জাতীয়

‘২১ ঘণ্টায়ও কেন আগুন নিয়ন্ত্রণে এলো না?’

নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে সজীব গ্রুপের হাসেম ফুড লিমিটেড কারখানায় বৃহস্পতিবার (৮ জুলাই) বিকেলে যে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে, তা ২১ ঘণ্টায়ও কেন নিয়ন্ত্রণে এলো না, সে প্রশ্ন উঠেছে। এই অগ্নিকাণ্ডে এখন পর্যন্ত ৫২ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে বৃহস্পতিবার তিনজনের মৃত্যু হলেও শুক্রবার (৯ জুলাই) কারখানার পোড়া ধ্বংসস্তূপ থেকে ৪৯ জনের মরদেহ উদ্ধারের তথ্য জানায় ফায়ার সার্ভিস।

Advertisement

নিহতদের স্বজন ও বেঁচে যাওয়া শ্রমিকরা বলছেন, কারখানা কর্তৃপক্ষের অবহেলায় প্রাণঘাতী এ অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। তাছাড়া কারখানায় আগুন লাগার পরও কর্তৃপক্ষ কলাপসিবল গেটের তালা না খোলায় শ্রমিকরা বের হতে পারেননি। লাগানো ছিল ছাদের গেটের তালাও। ফায়ার সার্ভিস অগ্নিকাণ্ডের পরই ঘটনাস্থলে ছুটে গেলেও ২১ ঘণ্টায় (দুপুর ২টা পর্যন্ত) এ আগুন নেভাতে পারেনি, তাদের ব্যর্থতাও হতাহতের সংখ্যা বাড়িয়েছে।

শ্রমিকরা অভিযোগ করে বলেন, হাসেম ফুড লিমিটেড কারখানার যে ভবনটিতে আগুন লেগেছে সে ভবন বিল্ডিং কোড না মেনে নির্মিত হয়েছে। অব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কারখানাটি পরিচালনা করায় এ অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়েছে। খাদ্য তৈরি প্রতিষ্ঠানটিতে মাত্রাতিরিক্ত কেমিক্যাল ব্যবহারও অগ্নিকাণ্ডের ভয়াবহতার জন্য দায়ী।

শুক্রবার দুপুরে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স নারায়ণগঞ্জ অফিসের উপ-সহকারী পরিচালক আব্দুল্লাহ আল আরেফীন ঘটনাস্থলে সাংবাদিকদের বলেন, ‘পাঁচ অ্যাম্বুলেন্সে করে আমরা ৪৯ জনের মরদেহ ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে পাঠিয়েছি, ময়নাতদন্তের জন্য।’

Advertisement

বৃহস্পতিবার বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে ছয়তলা ওই কারখানা ভবনের নিচতলায় আগুন লাগে। মুহূর্তেই আগুন ভবনের অন্যান্য তলায় ছড়িয়ে পড়ে। আতঙ্কে শ্রমিকরা ভবনের ছাদে জড়ো হন। ছাদসহ বিভিন্ন তলা থেকে লাফিয়ে পড়েন অনেকে। এতে ওই রাতেই তিনজনের মৃত্যুর খবর জানানো হয়, আহতও হন বেশ কিছু শ্রমিক।

ভবনের চতুর্থ তলায় ললিপপ, তরল চকলেট, তৃতীয় তলায় অরগানিক পানীয় (জুস, লাচ্ছি), দোতলায় টোস্ট বিস্কুট, বিভিন্ন ধরনের পানীয় এবং নিচতলায় বাক্স ও পলিথিন তৈরির কারখানা ছিল। পঞ্চমতলার একপাশে সেমাই, সেমাই ভাজার তেল, পলিথিন; অপর পাশে কারখানার গুদাম ছিল। কারখানার ষষ্ঠতলায় ছিল কার্টনের গুদাম। টানা আগুন জ্বলতে থাকায় ভবনটিতে ফাটলও দেখা দেয়।

ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা জানান, আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার পর ছয়তলা ভবনের চতুর্থতলা পর্যন্ত প্রবেশ করা গেছে। সেখান থেকেই এতোগুলো মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। ছয়তলা কারখানা ভবনের ওপরের দুই ফ্লোরে এখনো আগুন জ্বলছে। সেজন্য নেভানোর কাজ চলছে এখনো। ধ্বংসস্তূপে তল্লাশিও এখনো শেষ হয়নি।

আবদুল্লাহ আল আরেফীন বলেন, কারখানাটির ভেতরে বিভিন্ন রাসায়নিকসহ দাহ্যপদার্থ মজুত থাকায় আগুন নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খেতে হয়েছে। ভবনটিতে ফাটল ধরায় আরও সতর্কতার সঙ্গে কাজ করতে হয়েছে।

Advertisement

মো. আবদুল জলিল ও মো. আবু সামাদ নামের দুজন শ্রমিক জানিয়েছেন, আগুনে পুড়ে যাওয়া ভবনটিতে ১০০০-১২০০ শ্রমিক কাজ করতেন।

ডেমরা ফায়ার সার্ভিসের সিনিয়র স্টেশন অফিসার মো. ওসমান গনি বলেন, ডেমরা ফায়ার সার্ভিস অগ্নিকাণ্ডের শুরু থেকেই নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। সঙ্গে আরও ১৭টি ইউনিট কাজ করছে পর্যায়ক্রমে। কিন্তু কারখানার ছয়তলা এ ভবনে পরিস্থিতি একটু জটিল মনে হচ্ছে। চেষ্টা চলছে আগুন নিয়ন্ত্রণ ও নির্বাপণ করার।

পুলিশের সঙ্গে শ্রমিকদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়াএদিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে না আসায় এবং কারখানায় হতাহতের খবরে ক্ষুব্ধ হয়ে স্থানীয় শ্রমিকরা শুক্রবার বেলা ১১টা থেকে পুলিশের সঙ্গে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ায় জড়ান। এতে স্থানীয় এলাকাবাসীও যোগ দেয়। এ সময় বিক্ষোভকারীরা ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে যান চলাচল বন্ধ করে দেন।

হামলা-মারধরের শিকার সাংবাদিকরাশ্রমিকদের বিক্ষোভের সময় আনসার-পুলিশের পাশাপাশি সাংবাদিকরাও হামলার শিকার হয়েছেন। এ ঘটনায় সংবাদ সংগ্রহে আসা কয়েকজন সাংবাদিক মারধরেরও শিকার হন। এ সময় তাদের মোটরসাইকেল ভাঙচুরসহ হেলমেটও ছিনিয়ে নেন কিছু বিক্ষোভকারী।

উত্তেজিত শ্রমিকরা এশিয়ান টেলিভিশনের নারারয়ণগঞ্জ জেলা প্রতিনিধি মো. হাবিবুর রহমানের মোটরসাইকেল ভাঙচুর করে তাকে মারধর করেন। পাশাপাশি যমুনা টেলিভিশনের ক্যামেরাপারসন স্বপন তালুকদারের ওপরও চড়াও হন তারা। এ সময় নিউজটোয়েন্টিফোর টেলিভিশনের রূপগঞ্জ উপজেলার ক্যামেরাপারসন তুষারের মোটরসাইকেল ভাঙচুর করে বিকল করে দেয়া হয়। তাকে মারধরও করা হয়। পাশাপাশি মাহমুদ-বিপ্লবসহ কয়েকজন সংবাদকর্মীও হামলার শিকার হন। তবে যান চলাচল বন্ধের এক ঘণ্টা পরে চলাচল কিছুটা স্বাভাবিক হলেও পরিস্থিতি থমথমে রয়েছে। এলাকায় বিরাজ করছে চরম উত্তেজনা।

নিহতদের স্বজনকে ২৫ হাজার, আহতদের ১০ হাজার টাকা সহায়তাএদিকে শুক্রবার সকালেই ঘটনাস্থল পরিদর্শনে আসেন নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক মোস্তাইন বিল্লাহ, ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি হাবিবুর রহমান, নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) মো. জায়েদুল আলম, রূপগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) শাহ নুসরাত জাহান প্রমুখ।

জেলা প্রশাসক মোস্তাইন বিল্লাহ শ্রমিকদের সান্ত্বনা দিয়ে বলেন, এ অগ্নিকাণ্ডে নিহত প্রত্যেক শ্রমিকের পরিবারকে ২৫ হাজার টাকা এবং আহতদের ১০ হাজার টাকা করে সহায়তা দেয়া হবে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে এ ঘটনায় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রয়োজনে আরও সহযোগিতামূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে।

৫ সদস্যের তদন্ত কমিটিঅন্যদিকে এই ঘটনার তদন্তে পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করেছে জেলা প্রশাসন। এ বিষয়ে রূপগঞ্জের ইউএনও শাহ নুসরাত জাহান জানান, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শামীম ব্যাপারীকে আহ্বায়ক করে পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।

কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন রূপগঞ্জের ইউএনও, ফায়ার সার্ভিসের উপ-সহকারী পরিচালক, পুলিশের একজন প্রতিনিধি এবং কলকারখানা অধিদফতরের একজন প্রতিনিধি।

এইচএ/এমএস