প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম
Advertisement
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের কর্ণগোপ এলাকায় হাসেম ফুড অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেডের কারখানায় ভয়াবহ আগুন লাগে ৯ জুলাই বিকেল পাঁচটায়। পরদিন দুপুরের পর আগুন নিয়ন্ত্রণে আসলেও পুরোপুরি নেভানো যায়নি ৩০ ঘন্টা পরেও। এত ছোট কারখানায় এত দীর্ঘস্থায়ী আগুন খুবই বিস্ময়কর।
দমকল বাহিনী ৫২ জনের পোড়া লাশ উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেলের বার্ণ ইউনিটে পাঠিয়েছে। লাশগুলো এতটাই পুড়ে গেছে, সেগুলো দেখে চেনা বা শনাক্ত করার উপায় নেই। মর্গের পাশে একজনের স্বজনের আহাজরি, ‘লাশ কী, বস্তায় কইরা সব কয়লা আনছে’। কারখানার পাঁচ ও ছয়তলায় দরজায় কলাপসিবলে তালা দেয়া থাকায় কেউ বের হতে পারেনি। সবার শরীর আগুনে পুড়ে অঙ্গার হয়ে গেছে।
দমকল বাহিনীর আঠারোটি ইউনিট এসে আগুন নেভানোর কাজ করছেন। তাঁরা পানি ছিটিয়ি আগুনের ভয়াবহতা কমানোর চেষ্টা করেছেন। কিন্তু সেই আগুন পানিতে নেভেনি। জানা গেছে ৩০ ঘন্টা পরেও আগুন ফিনকি দিয়ে জ¦লে উঠে জানালা দিয়ে শিখা বের হচ্ছিল।
Advertisement
বেভারেজ কারখানাটিতে ছিল দাহ্য পদার্থের মজুত। ভবনটির দোতলায় ছিল জুস, লাচ্ছি, চকোলেট, টোস্ট বিস্কুট, সেমাই, ললিপপ ইত্যাদি তৈরির কারখানা। নিচতলায় ছিল পলিথিন তৈরির কারখানা। সেখানে কেমিক্যালের গুদাম, প্লাস্টিক, পলিথিন পেপারস, ভোজ্যতেলসহ নানা ধরনের দাহ্য পদার্থ মজুদ ছিল। যেগুলোতে পানি দিলে আরো বেশি ছড়িয়ে যাচ্ছিল ভয়াবহ আগুন। দাহ্য পদার্থের আগুন নেভাতে আধুনিক যেসব জিনিষ ব্যবহার করা হয় যেমন- ড্রাই কার্বনডাই অক্সাইড, অগ্নিনির্বাপণ কেমিক্যাল পাউডার, ফোম ইত্যাদি দিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা করা হয়নি বলে অভিযোগ করেছেন কেউ কেউ। বিপুল পরিমাণ প্লাস্টিক ও তৈল জাতীয় পদার্থ থাকায় পানি দিয়ে কাজ হয়নি।
স্বজনদের একজন বলেছে, বারো বছরে কাজে নেমেছিল তার ছোটভাই। আগুনের সময় ভবনে আটকা পড়ে তার বড়ভাইয়ের সাথে মোবাইল ফোনে শেষ কথা ছিল- চারপাশে আগুন, কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। আরেকটি ছোট্ট মেয়ের লাশ খুঁজে পাবার পর দেখা গেছে তার শরীর পুড়ে গেলেও চোখে কাজলের দাগ পুড়েনি। গত সন্ধ্যায় সে কাজল দিয়েছিল। তার স্বজনরা চোখের কাজল দেখে তাকে শনাক্ত করেছে। হাসপাতালের মর্গে সারি সারি লাশ। এরা সবাই ১৪ থেকে ১৬ বছরের মেয়ে শ্রমিক। করোনায় স্কুল বন্ধ থাকায় অনেকে পার্ট-টাইম কাজ করে কিছু রোজগারের আশায় কাজে যোগ দিয়েছিল। জানা গেছে, এই মৃত ৫২ জনের ভস্মদেহের ফরেনসিক টেস্টের ফলাফল কমপক্ষে ২১ দিন পর জানা যাবে। লাশের জন্য এতদিন কষ্ট করে অপেক্ষা করার ধৈর্যের বাঁধ যেন অটুঁট থাকে এসকল স্বজনদের -এই আশা করি।
নির্মমতা কম-বেশি সব অগ্নিকান্ডে ঘটে থাকে। আজকাল নিম্ন আয়ের মানুষদের বসতবাড়ি, বস্তি, কর্মস্থলে বেশি অগ্নিকান্ড ঘটতে দেখা যায় বেশি। প্রায় সব অগ্নিকান্ডের পর মালিক ও মালিক পক্ষের লোকজনকে খুঁজে পাওয়া যায় না। তারা বরারবরই অকুস্থল থেকে দূরে পালিয়ে থাকেন। কর্ণগোপের হাশেম বেভারেজ কারখানার মালিককে অগ্নিকান্ডের পরে ২৪ ঘন্টায় একবারও আসতে দেখা যায়নি। উল্টো তিনি বলেছেন, “ইন্ডাস্ট্রী করে ভুল করেছি.. আগুন লাগতেই পারে, এটা নিছক দুর্ঘটনা। এ দায় আমার নয়।”
এভাবে ২০১২ সালে তাজরীন ফ্যাশনস্ গার্মেন্টস-এ ১১২ জন পুড়ে মারা যাবার পরও তার মালিক বলেছিলেন, “মামলা হলেও আমার কিস্সু হবে না।”এভাবে নব্য পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় মালিকদের দম্ভ ও নির্মমতার দায় এড়িয়ে যাওয়া সত্যিই বেদনাদায়ক।
Advertisement
কারখানায় অগ্নিকান্ডে সবচেয়ে খারাপ দিক হলো- কাজের সময় শ্রমিকদের বের হবার গেট তালাবদ্ধ করে রাখা। রানাপ্লাজা, তাজরীন এবং সর্বশেষ হাশেম বেভারেজের মেইন গেট তালাবদ্ধ ছিল। এমনকি প্রতি ফ্লোরে আলাদা কলাপসিবল গেটের তালা লাগানো ছিল। কারণ, প্রতিটি তলায় ভিন্ন ভিন্ন কারখানা। জরুরি নির্গমণের পথও বন্ধ থাকায় তালাবন্ধ গেটে কাছে এসে তারা ধোঁয়ায় দমবন্ধ হয়ে চিৎকার, আহাজারি করতে করতে মারা গেছে।
তাহলে বলা যায়, এসকল দুর্ঘটনা নিছক কোন দুর্ঘটনাই নয় -এগুলো মানবসৃষ্ট বিপর্যয়। কারখানায় কাজ চলাকালীন গেটে তো দারোয়ান দরজা ভিড়িয়ে পাহারায় থাকে। তাহলে তালাবন্ধ করে রাখতে হবে কেন? তালাবন্ধ থাকার কারণে এতগুলো কচি প্রাণ পুড়ে অঙ্গার হবে কেন?
মালিকরা কি শ্রমিকদেরকে কেন অবিশ্বাস করে? শ্রমিকরা কি কাজের সময় ফাঁকি দিয়ে বাইরে গিয়ে আড্ডা দেয়? নাকি কিছু চুরি করে গেট দিয়ে বাইরে পাঠায়?যদি এসকল সমস্যা কোথাও থাকে তাহলে তার জন্য তো গার্ড ও সিসি ক্যামেরাই যথেষ্ট। এছাড়া শ্রমিকদের বেতন বন্ধ, চাকুরি চলে যাবার ভয় তো আছেই। তাহলে তালাবন্ধ রেখে ধোঁয়ায় দমবন্ধ হয়ে শ্রমিক মারা গেলে দায়টা কেন মালিকপক্ষ নেবেন না?
প্রচলিত ১৯২৩ সালের শ্রমিক ক্ষতিপূরণ আইন বা পরবতীর্তে সংশোধিত শ্রম আইনে শ্রম দুর্ঘটনায় নিহত শ্রমিকদের জন্য সামান্য ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা থাকলেও সেটা পেতে যেরূপ হেনস্তা হতে হয় তা শুধু ভুক্তভোগীরাই জনেন। আইনের মারপ্যাঁচে শ্রমিক জীবন কী এতই মূল্যহীন?
হাশেম ফুড অ্যান্ড বেভারেজের অগ্নিকান্ডে নিহত শ্রমিকরা এ মাসের বেতন পায়নি। একজন নিহতের স্বজন গণমাধ্যমকে জানিয়েছে, “বিনা বেতনে মারা গেল মেয়েটা।”আসলে ওদের অনেকের বয়স ১৪-১৬ বছরের মধ্যে। ওরা অনেকেই শিশু শ্রমিক। এছাড়া শর্ত পূরণ করে কারখানা নির্মাণ ও পরিচালনার কথা বলা হলেও “এসব কারখানা নির্মাণে কোন শর্তই মানা হয় না।”এভাবে শর্ত উপেক্ষা করে কারখানা নির্মাণ ও শিশু শ্রমিক নিয়োগ করে আইন ভঙ্গকারীদের কারখানা পরিচালনা করা কি অপরাধ নয়? এজন্য প্রচলিত আইনে কি কোন কঠিন শাস্তি নেই? তাহলে এসব দুর্ঘটনার দায়ভার অন্যের উপর চাপিয়ে দিয়ে মালিকদের দম্ভোক্তি আর কত যুগ শুনতে হবে?
লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডীন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান। fakrul@ru.ac.bd
এইচআর/জেআইএম