দেশের সবচেয়ে বড় বেনাপোল স্থলবন্দরে নিরাপত্তায় বসছে সিসি ক্যামেরা। ব্যবসায়ীদের দাবির মুখে বন্দরে আমদানি পণ্যের নিরাপত্তায় সিসি ক্যামেরা স্থাপনের কাজ শুরু করেছে কর্তৃপক্ষ। ১৫ কোটি টাকা ব্যয়ে পুরো বন্দর এলাকায় বসানো হবে ৩৭৫টি সিসি ক্যামেরা। তাই ব্যস্ত সময় পার করছেন শ্রমিকরা।
Advertisement
বন্দর কর্তৃপক্ষ বলছে, সিসি ক্যামেরা যেমন বন্দরের নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে, তেমনি পণ্য আমদানি থেকে শুরু করে খালাস পর্যন্ত বাণিজ্য কার্যক্রম পুরোটা বন্দরের নজরদারিতে থাকবে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, দীর্ঘদিন পরে হলেও সিসি ক্যামেরা স্থাপনে ব্যবসায়ীরা খুশি।
খোঁজ জানা যায়, দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭২ সালের জুন মাসে আনুষ্ঠানিকভাবে বেনাপোল চেকপোস্ট দিয়ে আমদানি-রফতানি কাজ শুরু হয়। এ সময় বাংলাদেশ পাট মন্ত্রণালয় আমদানি-রফতানি কাজ তদারকি করতেন। ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বেনাপোল পরিদর্শন করেন। তিনি পাট মন্ত্রণালয়কে আমদানিকৃত পণ্য রাখার জন্য গুদাম নির্মাণের নির্দেশ দেন।
Advertisement
১৯৮৪ সাল পর্যন্ত পাট মন্ত্রণালয়ের অবলুপ্ত ওয়ার হাউজিং করপোরেশন বেনাপোলে ১১টি পাকা গুদাম নির্মাণ করে। ১৯৮৪-৮৫ অর্থবছরে বেনাপোল বন্দরের দায়িত্ব নেয় মংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ। বেনাপোল ও যশোর উন্নয়ন পরিষদ ছাড়াও স্থানীয় সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশন ১৯৯০ সাল থেকে বেনাপোলকে পৃথক স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ ঘোষণার দাবি জানিয়ে বিভিন্ন আন্দোলন শুরু করে।
সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে এই দাবি মেনে নেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। কিন্তু এই দাবিকে উপেক্ষা করে ১৯৯৭ সালের ২৭ জানুয়ারি দেশের ১৮টি স্থলবন্দর নিয়ে ‘বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ’ গঠনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় মন্ত্রিপরিষদ সভায়। ২০০২ সালের ১ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন সরকার সংসদে আইন পাসের মাধ্যমে ‘বাংলাদেশে স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ’ গঠন করে। যার প্রধান কার্যালয় ঢাকায়। সেই থেকে ‘বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ’ বেনাপোল বন্দরের তদারকি করছে।
দেশের স্থলপথে যে বাণিজ্য হয় তার ৭০ শতাংশ হয়ে থাকে ভারতের সঙ্গে। তবে নিরাপত্তার স্বার্থে বেনাপোল কাস্টমস, ইমিগ্রেশন, ব্যাংকসহ সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান অনেক আগেই সিসি ক্যামেরার আওতায় আসলেও স্থলবন্দর এতদিন আসেনি সিসি ক্যামেরার আওতায়। এতে বন্দর থেকে পণ্য চুরি, মাদক পাচার, রহস্যজনক অগ্নিকাণ্ড, চোর সিন্ডিকেটের সদস্যদের হাতে বন্দরের নিরাপত্তা কর্মী হত্যাসহ নানা অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে আসছিল। এতে ব্যবসায়ীদের ক্ষোভ থাকলেও কেবল প্রতিশ্রুতির মধ্যে এতদিন সীমাবদ্ধ ছিল সিসি ক্যামেরা স্থাপনের কাজ।
অবশেষে এবার বন্দরের কিছু দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের হস্তক্ষেপে সে অপেক্ষার অবসান হচ্ছে। বন্দরের বাইপাস সড়ক, পণ্যাগার, ভারতীয় ট্রাক ও চ্যাচিস টার্মিনাল, আন্তর্জাতিক বাস টার্মিনাল, ঢাকা-কলকাতা মহাসড়কসহ বন্দরের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় বসছে ৩৭৫টি আধুনিক মানের সিসি ক্যামেরা।
Advertisement
সোমবার (১২ জুলাই) সকালে বন্দর অভ্যন্তরে গিয়ে দেখা যায়, প্রথম পর্যায়ে মাটির নিচ দিয়ে ক্যাবল সংযোগ ও পিলার নির্মাণের কাজ চলছে। স্মার্ট টেকনোলজি নামে একটি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের তদারকিতে প্রতিদিন অর্ধ-শতাধিক শ্রমিক এ কাজ করছেন।
বাংলাদেশ মোটরপার্টস ব্যবসায়ী সমিতি যশোর জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক ও আমদানিকারক শাহিনুর রহমান বলেন, ‘আমরা বেনাপোল বন্দর দিয়ে বেশি পরিমাণ মোটর পার্টস আমদানি করে থাকি। আমাদের অনেক ছোট আইটেমের পণ্য বেশি চুরি হয়। বন্দর থেকে আমদানি পণ্য চুরি হয়ে যাওয়ায় অনেক ব্যবসায়ীরা এপথে আমদানি বন্ধ করেছেন। আগে থেকে সিসি ক্যামেরা থাকলে এমন চুরি হতো না।’
বেনাপোল সিঅ্যান্ডএফ স্টাফ অ্যাসোসিয়েশনের বন্দর সম্পাদক আউয়াল হোসেন বলেন, ‘ভারতীয় ট্রাকে অবৈধভাবে পণ্য বন্দরে প্রবেশ করে পাচার হচ্ছে। আমদানি পণ্য চুরিসহ বিভিন্ন অনিয়মে যারা এ পথে আমদানি বন্ধ করেছেন সিসি ক্যামেরায় নিরাপত্তা পেলে তারা আবার ফিরে আসবেন।’
বেনাপোল সিঅ্যান্ডএফ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মফিজুর রহমান সজন বলেন, ‘বছরে বেনাপোল বন্দর দিয়ে ভারতের সঙ্গে ৪০ হাজার কোটি টাকার আমদানি ও ৮ হাজার কোটি টাকার রফতানি বাণিজ্য হয়ে থাকে। আমদানি বাণিজ্য থেকে সরকারের প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আসে। কিন্তু প্রয়োজনীয় অবকাঠামো আজও অবহেলিত। ব্যবসায়ীদের দীর্ঘদিনের দাবি সিসি ক্যামেরার স্বপ্ন পূরণ হতে চলেছে। এতে বন্দরে পণ্য চুরিসহ নানান অব্যবস্থাপনারোধ ও আমদানি পণ্যের নিরাপত্তায় বড় ভূমিকা রাখবে।’
বেনাপোল স্থলবন্দরের উপসহকারী প্রকৌশলী (বিদ্যুৎ) খোরশেদ আলম জানান, বেনাপোল স্থলবন্দরে প্রাথমিক অবস্থায় মাটির নিচ দিয়ে ক্যাবল ও পিলার বসানোর কাজ চলছে। ৬ থেকে ৮ মাসের মধ্যে সিসি ক্যামেরা বসানোর সব কাজ শেষ হবে।
বেনাপোল বন্দরের উপপরিচালক (ট্রাফিক) মামুন কবীর তরফদার বলেন, ‘ব্যবসায়ীদের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল বন্দরে সিসি ক্যামেরা স্থাপনের। এখন স্থাপনের কাজ চলমান। সিসি ক্যামেরা যেমন বন্দরের নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে, তেমনি পণ্য আমদানি থেকে শুরু করে খালাস পর্যন্ত বাণিজ্যিক কার্যক্রম পুরোটা বন্দরের নজরদারিতে থাকবে।’
মো. জামাল হোসেন/এসজে/এএসএম