বাংলা প্রবাদ-প্রবচনের কোনো কোনোটির বিদেশি ভার্সনও রয়েছে। কোনো কোনোটির তো আছে বিশ্ব ভার্সনও। বাংলা প্রবাদে আছে ‘হাতি গর্তে পড়লে চামচিকায়ও লাথি মারে।’ এটির ইংরেজি ভার্সন হচ্ছে: Little birds may peck a dead lion. তাদের প্রবাদটিতে হাতি-চামচিকার কথা নেই। সেখানে রয়েছে সিংহ ও ছোটপাখির কথা। তবে, মর্মার্থ একই। বাস্তবে হাতি কাদায় পড়ার পর চামচিকা লাথি-উষ্ঠা মেরেছে এমন ঘটনা না থাকলেও এটি উপমা হিসেবে চমৎকার। বোঝা যায় সেখান থেকেই প্রবাদটির জন্ম। তবে, জন্মটা আগে বাংলায় না ইংরেজিতে?- এ নিয়ে তথ্য নেই।
Advertisement
আফগানিস্তান ইস্যুতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থা আপাতত কিছুটা হাতির গর্তে পড়ার মতো। মার্কিন সৈন্যদের রাতের আঁধারে আফগানিস্তানের বাগরাম ঘাঁটি ছেড়ে চলে যাওয়ার খবরটি বিশ্ব গণমাধ্যমে ব্রেকিং হয়েছে। আর আলোচনা-সমালোচনা তো দুনিয়া জোড়া। বাগরামের নতুন কমান্ডার জেনারেল আসাদুল্লাহ কোহিস্তানি বিবিসিকে বলেছেন, আমেরিকানরা ২ জুলাই পবিত্র শুক্রবার শেষরাতে সেখান থেকে চলে গেছে। আফগান সামরিক বাহিনী ব্যাপারটা টেরই পায়নি। তারা জেনেছে মার্কিন সেনারা চলে যাওয়ার কয়েক ঘন্টা পর। আধুনিক বিশ্বের জন্য বিষয়টি কিছুটা বিস্ময়করও। তবে, তালেবানরা দ্রুত জেনেছে। জেনে আর দেরি করেনি। ঝাঁপিয়ে পড়ে আফগানিস্তানের বিভিন্ন এলাকার নিয়ন্ত্রণ হাতে নিতে।
মার্কিনিদের জন্য আফগানিস্তানে ভাইটাল স্পট এই বাগরাম। পূর্ব-ঘোষিত চূড়ান্ত সময়সীমার আগেই তাদের এটি এভাবে খালি করে দিয়ে চলে যাওয়ার রহস্য এখনো ধোঁয়াশার মধ্যে। এ বছরের গোড়ার দিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ঘোষণা করেছিলেন, আফগানিস্তান থেকে ১১ সেপ্টেম্বরের মধ্যে সব সৈন্য প্রত্যাহার করে নেবে আমেরিকা। সেই সময়ের অন্তত দুই মাস আগেই চম্পট দেয়ার ঘটনা। আফগানিস্তানকে সুরক্ষা দিতে ১৯৫০-এর দশকে এই বিমানঘাঁটিটি যুক্তরাষ্ট্রই তৈরি করেছিল। এরপর ১৯৭৯ সালে রাশিয়ার রেড আর্মি আফগানিস্তানে আক্রমণ চালানোর পর এই বিমানঘাঁটির দখল নেয় সোভিয়েত ইউনিয়ন। পরে এটির দখল নেয় একটি মুজাহেদিন প্রশাসন। ১৯৯০ এর দশকের মাঝামাঝিতে তালেবান ক্ষমতায় এলে বিমানঘাঁটিটি তাদের নিয়ন্ত্রণে আসে। এর বছর দশেক পর ২০০১ সালে আফগানিস্তানের দখল নিয়ে তালেবানকে ক্ষমতাচ্যুত করে দ্রুত বিমানঘাঁটিটির পুনর্দখল করে নেয় যুক্তরাষ্ট্র। এটিকে তারা বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে আরো সম্প্রসারণ করে। সেখান থেকেই মার্কিন বাহিনী গত বিশ বছর ধরে তালেবানদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়েছে।
এর আগে, কাশেম সোলাইমানি হত্যাকাণ্ডের পর মার্কিন সৈন্যরা ইরাকের ঘাঁটিতে ব্যাপক মার খেয়েছে। নিহত হয়েছে শতাধিক মার্কিন সৈন্য। আহত ও পঙ্গু হয়েছে অনেকে। ইরাকের সেই ঘাঁটিতে আমেরিকার অত্যাধুনিক আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও অবিরাম মার খেয়েছে। এসব নানান দিক চিন্তা করে বাইডেন প্রশাসন এখন ইরানের সাথে আপোসমুখি। ইরানও অনেকটা নির্ভারে এখন সমগ্র আরব আফ্রিকায় সামরিক নেতৃত্ব দিচ্ছে। ইয়ামিনের হুথিদের ড্রোনের কাছে কাবু হয়ে সৌদি আরব, কুয়েত ও জর্ডান থেকেও যুক্তরাষ্ট্র অত্যাধুনিক আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। এরমাঝে নানা হিসাব ও সমীকরণ শুরুও হয়েছে। যারা আমেরিকান প্রত্যাহারের জন্য নানাভাবে দাবি দাওয়া জানাচ্ছিল, তারাও সত্যি সত্যি যুক্তরাষ্ট্রের আফগানিস্তান থেকে বিদায় নিয়ে নানা হিসাব নিকাশ কষছে। যুক্তরাষ্ট্র আরো কিছু দিন আফগানিস্তানে থাকলে সক্ষমতা প্রকাশ পেতো- এমন উসকানি ছাড়ছে। আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের এভাবে কেটে পড়া ঠিক হয়নি- এমন টাইপের উস্কানিও কম নয়। যুক্তরাষ্ট্রের আফগানিস্তান থেকে বিদায় অন্য কোনো বৃহত্তর পরিমণ্ডলে জড়িত হবার প্রস্তুতি কিনা- এ ভয়ও কাজ করছে অনেকের মধ্যে।
Advertisement
হাতি নয়, বাঘ-সিংহ তুল্য মহাশক্তিধর মনে করে বিনা লাভেও যেসব দেশ বা মহল বা কিছু গণমাধ্যম যুক্তরাষ্ট্রের তোষামোদি করেছে তারাও এখন দেশটির সমালোচনা করার মধ্যে অন্যরকম থ্রিল পাচ্ছে। সত্যিই যেন হাতি গর্তে পড়েছে। যা ইচ্ছা বলা যায়, করা যায়। হাতি মরলেও লাখ টাকা-এমন প্রবাদও কিন্তু আছে। The very ruins of greatness are great-প্রবাদের মার্কিনিরা ক্ষমতার কদর সব সময়ই থাকে বলে বার্তা দেয়। কেবল মার্কিনি নয় সময় খারাপ দেখলে সব প্রাণিই দম নেয়। অপেক্ষা করে পরবর্তী সময়ের জন্য। এই নজির আমেরিকার অনেক আছে। একেক সময় একেক রূপ ধারণের ইতিহাসও রয়েছে বিশ্বের এই সুপার পাওয়ার দেশটির। ভিয়েতনামে পরাজিত হয়ে সেখানে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার সাহায্য দিয়েছে দেশ পুনর্গঠনের জন্যে। এখন ভিয়েতনাম তার বন্ধু। তেমনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধীতা করেছে। আবার স্বাধীনের পর বন্ধু হয়েছে। দিয়েছেও অনেক। তবে, চামচিকা হয়ে নয়। বাঘভালুক, সিংহ বা হাতির মতো দাপটের সঙ্গেই দিয়েছে।
এবার আফগানিস্তানের প্রশ্নে গর্তে পড়া হাতি নিজে থেকেই উঠে দাঁড়াবে, নাকি নতুন পরিস্থিতি ও নতুন মিত্র বানিয়ে ভিন্ন কিছুর অপেক্ষা করবে সেটা দেখতে অপেক্ষা করতে হবে। বিশ্বায়নের আধুনিক বিশ্বে কাউকে চামচিকা বলে তাচ্ছিল্যের দিন শেষ হয়ে এসেছে। এরপরও চেষ্টার কমতি করে না। আফগান কেন সুযোগ পেলে উগান্ডানরাও দেখিয়ে দেয়ার পোষণ করা আশা গোপন রাখেন না। পাকিস্তান তো এক ঝলক দেখিয়েই দিয়েছে। পাকিস্তানের ইমরান খানের ভূরাজনীতির বোলিংয়ে আমেরিকাকে আপাতত হারতে হয়েছে। আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহারের পরে প্রেসিডেন্ট বাইডেন পাকিস্তানে একটি ঘাঁটি রাখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু, হাতির গর্তে পড়া আঁচ করে ইমরান খান বেঁকে বসায় সেটি হলো না। তালেবানদের পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার অর্থায়ন ও দেখভাল অনেকটা ওপেন সিক্রেট। আবার তালেবানদের সঙ্গে মার্কিনিদের চুক্তির মধ্যস্ততা পাকিস্তানই করেছে। পরিস্থিতি আঁচ করে ভারতও নড়েচড়ে বসেছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কাশ্মীরের সেই ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল করে আগের অবস্থায় গেছেন। পুরাতন অনেক মন্ত্রীকে বাদ দিয়ে নতুন মন্ত্রিসভা করেছেন। চীন-রাশিয়া তো ভ্যাংচি কাটছেই। যুক্তরাষ্ট্র তাদের ওপর খবরদারির হিম্মত হারিয়ে ফেলেছে বলে বিশ্বাস পোক্ত হচ্ছে দেশ দুটিরই।
আফগানিস্তানে তালেবানদের বিজয় ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনীতিতে গুনগত পরিবর্তনের সঙ্গে ভূরাজনীতিতেও নুতুন মেরুকরণের সমীকরণ রয়েছে। ন্যাটোর সেনারা কাতার চুক্তি মোতাবেক আফগানিস্তান ছাড়লেও দেশটিতে কিছু জঞ্জালের বিজ বপন করে যাচ্ছে। তারা যাবার বেলায় আফগানিস্তানের সাধারণ উপজাতিদের মধ্যে অস্ত্র ও অন্যান্য সামরিক সরঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছে। এর উদ্দেশ্য কী? যেন তারা তালেবান ঠেকানোর নামে গৃহযুদ্ধে মেতে থাকে, সেজন্য?
লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।
Advertisement
এইচআর/এএসএম