বিশেষ প্রতিবেদন

খোলাবাজারে বিনামূল্যের বই

প্রাথমিক স্তরের বিনামূল্যের অর্ধেক বই ছাপা এখনো বাকি। বছরের প্রথম দিন ৪০ লাখ বই শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দিতে পারবে কিনা তা নিয়ে চরম শঙ্কায় রয়েছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। কিন্তু এই শঙ্কার মধ্যেই প্রকাশ্যে এসব বই রাজধানীর বিভিন্ন বইয়ের দোকানে বিক্রি হচ্ছে। সন্তানকে আগাম পাঠদান করতে অভিভাবকরাও টাকা দিয়ে বই কিনতে হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন এসব বইয়ের দোকানে। সরকারের বই উৎসব ম্লান করে দিতেই একটি চক্র পরিকল্পিতভাবে এ কাজটি করছে বলে অনুসন্ধানে জানা গেছে। এনসিটিবি সূত্র জানায়, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে ১ জানুয়ারি দেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তুরের সকল শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে পাঠ্যবই বিতরণ করা হয়। ২০১৬ শিক্ষাবর্ষে প্রাক-প্রাথমিকে ৩৩ লাখ ৭৩ হাজার ৩৭৩ শিক্ষার্থীর জন্য ৬৫ লাখ ৭৭ হাজার ১৪২টি বই, প্রাথমিকের ২ কোটি ৪৫ লাখ শিক্ষার্থীর জন্য ১০ কোটি ৮৭ লাখ ১৯ হাজার ৯৯৭টি বই এবং মাধ্যমিকের ১ কোটি ১২ লাখ ৩৬ হাজার ১৮ শিক্ষার্থীর জন্য ১৬ কোটি ৩০ লাখ ৪ হাজার ৩৭৩টি বই ছাপার দরপত্র আহ্বান করা হয়। সব মিলে ৩৩ কোটি ৩৭ লাখ ৬২ হাজার ৭৬০টি বই ছাপা হবে। বুধবার সন্ধ্যায় এনসিটিবির দেয়া তথ্য অনুযায়ী, মাধ্যমিকের ৯৫ শতাংশ, প্রাথমিকের ৫০ শতাংশ বই উপজেলা সদর পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। এনসিটিবির চাহিদা অনুযায়ী সরকারি প্রতিষ্ঠান কর্ণফুলী পেপার মিল কাগজ সরবরাহ না করায় সঠিক সময়ে ৪০ লাখ বই ছাপায় অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। ফলে ১ জানুয়ারি প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দেয়া নিয়ে শঙ্কায় রয়েছে এনটিসিবির কর্মকর্তারা। এই শঙ্কার মধ্যেই বিনামূল্যের বই প্রকাশ্যে বিক্রি হচ্ছে বিভিন্ন বইয়ের দোকানে। বুধবার বিকেলে এ প্রতিবেদক ক্রেতা সেজে বই কিনতে যান রাজধানীর পীরজঙ্গি মাজার মার্কেটের ফেনলি লাইব্রেরি অ্যান্ড পাবিকেশন্সে। প্রাথমিক শ্রেণির পাঠ্যবই আছে কিনা জানতে চাইলে লাইব্রেরির বিক্রেতা মো. হালিম বলেন, প্রাইমারির সব ক্লাসের বই আছে, আপনার কোন শ্রেণির বই দরকার? প্রথম শ্রেণির বই চাইলে তিনটি বই বের করে দিয়ে বলেন, একদাম দুইশ’ টাকা। কোনো দামাদামি করবেন না। সরকারি বই এত দাম কেন প্রশ্ন করলে? তিনি বলেন, স্কুলে বই দেবে জানুয়ারিতে। এবার তাও ভাগ্যে জুটবে কিনা সন্দেহ আছে। আমরা ব্যবসা করার জন্য বেশি দামে কিনে এনেছি। সরকারি বই কোথা থেকে কিনে এনেছেন প্রশ্ন করলে ক্ষিপ্ত হয়ে হালিম বলেন, টাকা দেবেন বই পাবেন। এত কিছু আপনার জানার দরকার কি?  এদিন মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের সামনে প্রথম শ্রেণির বই হাতে এক নারীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। এসময় সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে তার সঙ্গে কথা বললে রাজধানীর আরামবাগ এলাকার বাসিন্দা তানিয়া রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ছেলে আয়নকে আরামবাগ রয়েল একাডেমিতে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি করেছি। ছেলেকে বাসায় বসে পড়ানোর জন্য একসেট পুরাতন বই সংগ্রহের জন্য অনেক চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছি। পরে ছেলের এক সহপাঠীর মায়ের কাছে শুনতে পেলাম ফেনলি লাইব্রেরিতে বই কিনতে পাওয়া যায়। তাই দুইশ’ টাকা দিয়ে বই কিনলাম। ১ জানুয়ারি সরকারই স্কুলে বই দেবে তবে কেন টাকা দিয়ে কিনলেন? এমন প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ক্লাস শুরুর আগে বাসায় বসে ছেলেকে আগাম পড়ানোর জন্য টাকা দিয়ে বই কিনেছি। প্রথম শ্রেণির তিনটি বইয়ের গায়ে লেখা রয়েছে, পুনঃমুদ্রণ- অক্টোবর ২০১৫। ‘আমার বাংলা বই’ এর গায়ে লেখা রয়েছে, সংকলন, রচনা ও সম্পাদনায়- শফিউল আলম, মাহবুবুল হক, সৈয়দ আজিজুল হক ও নূর জাহান বেগম। ‘ইংলিশ ফর টুডে’ বইয়ের সম্পাদনায় রয়েছেন- এমএস হক, ইয়াসমিন বেনু, এমডি আব্দুর রাজ্জাক ও নিনা সাহজাদি। ‘প্রাথমিক গণিত’ বইয়ের রচনা ও সম্পাদনায়- আফম খোদাদাদ খান, সালেহ মতিন, হামিদা বানু বেগম, ড. মো. মোহসীন উদ্দিন। সবগুলো বইয়ের প্রিন্টার্স লাইলে প্রমা প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স, ৩৭/৩৮/১ নবদ্বীপলেন, লক্ষ্মীবাজার, ঢাকা-১১০০ লেখা রয়েছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, শুধু ফেনলি লাইব্রেরিতেই নয় রাজধানীর মোহাম্মদপুর, মিরপুর, নীলক্ষেত, বাংলাবাজারসহ অনেক লাইব্রেরিতেই প্রকাশ্যে বিনামূলের পাঠ্যবই বিক্রি হচ্ছে। সরকারের সুনাম ক্ষুণ্ণ করতে একটি চক্র পরিকল্পিতভাবে এ কাজটি করছে। অধিক লাভের জন্য ছাপাখানা থেকেই এসব বিভিন্ন বইয়ের দোকানে সরবরাহ করা হচ্ছে। যার ফলে প্রাথমিকের বই ছাপায় সঙ্কট তৈরি হয়েছে।  অপর একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, এনসিটিবির কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারী মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময় বিনামূল্যে বিতরণের জন্য লেখকদের সম্পাদিত বই এর মূল কপি প্রকাশকদের কাছে সরবরাহ করে। প্রকাশকরা নিম্নমানের কাগজে পাঠ্যবই ছেপে আগাম বাজারে ছেড়ে দিয়েছে। তবে প্রশাসনের নাকের ডগায় এসব বই বিক্রি হলেও তারা নীরব রয়েছে। যে কারণে শিক্ষায় সরকারের বড় সাফল্য ১ জানুয়ারি শিক্ষার্থীদের হাতে বিনামূল্যে বই তুলে দেয়ার সাফল্য এবার ম্লান হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। এ বিষয়ে মুঠো ফোনে জানতে চাইলে ফেনলি লাইব্রেরি অ্যান্ড পাবিকেশন্সের মালিক মো. বদরুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, অভিভাবকরা অনেক সময় বোর্ডের বই এনে দিতে অনুরোধ করেন। সে কারণে হয়তো কর্মচারীরা বাংলাবাজার থেকে এসব বই এনে বিক্রি করছে। তবে বিষয়টি আমার জানা নেই। এনসিটিবির সদস্য (টেক্সট) অধ্যাপক মিয়া ইনামুল সিদ্দিকী জাগো নিউজকে বলেন, কোথা থেকে এসব বই দোকানে এলো তা অবশ্যই তদন্ত করে দেখা হবে। দোকানে গিয়ে বই পেলে বিক্রেতাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে। বইয়ের প্রিন্টার্স লাইনে যাদের নাম আছে তাদের বিরুদ্ধেও তদন্ত করা হবে। ঘটনার শীর্ষ তদন্ত করে প্রমাণ পেলে সর্বোচ্চ শাস্তি দেয়া হবে। এনএম/এসএইচএস/এমএস

Advertisement