মতামত

কারখানা নাকি মৃত্যুকূপ?

এক শিল্প গোষ্ঠীর বড় কর্তার সঙ্গে দেখা। খুব ছটফট করছিলেন। তাকে কয়েকটি কারখানা পরিদর্শনে যেতে হবে। তাড়া ছিল বলে চা না খেয়েই উঠে পড়লেন। যেতে যেতে বললেন- সরকারের একটি দফতর থেকে বলা হয়েছে, সেজান জুসের দুর্ঘটনার পর, তারা এখন একটু তৎপরতা দেখাবে। কিছু কারখানায় অভিযান চালিয়ে জরিমানা করবে। তাই শিল্প গোষ্ঠীর কর্তা উদ্বিগ্ন । তার মতে, কারখানায় এমন বড় দুর্ঘটনা ঘটলে কিছুদিন দৌড় ঝাঁপ চলে, তারপর আবার সুনসান। এ সময়টায় ঐ দফতর গুলোকে নানা ভাবে সামাল বা ম্যানেজ করতে হয়। না হলে সব ঠিক ঠাক আছে এমন কারখানাকেও জরিমানা গুণতে হয়। ঐ শিল্প গোষ্ঠীর কর্তার মতে, দফতর গুলো ভাল করেই জানে কোন কারখানা গুলো ঝুঁকিপুর্ণ, কোথায় অবৈধ সংযোগ রয়েছে । কিন্তু উপরির টোটকায় চোখ বুঁজে থাকে বছর জুড়ে। কোন দুর্ঘটনা ঘটলেই শুধু তারা চোখের পাতা মেলেন ।

Advertisement

দেশের কারখানা গুলোতে শিশু শ্রমিক ব্যবহার করা হয় প্রকাশ্যেই। বলা হয়, আর্থিক সক্ষমতা বিবেচনায় শিশুশ্রম সয়ে যাওয়া হয়। কারণ এই শিশু শ্রমিকদের ওপর নির্ভরশীল অসংখ্য পরিবার। কারখানা থেকে শিশু শ্রমিকদের সরিয়ে নেওয়া হলে, পরিবারের আয়ের উৎস বন্ধ হয়ে যাবে। আমরা সেজান জুস কারখানাতেই দেখলাম, কারখানাটি মূলত শিশু শ্রমিক নির্ভর ছিল । ১০/ বছরের শিশুদের দূর দূরান্ত ও আশপাশের এলাকা থেকে নিয়ে আসা হতো। শিশুদের এখনকার পানির দরের চেয়েও কম দামে পাওয়া যায়। কিন্তু পরিবারের ভাত জোগাতে, ঋণের সুদ পরিশোধ করতে, পরিবারের কারো চিকিৎসার খরচ জোগাড় করতে শিশুরা শ্রম দিতে এসে আগুনে পুড়ে, গলে এখন পরিচয়হীন মাংসপিন্ড।

যেখানেই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে, দেখা যায় কোন দফতরই প্রথম প্রথম নিজেদের অবহেলা , দায়িত্বহীনতা বা প্রশ্রয়ের দায় নিতে চায় না । কিন্তু ধীরে ধীরে নিজেদের মধ্যকার রেষারেষি তদন্ত বা গণমাধ্যমের অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে সত্য। দুর্ঘটনাস্থলে বিদ্যুৎ, গ্যাসের অবৈধ বা ত্রুটিপূর্ণ সংযোগের হদিস পাওয়া যায়। খোঁজ মিলে কেমিক্যাল গুদাম, মেয়াদ পেরিয়ে যাওয়া বয়লার বা অন্যান্য যন্ত্রাংশের। যা সাধারণ ভাবে কারখানা পরিদর্শক দল, বিভিন্ন সেবা সংস্থার রুটিন পরিদর্শনেই নজরে আসার কথা। আগেই বলছিলাম চোখ বুঁজে থাকার কথা। সংস্থা গুলোর ভাত ঘুম দুঃস্বপ্নের জীবন এনে দেয় মালিক দ্বারা বঞ্চিত শ্রমিকদের পরিবারে। সেজান জুস কারখানাতেও বেতন ও ওভারটাইমের পাওনা বকেয়া রাখার অভিযোগ পাওয়া গেল।

তদন্তকারী দলের প্রয়োজন হয় না। দরকার হয় না গভীর অনুসন্ধানের। খালি চোখেই সাধারণ নাগরিকদের চোখে পড়ে, জোড়াতালি দেওয়া গ্যাসের অবৈধ সংযোগ, সরবরাহ পাইপ লাইনের জরাজীর্ণ অবস্থা। বিদ্যুতের ট্রান্সফরমারের রুগ্ন দশা। স্বাভাবিক নিয়মে এগুলো বিচ্ছিন্ন, মেরামত বা পুনঃস্থাপন হয় না। দায়িত্ববোধ ও তাগিদের অভাব। সরকারি কর্মচারি বা প্রতিষ্ঠান মানেই, শম্বুক চলার ধরন।

Advertisement

গতিমূল্য বা স্পিডমানি দেওয়া না হলে তারা চলতে জানেন না। নিরাপদ সেবা নিশ্চিত করা যে তাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে, এই বোধটি তাদের মধ্যে কখনও জাগ্রত হয়নি। যেমনটি দেখা যায় না অনেক কারখানা মালিকের মধ্যেই। শ্রমিকের নিরাপত্তা ও জীবনমান নিশ্চিত হলে, পণ্যের মানেও যে প্রাপ্তিযোগ ঘটে, ব্র্যান্ড মান বাড়ে, ভোক্তার আস্থা দৃঢ় হয়, এই দায়িত্বশীল উদ্যোক্তাসুলভ আচরণ বরাবরই অনুপস্থিত।

সেই অনুপস্থিতিতে গড়া কারাগারে বন্দি শ্রমিকদের হাতে, ঘামে তৈরি যে পণ্য আমরা ভোগ করছি, উদযাপন করছি সেখানে মিশে তাদের দগ্ধ হবার ছাই। তা উড়িয়ে দেখলেই আমরা দেখতে পাবো কারখানা নয়, একেকটি মৃত্যুকূপ।

লেখক : গণমাধ্যমকর্মী।

এইচআর/এমএস

Advertisement