মতামত

‘দুর্নীতির খবর প্রকাশ করাটাই অপরাধ’

মাছরাঙা টেলিভিশনের প্রধান বার্তা সম্পাদক রেজোয়ানুল হক রাজা এবং চ্যানেল২৪ এর বার্তা সম্পাদক বোরহানুল হক সম্রাটের বাবা-মা দুজনই করোনা আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। মা ছিলেন পুলিশ হাসপাতালের আইসিইউতে আর বাবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের আইসিইউতে। বৃহস্পতিবার চলে যান মা সাজেদা বেগম। স্ত্রীর মৃত্যুর খবর জানানো হয়নি অবসরপ্রাপ্ত রেল কর্মকর্তা তোফাজ্জল হোসেনকে। অবশ্য জানানোর মতো অবস্থায় তিনি ছিলেনও না। কিন্তু অদৃষ্ট হয়তো তাকে জানিয়ে দিয়েছিল। মাঝখানে দুদিনের বিরতি।

Advertisement

রোববার ভোরে তোফাজ্জল হোসেনও চলে গেলেন তার স্ত্রীর কাছে। দুদিনের ব্যবধানে বাবা-মাকে হারানোর ব্যথা কীভাবে সইবেন রাজা-সম্রাট; আমি জানি না। ফোন করে তাদের সান্ত্বনা জানানোর সাহসও হয়নি আমার। করোনায় প্রতিদিন দুইশর উপরে মানুষের মৃত্যু, রূপগঞ্জে হাসেম ফুড কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে ৫২ জন মানুষের মৃত্যু এবং রাজা-সম্রাটের বাবা-মায়ের মৃত্যু সব মিলিয়ে মনটা ভীষণ খারাপ। শঙ্কা আর আতঙ্কের একটা কালো মেঘ ছেয়ে আছে আমার এবং আমাদের সবার মনে।

এর মধ্যে গণমাধ্যম আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি ছবি দেখে মনটা আরও খারাপ হয়ে গেল। অসুস্থ অবস্থায়ই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় গ্রেফতার করা হয় জাগোনিউজ২৪.কমের ঠাকুরগাঁও জেলা প্রতিনিধি তানভীর হাসান তানুকে। গ্রেফতারের পর অসুস্থতা বেড়ে গেলে তাকে নেয়া হয় ঠাকুরগাঁও আধুনিক জেলা সদর হাসপাতালে। সেখানে তিনি বিছানায় শুয়ে আছেন। তাকে হাতকড়া পরিয়ে হাসপাতালের বিছানার সাথে বন্দি করে রাখা হয়েছে।

একজন সাংবাদিককে হাসপাতালের বিছানায় হাতকড়ায় আটকে রাখা হয়েছে, এ ছবিটি আমাদের আতঙ্কিত করে। সাংবাদিক হলেই তাকে গ্রেফতার করা যাবে না, হাতকড়া পরানো যাবে না, এমনটা আমি মনে করি না। সাংবাদিকরা আইনের ঊর্ধ্বে না। একজন সাংবাদিক একজন ব্যক্তিও। তিনি অপরাধ করলে অবশ্যই প্রচলিত আইনে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যাবে। কিন্তু বিষয়টা যখন সাংবাদিকতা সংক্রান্ত, তখন আমাদের শঙ্কিত না হয়ে উপায় নেই।

Advertisement

তানভীর হাসান তানুর বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করা হয়েছে। এ মামলায় আসামি করা হয়েছে বাংলাদেশ প্রতিদিনের জেলা প্রতিনিধি আব্দুল লতিফ লিটু ও নিউজবাংলা টোয়েন্টিফোর ডটকমের জেলা প্রতিনিধি রহিম শুভকেও। তারা কী এমন অপরাধ করেছেন? অসুস্থ অবস্থায় গ্রেফতার করে তানুকে যে হাসপাতালের বিছানার সাথে হাতকড়া দিয়ে আটকে রাখা হয়েছে, সে হাসপাতালে করোনা রোগীদের খাবারের অনিয়ম নিয়ে তিনি রিপোর্ট করেছিলেন। সেটি প্রকাশিত হয়েছে জাগোনিউজ২৪.কমে। ব্যস এইটুকুই অপরাধ।

তানু যে রিপোর্ট করেছেন, সেটি ভুল হতেই পারে। সংবাদপত্রে প্রকাশিত সব রিপোর্ট সত্যি নাও হতে পারে। ইচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছায়, গণমাধ্যমে প্রকাশিত ভুল তথ্য কাউকে না কাউকে সংক্ষুব্ধ করতে পারে। সংবাদপত্রের ভুল খবরে সংক্ষুব্ধ মানুষের প্রতিকার পাওয়ার নানা উপায় আছে। সংশ্লিষ্ট গণমাধ্যমে প্রতিবাদ পাঠানো, উকিল নোটিশ পাঠানো, প্রেস কাউন্সিলে মামলা। কিন্তু আমরা সবকিছুতে শর্টকাটে বিশ্বাস করি। প্রচলিত বিচার ব্যবস্থায় আমাদের আস্থা নেই। আমরা ‘ক্রসফায়ার’ বিচারে বিশ্বাসী। তেমনি সাংবাদিকদের বিরুদ্ধেও ‘আমরা ধর তক্ত মার পেরেক’ আইন চাই। আর সরকার এই দুষ্টচক্রের হাতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন তুলে দিয়েছে। ব্যস, কোথাও কোনো নিউজ কারও বিপক্ষে গেলেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা ঠুকে দাও, পুলিশ সাংবাদিককে ধরে হাতকড়া পরিয়ে নিয়ে যাবে। ডান্ডা মেরে ঠান্ডা করে দাও সাংবাদিকতাকে।

তানভীর হাসান তানুর রিপোর্টের শিরোনাম ছিল, ‘দিনে বরাদ্দ ৩০০ হলেও করোনা রোগীদের খাবার দেয়া হচ্ছে ৭০ টাকার!’ আমি নিশ্চিত, বাংলাদেশের প্রতিটি হাসপাতালেই এ ধরনের অনিয়ম হয়। তার পরও ঠাকুরগাঁওয়ের খবরটি সত্য না মিথ্যা এটা নিয়ে তদন্ত হতে পারতো। কিন্তু হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. মো. নাদিরুল আজিজ যে মামলা করেছেন, তাতেই রিপোর্টটি যে সত্য তা উঠে এসেছে। মামলায় বলা হয়, ‘গত জুন মাসে ২/১ দিন খাবার সরবরাহে সামান্য ব্যত্যয় ঘটলেও অন্যান্য সময় সরকারি বরাদ্দ মোতাবেক যথাযথভাবে রোগীদের খাবার প্রদান করা হচ্ছে।’ ব্যত্যয় যদি ঘটেই থাকে, তাহলে মামলা করা হলো কেন? হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ যেটুকু ব্যত্যয় হয়েছে, তা তদন্ত করে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারতো। অথচ ঘটেছে উল্টো ঘটনা।

আসলে বাংলাদেশে এখন অনিয়ম করাটা অন্যায় নয়, অনিয়ম তুলে ধরাটাই অন্যায়। সত্য তুলে ধরলেও হাসপাতালের ‘ভাবমূর্তি বিনষ্ট’ হয়, ‘সুনাম ক্ষুণ্ণ’ হয়। শুধু ঠাকুরগাঁও নয়, একই চিত্র সারাদেশে। সাংবাদিকরাই যেন সবার প্রতিপক্ষ, সবার শত্রু। গত দেড় বছরে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বারবার শিরোনাম হয়েছে অনিয়ম আর দুর্নীতির দায়ে। শুধু গণমাধ্যম নয়, সংসদেও তোপের মুখে পড়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। কোনো অনিয়ম বা দুর্নীতির অভিযোগ উঠলে, প্রথম কাজ হলো সেটা তদন্ত করা, সত্যি হলে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া। কিন্তু আমাদের দেশে সেটা হয় না, যারা সত্য প্রকাশ করেন, তাদের কণ্ঠরোধে সবাই উঠে পড়ে লাগেন। সত্যটা যেন কেউ সহ্য করতে পারেন না।

Advertisement

গত ৮ জুলাই ঢাকার সিভিল সার্জন ডা. আবু হোসেন মো. মঈনুল আহসান এক নির্দেশনায় লিখেছেন, ‘বিরাজমান কোভিড-১৯ মহামারিকালীন পরিস্থিতিতে সিভিল সার্জন ব্যতীত অন্য কাউকে টিভি চ্যানেল কিংবা কোনো প্রকার প্রিন্ট মিডিয়ার নিকট স্বাস্থ্যসেবা বিষয়ক কর্মকাণ্ড অথবা রোগ ও রোগীদের সম্পর্কে কোনো ধরনের তথ্য আদান-প্রদান বা মন্তব্য না দেয়ার জন্য অনুরোধ করা যাচ্ছে। একই সাথে প্রিন্ট মিডিয়ার ব্যক্তিদের রোগীর ছবি তোলা, ভিডিও ধারণ করা অথবা সাক্ষাৎকার ধারণ করা থেকে বিরত থাকার নিমিত্তে নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা যাচ্ছে।’ এর চেয়ে সরাসরি বলে দেয়া ভালো, সাংবাদিকতাটাই করার দরকার নাই। যদি কেউ তথ্য না দেয়, যদি কোনো ছবি তোলা না যায়, যদি কারও সাক্ষাৎকার নেয়া না যায়; তাহলে সাংবাদিকরা লিখবেন কীভাবে?

যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ঠাকুরগাঁওয়ে তিন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা করা হলো, এ আইনটি প্রণয়নের সময় থেকেই আমাদের শঙ্কা, গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধে এ আইনের অপপ্রয়োগ হতে পারে। তখন সরকারের নীতিনির্ধারকরা বারবার আশ্বস্ত করেছেন, সাংবাদিকদের ভয়ের কোনো কারণ নেই। কিন্তু যতই দিন যাচ্ছে, সাংবাদিকদের শৃঙ্খলিত করার সবচেয়ে বড় অস্ত্র হয়ে উঠছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। আমরা আবারও আইনটি বাতিলের দাবি করছি।

সাংবাদিকদের কাজটা অনেক কঠিন। সত্যপ্রকাশের পদে পদে বাধা। মামলা-হামলাসহ নানারকম ঝুঁকি ঠেলে সাংবাদিকদের কাজ করতে হয়। যত বাধাই আসুক, সাংবাদিকদের সত্যপ্রকাশ করে যেতে হবে। সরকারের কাজ জনগণের জন্য কাজ করা। সাংবাদিকদের কাজ হলো, অনিয়ম হলে সেটা তুলে ধরা। এখানে সাংবাদিকদের প্রতিপক্ষ না বানিয়ে, প্রকাশিত সংবাদ আমলে নিয়ে তদন্ত করে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে সবারই উপকার হয়।

•এই লেখার শেষে জানলাম, জামিনে মুক্তি পেয়েছেন তানভীর হাসান তানু। আদালতকে ধন্যবাদ দ্রুত জামিনের ব্যবস্থা করায়। দাবি জানাচ্ছি, অবিলম্বে মিথ্যা মামলাটি প্রত্যাহার করা হোক।

এইচআর/এএসএম