মতামত

সিপিসি’র অভিজ্ঞতা থেকে রাজনৈতিক দলগুলো যা শিখতে পারে

দেখতে দেখতে প্রায় নয় বছর কাটলো। নয় বছর ধরে খুব কাছ থেকে দেখছি চীন, চীনের মানুষ, চীনের হালচাল। শহর থেকে গ্রাম, উন্নত অঞ্চল থেকে তুলনামূলকভাবে কম উন্নত অঞ্চল, বিশাল শপিং মল থেকে একেবারে আটপৌরে কাঁচাবাজার—সর্বত্রই পড়েছে আমার অনুসন্ধানী নজর; গভীর রাতে সুনসান রাস্তায় একা একা হেঁটে, কর্মদিনের ব্যস্ততম সময়ে প্রচণ্ড ভিড়ে পাতাল রেলে চড়ে, বিশাল বিশাল বিমানবন্দরের নান্দনিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে, কিংবা শহরতলীর ছোট্ট বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে— আমি উপলব্ধি করার চেষ্টা করেছি চীনকে, চীনের আত্মাকে। গত নয় বছর ধরে আমি চীনের অনেককিছু দেখেছি, উপলব্ধি করেছি। কিন্তু আমাকে যদি কেউ জিজ্ঞেস করেন: চীনের সবচেয়ে আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য কী? আমি বিনা দ্বিধায় বলব, সুশাসন।

Advertisement

চীনের সর্বত্রই সুশাসনের ছাপ—রাস্তায়, পাড়ায়, মহল্লায়, পার্কে, অফিস-আদালতে, বাজারে, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে, ব্যাংকে, শপিং মলে, মুদি দোকানে, হোটেলে, রেস্তোরাঁয়, পর্যটনকেন্দ্রে, সিনেমাহলে, স্টেডিয়ামে, মিউজিয়ামে—সর্বত্রই। না, এই সুশাসন নিশ্চিত করতে চীনকে পুলিশি রাষ্ট্রে পরিণত করার দরকার হয়নি। গত নয় বছরে আমি পুলিশ দেখেছি হাতে-গোনা। কোনোদিন কোনো পুলিশ আমাকে এসে চার্জ করেনি, দেখতে চায়নি আমার পাসপোর্ট। রাস্তার মোড়ে মোড়ে পুলিশের টহলগাড়িও দেখা যায় কালেভদ্রে। চীনের রাস্তায় দুর্ঘটনা ঘটে সামান্যই। কারণ, প্রায় সবাই আইন মেনে চলেন; ট্রাফিক আইন অমান্য করেন না। তারপরও যদি দুর্ঘটনা ঘটেই যায়, তবে দুর্ঘটনাকবলিত গাড়ির চালকই পুলিশকে ফোন করেন এবং পুলিশের আসা অব্দি অপেক্ষা করেন।

যখন একটি দেশ ব্যর্থ রাষ্ট্রের তকমা পায়, কুশাসনে আচ্ছন্ন হয়, দারিদ্র্যের বা বৈষম্যের কষাঘাতে হয় জর্জরিত, তখন এর দায় কার? নিশ্চয়ই ক্ষমতাসীন দলের! এ কথা কিন্তু উল্টোভাবেও সত্য। যখন কোনো দেশে সুশাসন কায়েম হয়, দেশ উন্নয়নের পথে দৃপ্ত পদক্ষেপে এগিয়ে যেতে থাকে, জনগণের মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ হয়, জনগণের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়, তখন তার কৃতিত্বও সেই ক্ষমতাসীন দলেরই! চীনের ক্ষমতাসীন দল হচ্ছে চীনা কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিসি)। ঠিক এক শ বছর আগে এই দলটির জন্ম হয়েছিল। জন্মের তিন দশকের মাথায় দলটির হাত ধরে প্রতিষ্ঠিত হয় নয়াচীন। তার পরের সাত দশক ধরে নয়াচীন শাসনের দায়িত্ব পালন করে আসছে দলটি। নয়াচীনের যা-কিছু ব্যর্থতা, তার দায় যেমন সিপিসি’র; তেমনি যা-কিছু সাফল্য, তার কৃতিত্বও সিপিসি’র।

যে-পার্টির জন্ম জনগণকে নিয়ে বা জনগণের মধ্যে, যে-পার্টির বেড়ে ওঠা জনগণকে সঙ্গে নিয়ে, যে-পার্টি নিবেদিত জনগণের প্রকৃত কল্যাণে—সে-পার্টি সফল হয়। সিপিসি তেমন একটি রাজনৈতিক দল। এই পার্টি ১৯২১ সালে জন্ম নিয়েছিল তত্কালীন শতধা বিভক্ত চীনের নির্যাতিত, নিপীড়িত, ভুখা-নাঙ্গা জনগণের মধ্যে। এই জনগণকে নিয়েই এ-পার্টি সামনে এগিয়েছে, পরিণত হয়েছে; আবার জনগণের কল্যাণেই এ-পার্টি কাজ করে গেছে। এভাবেই কেটেছে বিগত এক শতটি বছর।

Advertisement

বিগত এক শ বছরে সিপিসি সব কাজেই সফল হয়েছে, তা নয়। সাংস্কৃতিক বিপ্লবের কথা বা গ্রেট লিপ ফরোয়ার্ডের মতো কর্মসূচির কথা এখানে উল্লেখ করা যায়। ধ্রুপদি সমাজতান্ত্রিক সূত্র অনুসারে নেওয়া সেসব কর্মসূচি বলতে গেলে ব্যর্থই হয়েছিল। চীনা জনগণের সুখ-শান্তি-সমৃদ্ধির স্বপ্ন তাতে পূরণ হয়নি। এ ব্যর্থতার দায় সিপিসি অস্বীকার করে না। দলটি নিজের ভুল থেকে শিখেছে, পথ চলতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে আবার উঠে দাঁড়িয়ে সামনে এগিয়েছে। কিন্তু চলার পথে কখনও জনগণকে উপেক্ষা করেনি বা ছেড়ে দেয়নি বা জনগণের কল্যাণে কাজ করার লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হয়নি।

জনগণের কল্যাণের স্বার্থেই ১৯৭৮ সালে, তেং সিয়াও পিংয়ের আমলে, সিপিসি সংস্কার কর্মসূচি হাতে নেয়; নেয় চীনকে বাইরের দুনিয়ার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়ার যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত। আজকে সেই সিদ্ধান্তকে সহজ মনে হলেও, তখন কিন্তু তা মোটেও সহজ ছিল না! অনেকেই তখন সে-সিদ্ধান্তকে ‘সমাজতান্ত্রিক আদর্শ থেকে বিচ্যুতি’ হিসেবেই দেখেছেন। কোনো কোনো পণ্ডিত তো এই মর্মে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে, সিপিসি’র সেই কর্মসূচিও ব্যর্থ হবে।

কিন্তু শত সমালোচনার মুখেও সিপিসি জনগণকে সাথে নিয়ে সামনে এগিয়ে গেছে। আর সেই এগিয়ে যাওয়ার ফল হচ্ছে আজকের চীন। ১৯৭৮ সালের চীন ছিল নিম্ন আয়ের পশ্চাত্পদ দেশ, জিডিপি ছিল মাত্র ৩৬৭.৯ বিলিয়ন ইউয়ান (৫৬.৬৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার); আর আজকের চীনের জিডিপি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০১.৬ ট্রিলিয়ন ইউয়ানে (১৫.৭ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার), যা দেশটিকে নিম্ন আয়ের দেশ থেকে পরিণত করেছে মধ্যম আয়ের দেশে, বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতিতে। ১৯৭৮ সালে নয়াচীনের প্রায় ৮০ কোটি মানুষ ছিল হতদরিদ্র; আর আজকের চীনে একজন মানুষও দারিদ্র্যসীমার নিচে নেই। আজকের চীনে প্রায় শতভাগ নাগরিক স্বাস্থ্য-বিমার আওতায় এসেছে; আজকের চীনে নবম শ্রেণি পর্যন্ত বিনামূল্যের বাধ্যতামূলক শিক্ষা চালু আছে, বিদ্যালয়ে যাওয়ার উপযুক্ত প্রায় শতভাগ শিশু স্কুলে যায়; আজকের চীনে আছে পৃথিবীর সেরা যোগাযোগব্যবস্থা; আজকের চীন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতে অর্জন করেছে ঈর্ষণীয় সাফল্য; আজকের চীন নিজের শততম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করতে চায় সম্পূর্ণ স্বচ্ছল একটি সমাজ নির্মাণের মাধ্যমে।

চীনা কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিসি)-কে যে-কেউ অপছন্দ করতে পারে, কিন্তু এই পার্টির অর্জিত সাফল্যকে কেউ অস্বীকার করতে পারে না। ‘পার্টির অর্জিত সাফল্য’ বললাম, কারণ একটি দেশের ব্যর্থতার জন্য সেদেশের ক্ষমতাসীন দলকে দায়ী করা হয়; আবার উল্টোভাবে দেশের সফলতার কৃতিত্বও ক্ষমতাসীন দলই মূলত পায় বা দাবি করে। আমি তাই চীন তথা নয়াচীনের সাফল্যকে ‘সিপিসির সাফল্যই’ বলব, যদিও সিপিসি’র নেতারা এ সাফল্যকে ‘জনগণের সাফল্য’ বলতেই বেশি পছন্দ করেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে: ১৪১ কোটি দেশের একটি হতদরিদ্র দেশকে মাত্র চার দশকে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত করেছে যে-পার্টি, যে-পার্টির সদস্যসংখ্যা ইতোমধ্যেই সাড়ে নয় কোটি ছাড়িয়েছে, যে-পার্টির কাজে দেশের ৯০ শতাংশেরও বেশি মানুষ সন্তুষ্ট—সে-পার্টির কাছ থেকে বিশ্বের অন্যান্য দেশের ক্ষমতাসীন বা ক্ষমতার বাইরে থাকা রাজনৈতিক দলগুলো কী শিখতে পারে? এ প্রশ্নের উত্তর একেক জন একেকভাবে দেবেন জানি। আমার উত্তর এমন:

Advertisement

এক. রাজনৈতিক দলকে সবসময় জনসংশ্লিষ্ট থাকতে হবে। জনবিচ্ছিন্ন দল কখনও সফল হয় না, হতে পারে না; টিকেও থাকতে পারে না। গায়ের জোরে টিকে থাকলেও, সে-দল কখনও জনপ্রিয় হতে পারে না। সিপিসি’র গণমূখী কর্মসূচি, জনগণকে সাথে নিয়ে দেশ গড়ার চেতনা ও সে-চেতনার সফল বাস্তবায়ন, একে বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় রাজনৈতিক দলে পরিণত করেছে। জাপানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইউকিও হাতোমায়া বলেছেন, ‘জনগণের সাথে থাকাই সিপিসি’র বিশাল সাফল্যের মূল কারণ।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘চীনকে জাপানি আগ্রাসনসহ বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাত সহ্য করতে হয়েছে, বহু বাধা-বিপত্তির সম্মুখীন হতে হয়েছে; কিন্তু সিপিসি জনগণকে সাথে নিয়ে সকল দুর্যোগ সাফল্যের সঙ্গে মোকাবিলা করেছে।’ বস্তুত, শত বছর ধরে এই জনসংশ্লিষ্টতা সিপিসি-কে জনপ্রিয় করেছে, জনগণের কাছে সিপিসি’র গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়েছে। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি জরিপের ফল প্রকাশিত হয় ২০২০ সালের জুলাই মাসে। জরিপের ফল অনুসারে, সিপিসি’র নেতৃত্বাধীন চীনা কেন্দ্রীয় সরকারের কাজে সন্তুষ্ট ৯৩.১ শতাংশ চীনা নাগরিক। বলা বাহুল্য, চীনের ১৪১ কোটি মানুষকে বিবেচনায় রাখলে, বিশ্বের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল সিপিসি-কে বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনৈতিক দলও বলা যায়।

দুই. রাজনৈতিক দলকে জনগণের ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে মূল্য দিতে হবে, জনমতকে গুরুত্ব দিতে হবে, কথায় ও কাজে তার প্রমাণও দিতে হবে। প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং প্রায়ই বলেন: ‘পার্টিকে জনগণের মন বুঝতে হবে।’ জনগণের মন বোঝা মানে জনগণের চাহিদা বোঝা। মনে রাখতে হবে, মানুষ—সে যে দেশেরই হোক না কেন— অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান-চিকিত্সা-শিক্ষার নিশ্চয়তা চায়; নিশ্চয়তা চায় নিজের জানমালের। সিপিসি মানুষের এ মৌলিক চাহিদাগুলোকে সবচেয়ে বড় মানবাধিকার হিসেবে গণ্য করে থাকে। আর তাই, নয়াচীন প্রতিষ্ঠার পর থেকেই সিপিসি’র লক্ষ্য ছিল দারিদ্র্যমুক্ত, সুস্থ ও শিক্ষিত একটি সমাজ গড়ে তোলা।

তিন. রাজনৈতিক দলের ভিতরে গণতন্ত্রের চর্চা থাকা জরুরি। অনেকেই হয়তো এ কথা জেনে অবাক হবেন যে, সিপিসি’র মতো একটি সমাজতান্ত্রিক দলের ভিতরে গণতন্ত্রের চর্চা একটি স্বাভাবিক ব্যাপার। সিপিসি’র নেতৃবৃন্দ উঠে আসেন মূলত তৃণমূল থেকে। দলের সদস্যরাই তাদের নির্বাচন করেন। সিপিসি-তে পরিবারতন্ত্র বা এ ধরনের অন্য কোনো অযাচিত তন্ত্রের অস্তিত্ব নেই। এখানে নেতার সন্তান নেতা হন না, বরং ত্যাগী ও পরিশ্রমী কর্মীরাই পর্যায়ক্রমে নেতা হন। দলের ভিতরে গণতন্ত্রের—সিপিসি যাকে ‘সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র’ বলে থাকে—চর্চা থাকার কারণেই সি চিন পিং আজকে চীনের প্রেসিডেন্ট, সিপিসি’র শীর্ষ নেতা। তিনি উঠে এসেছেন একেবারে তৃণমূল পর্যায় থেকে, একটু একটু করে। সি চিন পিং পার্টির একজন সাধারণ কর্মী হিসেবে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে কাজ শুরু করেছিলেন। কৈশোর ও যৌবনের ৭/৮ বছর তাঁর কেটেছে গ্রামের কৃষক-শ্রমিক-কামার-কুমোর-জেলেদের সঙ্গে। তিনি তাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মাঠে-ময়দানে কাজ করেছেন; খুব কাছ থেকে দেখেছেন সাধারণ মানুষের জীবন, উপলব্ধি করেছেন তাদের সুখ-দুঃখের সাতকাহন। তৃণমূল পর্যায়ের এই অভিজ্ঞতা পরবর্তীতে তাঁর নেতৃত্বে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। দলের মধ্যে গণতন্ত্রের চর্চা আছে বলেই তিনি পর্যায়ক্রমে উঠে আসতে পেরেছিলেন পার্টির শীর্ষপদে। তাঁর অভিজ্ঞতা, সততা, আন্তরিকতা, দেশপ্রেম, গণমুখী চিন্তা-ভাবনা দ্বারা উপকৃত হচ্ছে দেশ ও দেশের জনগণ।

চার. রাজনৈতিক দলের মধ্যে আত্মশাসনের সংস্কৃতি থাকতে হবে। বিশেষ করে, দেশের ক্ষমতায় যাওয়ার পর, দল যাতে বেপরোয়া হয়ে উঠতে না-পারে; দলের নেতা-কর্মীরা যাতে লোভ-দুর্নীতিতে আচ্ছন্ন হয়ে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে না-যেতে পারে, সেদিকে কড়া নজর রাখতে হবে। আর এর জন্য চাই আত্মশাসন, দলের মধ্যে কঠোর শৃঙ্খলার চর্চা। প্রেসিডেন্ট সি দায়িত্ব নেওয়ার পর দুটো বিষয়ের ওপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে আসছেন: দারিদ্র্যবিমোচন ও দুর্নীতিদমন। ২০১৪ সালে ‘স্কাইনেট’ শীর্ষক দুর্নীতিদমন অভিযান শুরুর পর, ২০২১ সালের জুনের শেষ দিক পর্যন্ত, ২৪০৮ জন সিপিসি’র সদস্য ও সরকারি কর্মকর্তাসহ ৯১৬৫ জন পলাতক দুর্নীতিবাজকে ১২০টি দেশ থেকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়; ফিরিয়ে আনা হয় তাদের দ্বারা পাচারকৃত ৩.৩৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এ ছাড়া, সিপিসি’র অষ্টাদশ জাতীয় কংগ্রেসের পর, দেশব্যাপী সিপিসি-সদস্য ও সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ৩৮ লাখ ৫০ হাজার দুর্নীতির মামলা করা হয় এবং ৩৭ লাখ ৪২ হাজার ব্যক্তির বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়। আর ২০১৭ সালের অক্টোবরে সিপিসি’র ১৯তম জাতীয় কংগ্রেসের পর, দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের কারণে, ৪২ হাজার নেতাকর্মী স্বেচ্ছায় নিজেদের পার্টি বা সংশ্লিষ্ট সংস্থার কাছে আত্মসমর্পণ করেন, নিজেদের দুর্নীতি ও অনিয়মের কথা স্বীকার করেন। বলা বাহুল্য, দুর্নীতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে সি চিন পিংয়ের নেতৃত্বে সিপিসি’র অভ্যন্তরে শুদ্ধি-অভিযান আজও চলছে। দলের নেতা-কর্মীদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো-টলারেন্স নীতি’ গ্রহণ করেছে সিপিসি। প্রেসিডেন্ট সি প্রায়ই বলেন: সিপিসি ধ্বংস করার ক্ষমতা বাইরের কোনো শক্তির নেই; সিপিসি ধ্বংস হতে পারে দলের নেতা-কর্মীদের লোভ-দুর্নীতির কারণে।

পাঁচ. রাজনৈতিক দলকে ভুল থেকে শিক্ষা নেওয়ার ও তা স্বীকার করার মানসিকতা ধারণ করতে হবে। যারা কাজ করে, তারাই ভুল করে। দেশ চালাতে গেলে রাজনৈতিক দলের ভুল-ত্রুটি হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে যেন একই ভুলের পুনরাবৃত্তি না-ঘটে। দলের কোনো নীতি ব্যর্থ হলে, তার পরিবর্তে নতুন নীতি গ্রহণের মাধ্যমে তা বাস্তবায়ন করতে হবে। আর অতীতের ভুল-ত্রুটির চর্চায় মেতে থাকা বা অতীতের ভুলের জন্য দায়ীদের চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করার মানসিকতা ত্যাগ করতে হবে। অতীত নিয়ে পড়ে থাকলে চলবে না, অতীতের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে সামনের দিকে এগুতে হবে।

ছয়. রাজনৈতিক দলের উচিত নয় আত্মতৃপ্তিতে ভোগা। লক্ষ্য বড় না-হলে সামনে এগুনো যায় না। সিপিসি মাত্র ৪ দশকে ৮০ কোটি মানুষকে দারিদ্র্যমুক্ত করেছে; দেশের অধিকাংশ মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করেছে; নবম শ্রেণি পর্যন্ত বাধ্যতামূলক বিনামূল্যের শিক্ষা নিশ্চিত করেছে; জ্ঞান-বিজ্ঞানের জগতে দেশকে অনেকদূর এগিয়ে নিয়ে গেছে। কিন্তু দলটি এ নিয়ে আত্মতৃপ্তিতে ভোগার মানসিকতা রাখে না। দলের নেতা-কর্মীরা বরং অর্জিত সাফল্যকে ধরে রাখার পাশাপাশি, তাকে আরও উন্নত করার জন্য অবিরাম পরিশ্রম করে যাওয়ার নীতিতে বিশ্বাসী। পৃথিবীতে সম্ভবত সিপিসি একমাত্র রাজনৈতিক দল, যার লক্ষ্য দেশের সকল মানুষকে ধনী তথা সচ্ছল বানানো। নয়াচীন প্রতিষ্ঠার শততম বার্ষিকী পালন করতে চায় দলটি এ লক্ষ্য অর্জনের মাধ্যমে।

সাত. রাজনৈতিক দলকে অসুবিধাকে সুবিধায় পরিণত করার কৌশল শিখতে হবে; দেশ ও দশের উন্নয়নের স্বার্থে যে-কোনো বাধা অতিক্রম করার সাহস ও ইচ্ছা রাখতে হবে। আজকের চীনকে বর্তমান অবস্থানে আনতে সিপিসি-কে ভিতরে ও বাইরের অনেক বাধা অতিক্রম করতে হয়েছে। বিদেশি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে দলটিকে সশস্র যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে হয়েছে; দেশের ভিতরের কায়েমী স্বার্থবাদীদের বিরুদ্ধে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে হয়েছে; ক্ষুধা, অশিক্ষা-কুশিক্ষা, পশ্চাত্পদতার বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয়েছে। যখন যেখানে বাধার সম্মুখীন হয়েছে, তখন সেখান থেকেই জনগণকে নিয়ে নতুন উদ্যোমে পথ চলেছে সিপিসি। ১৯৭৮ সালে সংস্কার ও উন্মুক্তকরণ নীতি গ্রহণের পর চীন লাফিয়ে লাফিয়ে উন্নতি করেছে। অধিকাংশ মানুষ সেটাই জানে। কিন্তু এই অর্জনের পথে দেশটিকে যে কতো কঠিন পথ অতিক্রম করতে হয়েছে, তা বিশেষ একটা আলোচনায় আসে না। ১৯৯৭ সালে এশিয়ার আর্থিক সংকট, ১৯৯৮ সালের মারাত্মক বন্যা, ২০০৩ সালের সার্স মহামারী, ও ২০০৮ সালের বৈশ্বিক আর্থিক মন্দার নেতিবাচক প্রভাব সামাল দিতে হয়েছে সিপিসি-কে। সর্বশেষ সিপিসি’র নেতৃত্বে চীনা সরকার মোকাবিলা করেছে কোভিড-১৯ মহামারীকে। সবার আগে মহামারীর শিকার হয়ে, সবার আগে ও সবচেয়ে কম ক্ষয়ক্ষতির বিনিময়ে, মহামারী নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয় চীন। এ সাফল্যও সিপিসি অর্জন করেছে জনগণকে সাথে নিয়েই।

চীনের অগ্রগতির পথে বাধার প্রাচীর গড়ে তোলা পশ্চিমা শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয়েছে দলটিকে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সিপিসিকে সাহায্য করার পরিবর্তে বাধাই দিয়েছে পশ্চিমা শক্তি। কিন্তু যেখানেই সিপিসি বাধা পেয়েছে, সেখানে নতুন পথ খুঁজে নিয়েছে; অসুবিধাকে পরিণত করেছে সুবিধায়। ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বাইরের সহায়তা খুব কমই পেয়েছে চীন, বরং বাধাই পেয়েছে। তখন তাকে খুঁজে নিতে হয়েছে নিজস্ব পথ। জ্ঞান-বিজ্ঞানের জগতে চলতে গিয়েও বাইরের সাহায্য পায়নি সিপিসি। এই যে আজ জ্ঞান-বিজ্ঞানের জগতে চীনের অবাধ পদচারণা, তা কোনোদিনও সম্ভব হতো না, যদি চীনের সরকার বাইরের মুখাপেক্ষী হয়ে বসে থাকতো। উন্নত বিশ্বের কাছে প্রযুক্তি চেয়ে না-পেয়ে, চীন নিজেই উদ্ভাবন করেছে নতুন নতুন প্রযুক্তি। এ কথা বলতে গেলে জ্ঞান-বিজ্ঞানের সব শাখার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। নিজের কৃত্রিম উপগ্রহ তৈরির সময় ইউরোপের কাছে উপগ্রহে ব্যবহার-উপযোগী বিশেষ ঘড়ির প্রযুক্তি চেয়েছিল চীনের সরকার; ইউরোপ তা দেয়নি। তখন, চীন নিজেই উপগ্রহ-ঘড়ি তৈরি করেছে। ১৬টি দেশের যৌথ উদ্যোগে নির্মিত আন্তর্জাতিক মহাকাশকেন্দ্র প্রকল্পে যোগ দিতে চেয়েছিল চীন। যুক্তরাষ্ট্র তাতে বাধা দেয়। তখন বাধ্য হয়ে চীন তার নিজস্ব মহাকাশকেন্দ্র গড়ে তোলে একাই! হাল আমলে এসে চীনের ফাইভ-জি প্রযুক্তির বিরুদ্ধে লেগেছে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেনকে বাধ্য করেছে হুয়াওয়েইর সঙ্গে চুক্তি বাতিল করতে। কিন্তু থেমে নেই চীনাদের অগ্রযাত্রা; এক পথ রুদ্ধ হলে সিপিসি’র নেতৃত্বে চীনার ঠিকই খুঁজে নিচ্ছে বিকল্প পথ।

আট. রাজনৈতিক দলগুলোর বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়নের আগ্রহ ও সামর্থ্য অর্জন করতে হবে। সিপিসি এ পর্যন্ত ১৩টি পাঁচসালা পরিকল্পনা গ্রহণ করে তা শতভাগ সফলতার সঙ্গে বাস্তবায়ন করেছে। এখন চলছে চতুদর্শ পাঁচসালা পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাজ। চীনের উন্নয়নে এই পরিকল্পনাগুলোর ভূমিকা অনস্বীকার্য। পরিকল্পনা গ্রহণের ক্ষেত্রে সিপিসি সবসময় বাস্তববাদী মনোভাবের পরিচয় দিয়ে আসছে। উচ্চাভিলাষী অথচ বাস্তাবায়ন অযোগ্য পরিকল্পনা গ্রহণ করা থেকে সিপিসি বরাবরই বিরত থেকেছে। তাই বিদেশি পন্ডিতরা এখন বলতে দ্বিধা করেন না যে, চীন কোনো পরিকল্পনা গ্রহণ করলে তা বাস্তবায়ন করে ছাড়ে। এই যে চীনের সরকার ‘কার্বন নিরপেক্ষতা’ অর্জনের কঠিন লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে, দেশের সকল মানুষকে সচ্ছল করার দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে, তা বাস্তবায়িত হবে বলে তারা বিশ্বাস করেন। অনেকেই জানেন, চীনের এখন নিজস্ব জিপিএস সিস্টেম আছে; ৩০টি কৃত্রিম উপগ্রহ নিয়ে গঠিত এই সিস্টেম—যা পেইতৌ-৩ নামে পরিচিত—বিশ্বব্যাপী সেবা দিচ্ছে। কিন্তু চীন সরকার এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে তিনটি ধাপে, দীর্ঘ সময় নিয়ে। কারণ, শুরুর দিকে চীনের হাতে অর্থ ও প্রযুক্তির অভাব ছিল।

নয়. রাজনৈতিক দলগুলোকে দেশ ও দশের স্বার্থে পরামর্শের ভিত্তিতে কাজ করতে হবে। চীনে সিপিসি দেশের বাকি আটটি গণতান্ত্রিক দলের সঙ্গে পরামর্শের ভিত্তিতে কাজ করে থাকে। এটা এখন স্পষ্ট যে, চীনের রাজনৈতিক ব্যবস্থা কার্যকর। কিন্তু এর মানে এই নয় যে, গণতান্ত্রিক দেশগুলোকে চীনের রাজনৈতিক মডেল সরাসরি অনুসরণ করতে হবে। দেশ ও দশের স্বার্থে, পরামর্শের ভিত্তিতে কাজ করার নীতিটা অনুসরণ করলেই চলবে। তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশেই আমরা দেখি, একটি দল নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসে পূর্বের দলের নেওয়া প্রায় সকল প্রকল্প বাতিল করে দিয়ে নতুন করে শুরু করে। এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি কখনও সফলতা আনতে পারে না। গণতান্ত্রিক দেশগুলোর রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পরামর্শব্যবস্থা থাকার প্রয়োজন এখানেই।

রাজনৈতিক দলগুলোকে জনমতকে, জনগণের পরামর্শকেও গুরুত্ব দিতে হবে। চীনে কোনো আইন পাস করার আগে খসড়া আইন জনমতের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে দেশে প্রায় ৯০ হাজার ওয়েবসাইট আছে, যেখানে নাগরিকরা খসড়া প্রস্তাব সম্পর্কে মতামত বা পরামর্শ দিতে পারেন। পাশাপাশি, রাজনৈতিক দলের উচিত দেশের সিভিল সোসাইটির সাহায্য নেওয়া। অনেকেই জেনে অবাক হবেন যে, চীনে ৭ লক্ষাধিক সামাজিক সংগঠন আছে, যারা দেশগঠনে, দেশ পরিচালনায় সিপিসি-কে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সাহায্য করে আসছে।

দশ. রাজনৈতিক দলগুলোকে নিজ নিজ দেশের সমস্যা সমাধানের পাশাপাশি, অভিন্ন বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায়ও সামর্থ্য অনুযায়ী ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে হবে। আজকের পৃথিবী হচ্ছে একটি ‘বৈশ্বিক গ্রাম’। এই ‘গ্রামের’ সবাই সবার কাজে ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় প্রভাবিত হয় বা হতে বাধ্য। এখানে দ্বন্দ্ব নয়, সহযোগিতাই হচ্ছে সবার জন্য কল্যাণকর। বিশেষ করে, সন্ত্রাসবাদ, যুদ্ধ-বিগ্রহ, মহামারী, ইত্যাদি বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সংলাপ ও সহযোগিতাই হতে পারে একমাত্র পথ। রাজনৈতিক দলগুলোকে এই সত্য উপলব্ধি করতে হবে।

সিপিসি বৈশ্বিক সহযোগিতার ধারণা বিশ্বাস করে; সিপিসি বিশ্বাস করে যে, আধুনিক বিশ্বে একা একা বেশিদূর এগোনো যায় না, যাবে না। বিশেষ করে, উন্নত হতে হলে সবাইকে নিয়েই সামনে এগুতে হবে। এ কারণেই প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং ‘এক অঞ্চল, এক পথ’ উদ্যোগ প্রস্তাব করেছেন। এখন পর্যন্ত বিশ্বের ১৪০টির বেশি দেশ ও অঞ্চল এ উদ্যোগে সামিল হয়েছে, যাদের মধ্যে ইউরোপের উন্নত দেশও রয়েছে। তা ছাড়া, এশিয়ার উন্নয়নশীল দেশগুলোর অবকাঠামো উন্নয়নের সুবিধার্থে, চীনের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এশীয় অবকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংক। কোভিড-১৯ মহামারী মোকাবিলায় বিশ্বের সকল দেশের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে চীন; সবার আগে কোভিডের টিকাকে বিশ্বের ‘গণপণ্য’ ঘোষণা করেছেন সিপিসি’র সাধারণ সম্পাদক সি চিন পিং। এ সবই সিপিসি’র বিশ্বমুখী চেতনারই বহিঃপ্রকাশ। এ চেতনা দ্বারা বিশ্বের সকল রাজনৈতিক দল উজ্জীবিত হতে পারে।

চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং বলেছেন, সিপিসি দারিদ্র্যবিমোচনসহ বিভিন্ন খাতে অর্জিত চীনা সাফল্যের অভিজ্ঞতা বিশ্বের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে শেয়ার করতে আগ্রহী। তিনি গত ৬ জুলাই বিশ্বের ১৬০টি দেশের পাঁচ শতাধিক রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে এক ভিডিও-সম্মেলনে এ কথা বলেন। যুক্তরাষ্ট্রের কর্নেল ইউনিভার্সিটির দুই স্কলার থমাস পেপিন্সস্কি ও জেসিকা ছেন গত জুনে মার্কিন ম্যাগাজিন ‘ফরেন অ্যাফেয়ার্স’-এ প্রকাশিত এক নিবন্ধে লিখেছিলেন, গত দুই দশকে সিপিসি বিশ্বের ১৬০টি দেশের ৪ শতাধিক রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলেছে এবং বিভিন্ন দেশের ক্ষমতাসীন দলগুলো দেশ-প্রশাসনে সিপিসি’র পরামর্শ চাইছে। বলা বাহুল্য, সিপিসি’র অভিজ্ঞতা থেকে যেমন বিদেশি রাজনৈতিক দলগুলো অনেককিছু শিখতে পারে, তেমনি সরাসরি সিপিসি’র কাছ থেকে পরামর্শও নিতে পারে। সিপিসি সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রের চর্চা করে। কিন্তু দলটির লক্ষ্য জনগণের কল্যাণ। যেসব বিদেশি রাজনৈতিক দল জনগণের কল্যাণে নিবেদিত, সিপিসি’র পরামর্শ তাদের কাজে লাগবার কথা।

লেখক : বার্তা সম্পাদক, চায়না মিডিয়া গ্রুপ (সিএমজি)alimulh@yahoo.com

এইচআর/এমএস