষাপটে হজ ফরজ হয়েছিল; তাও জানে না অনেকে। সুতরাং জানা দরকার যে, ভালোবাসার অনন্য নিদর্শন হজ কীভাবে শুরু হয়েছিল।
Advertisement
হজ কী?হজ মানে হচ্ছে সংকল্প করা। আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশে হজের মাসের (শাওয়াল, জিলকদ ও জিলহজ) নির্ধারিত দিনসমূহে নির্ধারিত পদ্ধতিতে পবিত্র নগরী মক্কায় অবস্থিত বাইতুল্লাহ, আরাফা, মুজদালিফা ও মিনায় নির্ধারিত কাজগুলো সম্পাদন করাই হচ্ছে হজ।
ইসলামের ইতিহাসে হজের ইতিহাস অতি প্রাচীন এবং এর প্রতিটি কাজ ঐতিহাসিক ঘটনাবহুল, স্মৃতিবিজড়িত ও তাৎপর্যপূর্ণ। আর তাহলো-
১. হজরত আদম ও হাওয়া আলাইহিস সালামকে জান্নাত থেকে পৃথিবীতে পাঠানোর পর তাঁরা উভয়ে পৃথিবীতে পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। একে অপরকে ব্যকুল হয়ে খুঁজতে থাকেন।
Advertisement
আল্লাহ তাআলার অসীম রহমতে তাঁরা উভয়ে হজের মূল আনুষ্ঠানিকতার স্থান আরাফাতের ময়দানে পরস্পর মিলিত হন। তাদের এ মিলনস্থলকে আল্লাহ তাআলা সারা পৃথিবীর সামর্থ্যবান মানুষের জন্য জীবনে একবার মহামিলন প্রান্তর আরাফাতের ময়দানে উপস্থিত হওয়াকে আবশ্যক করে দিয়েছেন।
মুসলিম উম্মাহ আল্লাহর নির্ধারিত ফরজ কাজ সম্পাদনে ভালোবাসার টানে প্রতি বছরই জিলহজ মাসের ৯ তারিখ আরাফার ময়দানে উপস্থিত হয়। আরাফাতের ময়দানে উপস্থিত হওয়াকে প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হজ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
এ কারণেই মানুষ হজের মূল আনুষ্ঠানিকতা পালনে প্রতি বছর ৯ জিলহজ আরাফাতের ময়দানে উপস্থিত হয়ে আল্লাহ তাআলার দরবারে রোনাজারি, কান্নাকাটি করে। তারা হৃদয় ও মন দিয়ে আল্লাহকে উপলব্দি করার প্রাণপণ চেষ্টা সাধনায় নিজেদেরকে আত্মনিয়োগ করেন। আর এ আরাফাতের ময়দানে অবস্থানই হজের মূল রুকন।
২. আজ থেকে সাড়ে ৪ হাজার বছর আগে সংঘটিত হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম ও তাঁর স্ত্রী বিবি হাজেরা এবং তাঁদের পুণ্যবান সন্তান হজরত ইসমাইল আলাইহিস সালাম-এর দ্বারা সংঘটিত সাফা-মারওয়ায় সায়ী; হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম কর্তৃক মিনায় শয়তানকে পাথর নিক্ষেপ এবং সবচেয়ে প্রিয়বস্তু প্রাণপ্রিয় সন্তান হজরত ইসলামাইলকে কুরবানির ঘটনাও সংঘটিত হয়েছিল এ মিনা প্রান্তরে। যা মুসলিম উম্মাহ হজের সময় পালন করে থাকেন।
Advertisement
৩. হজরত আদম আলাইহিস সালাম থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত যুগে যুগে সব আল্লাহ প্রেমিক বনি আদম পরম ব্যকুলতা, আবেগ, মায়ামমতা ও একান্ত ভালোবাসায় আল্লাহর ঘরে উপস্থিত হওয়ার মাধ্যমে ঐতিহাসিক স্মৃতিবিজড়িত প্রেক্ষাপটে ফিরে যায়। এ স্থানগুলোর জিয়ারত ও কর্মসম্পাদনের প্রেক্ষাপটই হজ।
৪. হজরত আদম আলাইহিস সালামের সময় থেকে থেকে শুরু হয় আল্লাহর প্রেমের নিদর্শন হজ। যা পর্যায়ক্রমে সব নবি-রাসুলগণই বাইতুল্লাহ জিয়ারত ও তাওয়াফ করেন। যে ধারা আজও প্রচলিত। হজের ধারাবাহিকতা কীভাবে শুরু হয়েছিল সে সম্পর্কে হাদিসে এসেছে-> প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘বাইতুল্লাহ পুনঃর্নিমাণের পর হজরত জিবরিল আলাইহিস সালাম এই ঘরকে তাওয়াফ ও হজ করার জন্য হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালামকে বলেন।
> হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম এ নির্দেশ পেয়ে ছেলে হজরত ইসমাইল আলাইহিস সালামকে নিয়ে তিনি বাইতুল্লাহ তাওয়াফসহ হজের যাবতীয় কার্মকাণ্ড সম্পন্ন করেন।
হজের নির্দেশঅতঃপর আল্লাহ তাআলা গোটা দুনিয়ার মানুষের জন্য হজের ঘোষনা প্রদানের নির্দেশ প্রদান করেন। যা কুরআনে এভাবে উল্লেখ করা হয়েছে-‘এবং মানুষের নিকট হজের ঘোষণা দাও; তারা তোমার নিকট আসবে পদব্রজে ও সর্বপ্রকার ক্ষীনকায় উষ্ট্রের পিঠে, তারা আসবে দূরদূরান্তের পথ অতিক্রম করে।’ (সুরা হজ : আয়াত ২৭)
অতঃপর হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম আল্লাহর নির্দেশ পেয়ে একটি উঁচু স্থানে ওঠে চতুর্থদিকে ফিরে হজের ঘোষণা প্রদান করেন। যা কুরআনে এভাবে এসেছে-‘হে লোকসব! বাইতুল্লাহ-এর হজ তোমাদের ওপর ফজর করা হয়েছে। তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের আহবানে সাড়া দাও।’
হজরত ইবারাহিম আলাইহিস সালামের এ আহবানে সাড়া দিয়ে পূর্ব-পশ্চিম দিগন্তে যাদের হজ নসিব হয়েছে, তারা- ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক; হাজির হে আল্লাহ! আমার সবাই উপস্থিত; সাড়া দিয়েছে। যার যতবার সৌভাগ্য হয়েছে, সে ততবার হজ পালনে সাড়া দিয়েছে।
এভাবেই হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালামের পর যে সব নবি-রাসুলের আগমন ঘটেছে, তাদের সবাই বাইতুল্লাহ জিয়ারত করেছেন এবং হজ পালন করেছেন।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহর জন্য হজ ফরজের ঘোষণা প্রদান করেন বলেন-‘মানুষের মধ্যে যাদের সেখানে যাওয়ার সামর্থ্য আছে আল্লাহর উদ্দেশ্যে ঐ ঘরের হজ করা তাদের জন্য আবশ্যক কর্তব্য।’ (সুরা আল ইমরান : আয়াত ৯৭)
উল্লেখিত আলোচনার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটকে বুকে ধারণ করেই মুসলিম উম্মাহ হজের যাবতীয় কর্মকাণ্ড পালন করে আল্লাহর নৈকট্য অর্জনে এগিয়ে যায়।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে হজ সম্পাদনের তাওফিক দান করুন। বাইতুল্লাহ ও আরাফাতের ময়দানে উপস্থিত হয়ে মাওলার সঙ্গে প্রেমের অনন্য নজির স্থাপন করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
এমএমএস/এমকেএইচ