যেখানে সমগ্র দেশ এগিয়ে যাচ্ছে প্রযুক্তির ছোঁয়ায়। মানুষ এগিয়ে যাচ্ছে আধুনিকতার পরশে। সেখানে একটি সম্প্রদায় পিছিয়ে আছে একই ভূখণ্ডের ভেতরে! তারা নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত। তাদের জন্য নেই দেশের আর দশজন নাগরিকের মতো বেঁচে থাকার সুব্যবস্থা। বলছিলাম পটুয়াখালী জেলার রাঙ্গাবালী উপজেলার চরমোন্তাজে নৌকায় বসবাস করা মান্তা সম্প্রদায়ের কথা। বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত তারা। নদী, খাল, বিলের পানিতে চলন্ত নৌকায় বাস করেন তারা। এমন বসবাস যেন তাদের নিয়তি।
Advertisement
চরমোন্তাজে নৌকায় বসবাস করে এমন শতাধিক মান্তা পরিবার আছে। নদীতে মাছ ধরাই তাদের জীবিকার প্রধান উৎস। এসব পরিবারের মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই নৌকা ছাড়া। যেখানে থাকার জায়গা নেই; সেখানে টয়লেট ব্যবস্থা তাদের কাছে কল্পনা মাত্র। যেখানে একই নৌকায় সন্তানদের সঙ্গে মা-বাবাকে বসবাস করতে হয়; সেখানেই খোলা পরিবেশে পয়ঃনিষ্কাশনের মতো প্রয়োজনীয় কাজটি সেরে নিতে হয়।
সুশীল সমাজের পক্ষ থেকে কেউ এমন প্রশ্ন করলে লজ্জায় মুখ লুকিয়ে নেন তারা। কারণ তাদের প্রকৃতির ডাকে সারা দিতে হয় ভাসমান নৌকায় বসেই। শিশু-সন্তানদের সামনে এবং খুব কাছ থেকেই দৈনন্দিন কাজটি করতে হয়।
যে পানিতে তারা মল-মূত্র ত্যাগ করছেন; সেই পানিই আবার রান্না-গোসলে ব্যবহার করছেন। এসব কারণে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছেন মান্তাসহ নদী তীরবর্তী জনগণ। সবচেয়ে বেশি স্বাস্থ্য বিপর্যয়ে আছে শিশুরা। ডায়রিয়াসহ পানিবাহিত রোগ লেগেই থাকে মান্তা বহরের একাধিক নৌকায়।
Advertisement
মান্তাদের মল-মূত্রের কারণে নদীর পরিবেশও খারাপ হচ্ছে। এ নিয়ে স্থানীয় জনগণের রাগ-ক্ষোভের মুখে পরছেন তারা। এ কাজের ফলে এলাকায় সাধারণ মানুষ তাদের ঘৃণার চোখে দেখে। স্থানীয়রা জানান, তাদের মল-মূত্রের কারণে নদীতে গোসল কিংবা কাপড়-বাসন ধোয়া কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। ফলে স্থানীয় নদী তীরবর্তী জনপদের কাছে মান্তারা বিরক্তিকর ও ঝামেলা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
নৌকায় বসবাস করতে আগ্রহী এমন একজনও মান্তাকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। তাদের আগ্রহ আছে একখণ্ড মাটির পৃথিবীতে একটি ছোট্ট ঘরের প্রতি। এমন স্বপ্ন থাকা সত্ত্বেও তাদের সাধ্য নেই।
মান্তাদের জীবনমান ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়নে এখন পর্যন্ত নেওয়া হয়নি তেমন কোনো উদ্যোগ। এমনটাই জানালেন মান্তা সম্প্রদায়ের একাধিক জন। তারা জানান, মান্তা বহরে যারা আছেন; তাদের জমি নেই। কিন্তু দীর্ঘদিন একই জায়গায় নৌকা লাগিয়ে বসবাস করে যাচ্ছেন। এমন স্থানগুলোয় স্থানীয় সরকারের পক্ষ থেকে যদি টয়লেটের ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়, তবে মান্তারা তা ব্যবহার করতে পারতো।
চরমোন্তাজে মান্তা সম্প্রদায়ের একজন জাহাঙ্গীর হোসেন। তিনি বলেন, ‘দিন আধুনিক হইছে, কিন্তু আমরা আউগাতে (আগাতে) পারি নাই। টয়লেট ব্যবস্থার উন্নতি হবে, তবে তার আগে দরকার স্থায়ী বসতির। ঘর-বাড়ি থাকলে সব ঠিক হয়ে যেত। কিন্তু সেটাই তো আমাদের নেই। আগের যুগের মত টয়লেট ব্যবস্থা আমাদের জন্য লজ্জার। কিন্তু উপায় কি বলেন?’
Advertisement
স্থানীয় সাংবাদিক ও উন্নয়নকর্মী আইয়ুব খান এ বিষয়ে বলেন, ‘১৯৮৪ সাল থেকে মান্তা পরিবারগুলো চরমোন্তাজের সুলিজ খালে বসবাস শুরু করে। তাদের জন্ম-মৃত্যু নৌকায়। তাদের কোনো স্যানিটেশন ব্যবস্থা নেই। তাদের জীবনমান উন্নয়নে সমাজ ও রাষ্ট্রের নজরদারি খুব জরুরি হয়ে উঠেছে। বহর বিবেচনায় একটি করে হলেও টয়লেট দরকার।’
সম্প্রতি তাদের জীবনমান উন্নয়নে কাজ শুরু করেছে বেসরকারি কিছু উন্নয়ন সংস্থা। তাদের স্যানিটেশন সমস্যা নিয়ে ভাবতে শুরু করেছে স্থানীয় শিক্ষিত তরুণরাও। তারা জানান, সব সমস্যার মূলে রয়েছে মান্তাদের থাকার জায়গার অভাব। তাদের যেমন কোনো জমি নেই, তেমনই তারা কখনোই স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা ব্যবহার করতে পারে না।
তারা আরও জানান, দেশের মানুষের স্বাস্থ্য উন্নয়ন করতে হলে এ মান্তা জনগোষ্ঠীর সবাইকে স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটেশন ব্যবস্থার আওতায় আনতে হবে। একইসঙ্গে এ ভূমিহীন জনগোষ্ঠীকে সরকারি খাস জমির বন্দোবস্ত করে মূলধারায় ফিরিয়ে আনতে হবে।
লেখক: ফিচার লেখক ও সাংবাদিক।
এসইউ/এমএস