ডা. ইসমাইল আজহারি
Advertisement
অ্যানোরেক্সিয়া মূলত হচ্ছে খাবারের চাহিদা কমে যাওয়ার একটি বিশেষ পর্যায়। যেমন- অনেকের বিভিন্ন অসুখ হলে খাবারের চাহিদা কমে যায়, যাকে মেডিকেলের ভাষায় অ্যানোরেক্সিয়া বলে।
অন্যান্য রোগের কারণে যদি সাময়িকভাবে খাবার গ্রহণ করার চাহিদা কমে যায় তবে সে অবস্থাকে রোগ হিসাবে চিহ্নিত করা হয় না। কারণ সুস্থ হওয়ার পর তা খাবারের চাহিদা আবারও ফিরে আসে। তবে যদি অ্যানোরেক্সিয়ার কারণে খাবার খেতে অনীহা দেখা দেয় তা রোগ বলে বিবেচিত হবে।
অ্যানোরেক্সিয়া নার্ভোসা কী?
Advertisement
অ্যানোরেক্সিয়া নার্ভোসা হচ্ছে খাদ্যাভ্যাসজনিত এক প্রকার মানসিক রোগ। যে রোগের মূল কারণ রোগীর অস্বাভাবিক চিন্তা-ভাবনা। তার মধ্যে এমন একটি চিন্তা-ভাবনার জগত তৈরি হয় যে, রোগী মনে করতে থাকে খাবার খেলেই তার ওজন বেড়ে যাবে। ফলে তাকে অসুন্দর দেখাবে।
এ রকম চিন্তা-ভাবনার কারণে যদি কারো খাদ্যাভাসে পরিবর্তন আসে। কিংবা দৈনিক যে পরিমাণ ক্যালোরি নেওয়া দরকার, সেটা থেকে বিরত থাকে বা উপবাস থাকা শুরু করে; তখন এই অবস্থাকে অ্যানোরেক্সিয়া নার্ভোসা বলা হয়ে থাকে।
এই রোগের কারণ কী?
এখন পর্যন্ত চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা এর বিভিন্ন কারণ গবেষণার মাধ্যমে খুঁজে বের করেছেন পেরেছেন। তার মধ্যে অনত্যম হলো-
Advertisement
১. বায়োলজিক্যাল: অ্যানোরেক্সিয়ার বায়োলজিক্যাল কিছু কারণ আছে। যেমন- কারো জেনেটিক সমস্যা থাকতে পারে। যার কারণে তার ক্ষুধা লাগবে না এবং সে খাবার এড়িয়ে চলবে, তবে এরকম মানুষের সংখ্যা খুব কম দেখা যায়।
২.পারিপার্শ্বিকতা: অনেকেই নিজেকে সুন্দর আর আকর্ষণীয় রাখতে ছিপছিপে গড়ন পেতে চান। এর ফলে সে খাবার কম খায়। এতে করে এক সময় তার অ্যানোরেক্সিয়া ডেভেলপ করতে পারে।
৩.মানসিক কারণ: কেউ কেউ অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিজঅর্ডার বা ওসিডির কারণে কিংবা কোনো হতাশা বা বিষাদগ্রগ্রস্ততার কারণে খাবার গ্রহণ বন্ধ করে দেয়।
সে নিজেকে স্বাস্থ্যবান মনে করে এবং সে নিজে মনে করে যে খাবার না খেলে তার ডিপ্রেশন কমে যাবে। এই চিন্তা থেকে সে খায় না। তখন তা পর্যায়ক্রমে অ্যানোরেক্সিয়া নার্ভোসাতে রুপ নেয়।
আবার অনেকেই স্থূলতার কারণে নানাভাবে বুলিংয়ের শিকার হয়ে থাকেন। এমন ব্যক্তিরা ওজন কমাতে গিয়ে কম খাওয়া শুরু করেন। সে দ্রুত ওজন কমানোর জন্য নিজের মনের সঙ্গে যুদ্ধ শুরু করে দেন।
দেখা যায়, একসময় তার আর ক্ষুধা লাগে না। এভাবে কারো কারো ক্ষেত্রে পরিপূর্ণ খাবার বন্ধ করে কেবল পানি পান করে জীবন ধারণের প্রবণতা চলে আসে। এটিও অ্যানোরেক্সিয়া নার্ভোসার লক্ষণ।
অ্যানোরেক্সিয়া নার্ভোসার উপসর্গ
অ্যানোরেক্সিয়ার রোগীরা নিজেদের স্বভাব এবং চালচলন অন্যদের থেকে লুকিয়ে রাখতে পছন্দ করেন। যদিও প্রচুর শারীরিক এবং আচরণগত পরিবর্তন তারা লুকাতে পারেন না।
১. অস্বাভাবিক ওজন কমে যাওয়া এবং তাদের দেখলে ভীষণ রোগাক্রান্ত মনে হয়।
২. কারো সামনে খেতে বসে না। খেলেও নানা ধরনের টালবাহানা করে খাবার গ্রহণ থেকে বিরত থাকে। কিংবা খুব অল্প পরিমাণে খেয়ে উঠে যায়।
৩. একটা সময় আসে তারা খাবার গ্রহণ করা পরিপূর্ণ বন্ধ করে দেয়। আর খাবার না খেয়েও ভালো থাকার অভিনয় করেন।
৪. যখন শারীরিকভাবে তারা ভেঙে পড়েন; তখন নিজেদের রোগ বুঝতে পেরেও চিকিৎসা নিতে আগ্রহী হন না।
৫. খাবার গ্রহণ না করার কারণে তাদের সারাক্ষণ মাথা ঘুরে (ভার্টিগো) এবং অতিরিক্ত ক্লান্ত লাগে।
৬. অকারণে শীত শীত অনুভব করা।
৭. চুল পড়ে যায়।
৮. শরীরের চামড়া শুকিয়ে যায়।
৯. নারীদের ক্ষেত্রে অনিয়মিত ঋতুচক্র বা বন্ধ হয়ে যায়। এবং কিছু আচরণগত পরিবর্তন দেখা যায়। যেমন- খাওয়ার পর অস্বস্তিবোধ করা, বারবার আয়নায় নিজেকে দেখা, ওজন মাপা ইত্যাদি।
১১. তাদের মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায় এবং সমাজ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেয়। সোশ্যাল এনক্সাইটি অথবা ফোবিয়া ডেভেলপ হয়।
১৪. ওজন কমাতে তারা অতিরিক্ত ব্যায়াম করে।
অ্যানোরেক্সিয়ার চিকিৎসা
অ্যানোরেক্সিয়া যদিও মানসিক রোগ; তথাপি এই রোগের প্রভাব শরীর ও মন উভয়ের ওপরেই পড়ে। তাই চিকিৎসা পদ্ধতিও নানান রকমের হয়। অপুষ্টিতে ভোগার কারণে তাদেরকে হাসপাতালে ভর্তি করারও প্রয়োজন হতে পারে। তবে যদি ওজন স্বাভাবিক থাকে তাহলে হাসপাতালে ভর্তি না হয়েও চিকিৎসা করানো যেতে পারে।
মেডিসিন এবং সাইকিয়াট্রিস্ট চিকিৎসকের অধীনে চিকিৎসা করানো দরকার হয়। বিশেষ ক্ষেত্রে এন্ডোক্রাইনোলজিস্ট কিংবা নিউরোলজিস্ট এর পরামর্শ নিতে হতে পারে। চিকিৎসা পদ্ধতিতে প্রথমেই যা করতে হয় তা হচ্ছে, রোগীর নিউট্রিশন ঠিক করা। মুখে না খেলে শীরাপথে সাপ্লিমেন্ট এর মাধ্যমে প্রতিদিনের প্রয়োজনীয় ক্যালোরি সাপ্লাই দেওয়া যেতে পারে।
এভাবে পর্যায়ক্রমে তাদেরকে খাবারের জন্য কাউন্সেলিং করা যেতে পারে। এতে তাদের খাদ্যাভ্যাস ফিরে আসে। এজন্য তাদেরকে যৌক্তিকভাবে খাবারের পুষ্টি জ্ঞান দিতে হবে। এজন্য পুষ্টি বিশেষজ্ঞ এবং ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিষ্ট বা সাইকোথেরাপিস্টদের সহযোগিতা নিতে পারেন।
ওজন বেড়ে যাওয়ার যে ভয় তৈরি হয়েছে, তা দূর করতে সঠিকভাবে তাদেরকে বিহেভিয়ার থেরাপি দেওয়া ও কাউন্সেলিং করতে হবে। এক্ষেত্রে রোগীর পরিবারের লোকজনের উৎসাহ, সহপাঠীদের আন্তরিকতা এবং স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটির শিক্ষকদের আন্তরিক মানসিক সাপোর্ট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সেল্ফ কাউন্সেলিং
কেউ যদি বুঝতে পারেন যে সে অ্যানোরেক্সিয়ায় আক্রান্ত; তখন তার নিজেরই উচিত পরিবার বা বন্ধুবান্ধবকে তা শেয়ার করা। সেইসঙ্গে অ্যানোরেক্সিয়া বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করা উচিত। সবচেয়ে ভালো হয় একজন ডাক্তার এবং ডায়েটিসিয়ানের সাথে পরামর্শ করে একটা সঠিক লাইফস্টাইল অনুসরণ। যাতে করে একটা সুস্বাস্থ্য সমৃদ্ধ জীবন যাপন করা যায়।
চিকিৎসা না করালে যে সব জটিলতা হতে পারে
যেহেতু অ্যানোরেক্সিয়া নার্ভোসা একটি খাদ্যাভ্যাসজনিত জটিল মানসিক রোগ। এই রোগে আক্রান্ত হলে রোগী খাবার গ্রহণ পরিপূর্ণ ছেড়ে দেয়। সে মনে করে খাবার খেলে ওজন বেড়ে তার শরীর এর গঠন নষ্ট হয়ে যাবে। এভাবে না খেতে খেতে তার মধ্যে বিভিন্ন রোগ দেখা দেয়।
যেমন- অ্যানিমিয়া বা রক্তশুন্যতা, হার্টে মাইটাল ভালব প্রলাপ্স হতে পারে, ইলেক্ট্রোলাইট এর ভারসাম্যহীনতা, কিডনির জটিলতাসহ নানাবিধ হরমোনাল সমস্যা হতে পারে। এমনকি মৃত্যুও হতে পারে। তাই এক্ষেত্রে সঠিক সময় সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে চিকিৎসা করা অপরিহার্য।
লেখক: চিকিৎসক, ঢাকা কমিউনিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল; সিইও, সেন্টার ফর ক্লিনিক্যাল এক্সিলেন্স এন্ড রিসার্চ
জেএমএস/জেআইএম