ফিচার

মেহেদি পরিয়েই মাসে লাবণ্যর আয় ৩০ হাজার টাকা

কানিছ সুলতানা কেয়া

Advertisement

ছোট থেকেই হাতে মেহেদি পরতে পছন্দ করতেন। শখ করে বান্ধবীদের হাত রাঙিয়ে দিতেন নানান নকশায়। প্রশংসাও পেতেন। মজা করে তারা বলতেন একটি পেইজ খোলার কথা। অর্থাৎ অন্যদেরও জানানো। এখান থেকেই উৎসাহ পান।

প্রিয় বন্ধু এবং স্বামীর উৎসাহে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে পেজ খোলা নিজের নামে। এমনটাই জাগো নিউজকে জানান লাবণ্য’স হেনা আর্ট ওয়ার্ক এর স্বত্বাধিকারী আফসানা হাসান লাবণ্য। বর্তমানে যারা প্রফেশনাল কাউকে দিয়ে মেহেদি পড়তে চান; তাদের কাছে খুবই পরিচিত লাবণ্য হেনা আর্ট ওয়ার্ক।

দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় খালার বিয়েতে গ্রামে গিয়েছিলেন লাবণ্য। সেখানে এক ছেলেকে মেহেদি পরাতে দেখে উৎসাহ জাগে লাবণ্যর মনেও। অভিভূত হয়েছিলেন সেই ছেলের মেহেদি পরিয়ে দেওয়ার ধরন এবং নকশা দেখে।

Advertisement

তখন থেকেই নিজে বিভিন্ন মেহেদির ডিজাইন হাতে আঁকানো চেষ্টা করতেন। এভাবেই চলে গেল অনেক দিন। ঈদ কিংবা যেকোনো উৎসবে বাড়ির সদস্য এবং বান্ধবীদের পরিয়ে দিতেন মেহেদি। বরাবরই তার মেহেদির প্রশংসা করত সবাই।

সেখান থেকেই ভাবনা আসে পেইজ খোলার। লেখাপড়ার পাশাপাশি মেহেদি পরানোর মাধ্যমে কিছু রোজগার করার উদ্দেশ্যে এই সিদ্ধান্ত নেন। ২০১৬ সালে লাবণ্য’স হেনা আর্ট ওয়ার্ক নামে একটি পেইজ খুলে ফেলেন তিনি। প্রথমে হোম সার্ভিস দেওয়ার কথা চিন্তা ছিল না তার।

তবে অনেক বেশি অর্ডার আসার কারণে এই সুযোগ কাছে লাগালেন। প্রথমে পরিবারের বাঁধা থাকলেও পরে সবাই মেনে নেন। মাকে সঙ্গে নিয়েই যেতেন ক্লায়েন্টের বাড়িতে। এখন অবশ্য তার সঙ্গে কাজ করেন আরো ৫ জন সদস্য। তাদের নিয়ে গ্রুপ কাজ করেন তিনি।

কখনো আবার তার হয়ে গ্রুপের মেম্বাররা কাজ করেন বিভিন্ন জায়গায়। এক্ষেত্রে তিনি মাথায় রাখেন কিছু বিষয়। প্রথমত ঢাকা এবং এর আশেপাশেই এই সার্ভিস দিয়ে থাকেন। যদি ঢাকার বাইরের কেউ লাবণ্যর কাছ থেকে মেহেদি পড়তে চান সেক্ষেত্রে যাতায়াত খরচ যুক্ত হবে সার্ভিস চার্জের সঙ্গে।

Advertisement

একবার সৈয়দপুরের এক ক্লায়েন্ট তাকে আসা-যাওয়ার এয়ারের টিকিট দিয়েছিলেন, বলে জানান লাবণ্য। হোম সার্ভিস দিতে গিয়ে অনেক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছেন এই উদ্যোক্তা। কখনো পেয়েছেন একেবারে পরিবারের সদস্যের মতো আথিতেয়তা। আবার কখনো কখনো নানান কটু কথাও শুনেছেন।

এমনকি আশেপাশের মানুষ প্রথমে তার কাজ ভালো চোখে না দেখলেও, বর্তমানে লাবণ্যর সাফল্য তাদেরকেও গর্বিত করেছে। এসবে কষ্ট পেয়েছেন, আবার খারাপটা ভুলে গিয়ে ভালোগুলোকেই সঙ্গী করে এগিয়েছেন লাবণ্য।

কখনো কোনো প্রশিক্ষণ নেননি এই হেনা আর্টিস্ট। নিজের মতো করেই ডিজাইন দিতে পছন্দ করেন তিনি।

এরাবিক, ইরানি এবং ইন্ডিয়ান ডিজাইন খুব সুন্দর করে হাতে ফুটিয়ে তুলতে পারেন লাবণ্য। মাঝে মাঝে ক্লায়েন্টদের পছন্দ মতো নকশা এঁকে দেন। লাবণ্যর আঁকানো কনের ছবি খুব ভাইরাল হয়েছিলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। মেহেদি দিয়েই কনের ছবি এঁকেছিলেন কনের হাতে।

দেশে এই ধরনের কাজ তারই প্রথম। এ ছাড়াও তার করা এরাবিক কিছু ডিজাইনও খুব ভাইরাল হয়েছে সাম্প্রতিককালে। লাবণ্যই প্রথম আমাদের দেশের গতানুগতিক মেহেদি দেওয়ার ধারা এবং নকশায় বদল এনেছেন।

তার ভাষায়, ‘মেহেদির নকশায় কোনো ধরাবাঁধা নিয়ম নেই। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ডিজাইন পরিবর্তন হতে থাকে। এখানে আর্টিস্ট তার নিজের রুচি, পছন্দ এবং কল্পনা থেকে কাজ করতে পারেন।’

লাবণ্য জানান, একদিনে ৬-৭টি কাজও হয় কখনো কখনো। হেনা আর্ট ছাড়াও লাবণ্য নিজ নামে হোমমেড অর্গানিক কোণ মেহেদিও বিক্রি করেন। যা তিনি নিজেই ঘরে তৈরি করেন। এই কোন তিনটি সাইজে হয়ে থাকে। যার দাম ১০০, ১৩০ এবং ১৬০ টাকা।

এক্ষেত্রেও শতভাগ প্রাকৃতিক এবং হালাল উপাদান ব্যবহার করেন তিনি। যে কেউ চাইলে এই মেহেদি কিনে ডিপ ফ্রিজে সপ্তাহখানিক সংরক্ষণ করে ব্যবহার করতে পারেন। এমন তাপমাত্রায় ২ দিন পর্যন্ত রাখা যাবে লাবণ্যর ঘরে তৈরি কোন মেহেদি।

লাবণ্য নিশ্চিত করেন, ‘আমার মেহেদি একেবারেই প্রাকৃতিক উপাদান দিয়ে তৈরি করা হয়। যেহেতু কোনো কেমিকেল ব্যবহার করি না; তাই সবাই এটি ব্যবহার করতে পারবেন। আর মেহেদির রং আসলে স্কিন কালারের উপর নির্ভর করে। আমার মেহেদি পরলে ৩-৪ দিনের মধ্যেই গাঢ় হবে। এটি স্কিনে অ্যালার্জি বা র্যাশেরও সৃষ্টি করে না।’

লাবণ্য যেসব ইভেন্টগুলো করেন তার মধ্যে বেশিরভাগই থাকে- বিয়ে, জন্মদিন, বিয়ে বার্ষিকী। এ ছাড়াও অনেকে আছেন পাঁচ কিংবা ২৫ বছরের বিবাহ বার্ষিকি স্মরণীয় করে রাখতে চান, তারাও আছেন এই তালিকায়। ব্রাইডের ক্ষেত্রে তার চার্জ সর্বনিম্ন দুই হাজার থেকে শুরু করে ১২ হাজার পর্যন্ত রয়েছে।

নিজের সাধ্যের মধ্যে যে কেউ চাইলে বিশেষ দিনে মেহেদির রঙে হাত রাঙাতে পারেন। শখকেই পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন লাবণ্য। এখান থেকে তার মাসে রোজগার সর্বনিম্ন ২০-৩০ হাজার টাকা। সিজনাল সময়ে এটি আরো বেড়ে যায় বলে জানান লাবণ্য।

বর্তমানে শান্তা মরিয়ম ইউনিভার্সিটিতে ফ্যাশন ডিজাইনের ৪র্থ বর্ষের ছাত্রী আফসানা হাসান লাবণ্য। স্বামীর সঙ্গে থাকছেন ঢাকাতেই। এ ছাড়াও পরিবারে আছে বাবা-মা এবং এক ভাই। লাবণ্য মেহেদি আর্টিস্ট হিসেবেই নিজের পরিচয় দিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।

আরো অনেক দূর এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখেন তিনি। লাবণ্য বর্তমানে হেনা প্রশিক্ষণও দেন অনলাইনে। এক্ষেত্রে নির্দিষ্ট পরিমাণ চার্জ দিয়ে ক্লাস করেন শিক্ষার্থীরা। অনেকেই তার কাছ থেকে শিখে নিজেরা পেইজ খুলেছে। নতুন নতুন উদ্যোক্তা উঠে এসেছে তার হাত ধরে।

ভবিষ্যতে যারা এই প্রফেশনে আসতে চান তাদের জন্য লাবণ্যর পরামর্শ হচ্ছে, অনেক বেশি অনুশীলন করতে হবে। কারণ এই সেক্টরে এখন অনেক প্রতিযোগিতা। যেখানে অনুশীলনের কোনো বিকল্প নেই। নিজের কাজ দিয়েই নিজের অবস্থান তৈরি করতে হবে। প্রায় এক দশক ধরে মেহেদি আর্টিস্ট হিসেবে অনেকেই ক্যারিয়ার গড়ছেন।

মেহেদি দিতে পছন্দ করেন সব নারীই। ঈদ, বিয়ে কিংবা যে কোনো উৎসবে মেহেদি দয়া যেন এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। মেহেদি শুধু আমাদের দেশেই খুব জনপ্রিয় তা নয়, এ উপমহাদেশ, আফ্রিকা মহাদেশ ও মধ্যপ্রাচ্যে ভীষণভাবে জনপ্রিয়।

প্রাচীনকাল থেকেই মেয়েরা তাদের সৌন্দর্যের একটি বড় উপকরণ মনে করেন এ মেহেদিকে। সাধারণত মেয়েরা মূলত হাতেই পরেন মেহেদি, তবে কেউ কেউ এটি পায়েও পরে থাকেন। নারীদের পাশাপাশি পুরুষরাও মেহেদি হাতে, চুলে ও দাড়িতে লাগিয়ে থাকেন।

একেক দেশে মেহেদির ব্যবহারে আছে ভিন্নতা। সুদানে মেহেদির ব্যবহার থেকে বিবাহিত-অবিবাহিত মেয়েদের চেনা যায়। সে দেশে যে নারীরা দুই হাতে মেহেদি পরেন তারা বিবাহিত; আর যারা মেয়ে এক হাতে মেহেদি পরেন তারা অবিবাহিত।

জেএমএস/এমকেএইচ