বিশেষ প্রতিবেদন

মুক্তিযুদ্ধের গেরিলা নারী

পৃথিবীর যেকোনো যুদ্ধেই নারী এবং শিশুরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আবার যুদ্ধের নেপথ্যের শক্তি-সাহসেও অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন নারীরাই। তেমনি মুক্তিযুদ্ধে নারীদের ভূমিকা ঈর্ষণীয়, যা ন্যয়ের পক্ষে যুদ্ধজয়ের ইতিহাসে গৌরবজ্জ্বল হয়ে আছে।মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি পর্ব থেকেই নারীদের অংশগ্রহণ ছিল বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়। যুদ্ধের শেষ পর্যন্ত অদম্য সাহস আর উদ্দীপনা নিয়ে তারা বিজয় ছিনিয়ে আনেন। বিশেষ করে যুদ্ধে গেরিলা নারী মুক্তিযোদ্ধাদের সাহসিকতা সংগ্রামী নারী সমাজের আজও প্রেরণার উৎস।মুক্তিযুদ্ধে নারী গেরিলাদের কথা বলতে গেলে প্রথমেই বলতে হবে বেগম ফোরকানের কথা যার নেতৃত্বে গড়ে উঠেছিল প্রথম গেরিলা স্কোয়াড। তার নেতৃত্বে প্রথম দলে ছিলেন আটজন। তারা ফেব্রুয়ারি মাস থেকেই অস্ত্র প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছিলেন। নারীদের গেরিলা ট্রেনিংয়ের জন্য বিভিন্ন শরণার্থী শিবির থেকে শতাধিক নারীকে নির্বাচন করা হয়। প্রথম এদের বিভিন্ন যুদ্ধাস্ত্র সম্পর্কে ধারণা দেয়া হয় এবং তাদের মধ্যে থেকে সুইসাইড স্কোয়াডের জন্য উচ্চতর প্রশিক্ষণ দেয়া হয়।পূর্বঞ্চালীয় হাইকমান্ড শেখ ফজলুল হক মনির নির্দেশে তার সেকেন্ড ইন কমান্ড জনাব আ.স.ম. আব্দুর রব কিশোর তরুণী নেত্রীদের গেরিলা ও সুইসাইড স্কোয়াডের আধুনিক অস্ত্রের উচ্চতর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছিলেন আগারতলার লেম্বুচোরা ক্যাম্পে।মুক্তিযুদ্ধের আরেক মহীয়সী নারী সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরে সংগ্রামী যোদ্ধা মেয়েদের জন্য বাংলাদেশের তৎকালীন সংসদ সদস্য সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর পরিচালনায় ‘গোবরা ক্যাম্প’ চালু হয়েছিল। সেই ক্যাম্পে মেয়েরা অস্ত্র চালনা শিখতেন। বিভিন্ন রাজেনৈতিক দল ও ব্যক্তি উদ্যোগে প্রায় ৩০০ তরুণী ও কিশোরী সংগঠক গোবরা ক্যাম্পে অবস্থান করতেন। এছাড়াও সিভিল ডিফেন্স ও নার্সিং এর প্রশিক্ষণ দেয়া হতো সেখানে।মুক্তিযুদ্ধে নারী শক্তির অন্যতম নাম তারামন বিবি বীর প্রতীক। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি কুড়িগ্রামের রাজীবপুর ট্রেনিং ক্যাম্পে রাঁধুনী হিসেবে যোগদেন। রাজীবপুর ওয়ার ফিল্ডে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ গুপ্তচরবৃত্তির কাজ করে করেন এই গেরিলা। একের পর এক এসাইনমেন্ট সে পাকিস্থানি সেনাদের অবস্থানস্থল কোদালকাঠি ইউনিয়নে ঢুকে যেতেন।রাতের বেলা পাকসেনা শিবিরের কাছাকাছি ঢুঁ মেরে বের করে আনতেন সব হাঁড়ির খবর। তার কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতেই মুক্তিবাহিনী প্রথম পাকসেনা শিবিরে হামলা চালায়। এছাড়া ওই রণাঙ্গানে যুদ্ধ শুরুর আগে তারামন বিবি অসংখ্য বাঙালি পরিবারকে পাকবাহিনীর কবল থেকে নিরাপদ স্থানে আনার এসাইনমেন্টও অংশ নেয়।একাত্তরের গেরিলা যোদ্ধা আলমতাজ বেগম ছবি মুক্তিযুদ্ধ শিবিরে যোদ্ধাদের রান্নাবান্নার পাশাপাশি অস্ত্র চালনা ও গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছিলেন। একসময় পাকসেনারা ঘিরে ফেলেছিল ওই মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পটি। ৭/৮ দিন অবরুদ্ধ অবস্থায় যুদ্ধ করেছিলেন তিনি।বরিশালের মুলাদী থানার কুতুব বাহিনীতে করুণা বেগম অন্য নারী যোদ্ধাদের সঙ্গে অস্ত্র শিক্ষা নিয়েছিলেন। এই বাহিনীর অধীনে ৫০ জন নারী মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তিনি এই বাহিনীর কমান্ডার ছিলেন। ছদ্মবেশে থেকে শত্রু ছাউনির ওপর গ্রেনেড নিক্ষেপ করে অপারেশন চালিয়েছেন। এছাড়াও স্টেনগান রাইফেল চালানো এবং যেকোনো ধরনের বিস্ফোরক দ্রব্য সর্ম্পকে বিশেষ প্রশিক্ষণ লাভ করেছিলেন।পুরুষের পোশাক পরে যুদ্ধ করেছিলেন আলেয়া বেগম। তিনি চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা থানা কমান্ডের ইউনিট কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। “রাইফেল বন্ধুক এস এম জি এস এল অার সবকিছু চালানোতেই আলেয়া সমান পারদর্শী ছিলেন। শত্রুপক্ষের শক্তি ও অবস্থান বুঝে তাদের মোকাবেলা করার জন্য এসব সমরাস্ত্র হাতে নিয়ে তিনি ছুটতেন। একাধিক সম্মুখ সমরে তার ছিল উজ্জ্বল উপস্থিতি। তিনি ভারতের চাপড়া ট্রেনিং ক্যাম্পে যুদ্ধ কৌশল ও সমরাস্ত্র চালানো শেখেন।পিরোজপুর জেলার “অপারেশন স্বরূপকাঠির অকতোভয় দুই নারী মুক্তিযোদ্ধা বীথিকা বিশ্বাস এবং শিশির কনা গ্রেনেড চার্জ করে উড়িয়ে দিয়েছিলেন গানবোর্ড। নৌকা থেকে পানিতে নেমে সাঁতরে কচুরিপানার সঙ্গে মিশে ভাসতে ভাসতে ভিড়েছিলেন লঞ্চের গায়ে। ছুড়ে মেরেছিলেন গ্রেনেড। পিরোজপুরে এক অখ্যাত গ্রামের মেয়েগুলো হয়ে উঠেছিলেন এক একজন দুর্র্ধষ গেরিলা। বীথিকা গেরিলা ও গুপ্তচরবৃত্তির ট্রেনিং দেয়ার জন্য মেয়েদের সংগ্রহ করে আনতেন। শেষ পর্যন্ত প্রায় ১০০ মেয়েকে ট্রেনিং দেয়া হয়েছিল।তবে বিশ্লেষক এবং ইতিহাসবিদদের মতে, মুক্তিযুদ্ধে নারীর অবদান এখনও পরিপূর্ণভাবে মূল্যায়ন করা হয়নি। বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে শত শত নারী প্রশিক্ষণ নিয়ে সরাসরি এবং গেরিলা যুদ্ধে অংশ নিলেও এ পর্যন্ত তালিকাভুক্ত হয়েছে মাত্র ২০৯ জন নারী।এএসএস/বিএ

Advertisement