কৃষি ও প্রকৃতি

করোনা মোকাবিলায় পতিত জলাশয় হতে পারে অর্থনৈতিক হাতিয়ার

প্রকৌ. মো. আলীমুজ্জামান চৌধুরী

Advertisement

বৈশ্বিক করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় দেশে পুষ্টিমানসম্পন্ন খাদ্য উৎপাদন এবং প্রান্তিক পর্যায়ে ব্যাপকভিত্তিক কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য বর্তমান সরকারের মূল নির্দেশনা হলো ‘দেশের প্রতি ইঞ্চি জমি পতিত না রেখে উৎপাদনশীল কাজে লাগাতে হবে’। এই নির্দেশনা বাস্তবায়নের অংশ হিসাবে মৎস্য অধিদফতরাধীন চলমান ‘জলাশয় সংস্কারের মাধ্যমে মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধি শীর্ষক’ প্রকল্পটি অক্টোবর, ২০১৫-জুন, ২০২২ মেয়াদে বাস্তবায়িত হচ্ছে।

প্রকল্পের নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সারাদেশের ৬১টি জেলার ৩৪৯টি উপজেলায় প্রায় ২,৬০০.০ হেক্টর আয়তনের পতিত বা অব্যবহৃত ভরাট হয়ে যাওয়া বিভিন্ন শ্রেণির জলাশয় (পুকুর/দিঘি/মরানদী/বরোপিট/বিল/হাওড় ইত্যাদি) পুনঃখননের মাধ্যমে মৎস্যচাষ উপযোগী সংস্কার করে স্থানীয় প্রান্তিক জনগোষ্ঠিকে সম্পৃক্ত করার মাধ্যমে প্রযুক্তিনির্ভর মাছ চাষের আওতায় আনা।

বিবেচ্য প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য দুটি, তা হলো ১. বছরে মোট ১০,২৩৪.০০ মেট্রিক টন অতিরিক্ত মাছ উৎপাদন (প্রায় ৪.০ মেট্রিকটন/হেক্টর/বছর) এবং ২. মোট ১৮,২০০ জন প্রান্তিক মানুষের প্রত্যক্ষ কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি (৭-১০ জন/হেক্টর)।

Advertisement

এছাড়াও সম্পদের সুষ্ঠ ব্যবহার নিশ্চিতকরন, সরকারি খাস জলাশয়ে প্রান্তিক মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা, সরকারের রাজস্ব আয় বৃদ্ধি, পরিবেশ ও জীব বৈচিত্র সংরক্ষণ, ভূ-পৃষ্ঠস্থ পানি ব্যবহারের মাধ্যমে কৃষিতে সেচ সুবিধা সম্প্রসারণসহ অনেক লক্ষ্য পূরণের জন্য প্রকল্পটি গৃহীত। উন্নয়নকৃত জলাশয়ের পাড়/ডাইকগুলোতে শাক-সবজি, নেপিয়ার ঘাস ও ফলদবৃক্ষ রোপণের মাধ্যমে বিকল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে।

প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী বিগত জুন/২০২০ পর্যন্ত প্রায় ১,৩০০ হেক্টর জলাশয় পুনঃখনন কাজ সম্পন্ন হয়েছে এবং সংস্কারকৃত উক্ত জলাশয় হতে বর্তমানে বাৎসরিক প্রায় ৬,৫০০.০ মেট্রিকটন অতিরিক্ত মাছ উৎপাদনসহ (৫.০ মেট্রিকটন/হেক্টর/বছর) এবং প্রায় ৯,১০০ জন প্রান্তিক মানুষের প্রত্যক্ষ কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে (৭ জন/হেক্টর)। এছাড়াও পরোক্ষভাবে আরো দ্বিগুণেরও বেশি পরিমাণ মানুষ আর্থিকভাবে উপকৃত হচ্ছে।

ইতিমধ্যেই চলমান জলাশয় সংস্কার প্রকল্পটি করোনার প্রভাব মোকাবেলায় প্রধান লক্ষ্য পূরণে দেশে অতিরিক্ত মৎস্য উৎপাদন এবং গ্রামীণ পর্যায়ে ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক প্রভাব ফেলেছে। এ কারণে বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকার গুরুত্ব অনুধাবন করে করোনা মহামারি মোকাবেলার অংশ হিসাবে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের বিশেষ নির্দেশনায় এবং মৎস্য অধিদফতরের নিবিড় তত্ত্বাবধানে জলাশয় সংস্কার প্রকল্পের অর্থায়নে বর্তমান ২০২০-২০২১ অর্থবছরে প্রায় ১,১০০.০ হেক্টর জলাশয় পুনঃখনন করে গঠিত সুফলভোগী প্রান্তিক জনগোষ্ঠির মাধ্যমে মৎস্য চাষের আওতায় আনার কাজ হাতে নেয়া হয়েছে।

প্রকল্পের মূল লক্ষ্যকে সামনে রেখে (কর্মসংস্থান সৃষ্টি- প্রতি হেক্টরে ৭-১০ জন ও অতিরিক্ত মৎস্য উৎপাদন- ৪ মেট্রিকটন/হেক্টর/বছর) ইতিমধ্যে নির্বাচিত ভরাট হয়ে যাওয়া বিভিন্ন শ্রেণির পতিত জলাশয় পুনঃখনন কাজ মাঠ পর্যায়ে প্রায় সমাপ্ত অবস্থায় আছে। দেশের ভয়াবহ করোনা মহামারিকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করে এ ব্যাপক জলাশয় পুনঃখনন কার্যক্রম বাস্তবায়নে মাঠপর্যায়ে দায়িত্বে নিয়োজিত আছেন সংশ্লিষ্ট জেলা মৎস্য কর্মকর্তা, সিনিয়র উপজেলা/উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা, বিভাগীয় সহকারী প্রকৌশলী, জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রকৌশলীগণ।

Advertisement

পুনঃখনন কাজে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করণে নিবিড় মনিটরিং কাজে নিয়োজিত আছেন ৮ বিভাগের সুযোগ্য উপপরিচালক মহোদয়গণ। এছাড়াও কেন্দ্রীয়ভাবে মৎস্য অধিদফতর এবং প্রশাসনিক মন্ত্রণালয়ের বিশেষ টিম চলমান পুনঃখনন কার্যক্রম পরিদর্শন করছেন। সর্বপরি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক নির্দেশিত প্রতিটি পুনঃখনন কাজের স্বাক্ষী সংরক্ষণ, অনুমোদিত চূড়ান্ত পরিমাপ কমিটি কর্তৃক সম্পাদিত কাজের হিসাব নিরুপন এবং গঠিত সুফলভোগী গ্রুপের নিকট পুনঃখননকৃত জলায়শটি মাছ চাষের উদ্দেশ্যে হস্তান্তর কার্যক্রম জলাশয় পুনঃখনন কাজ শতভাগ স্বার্থকভাবে সম্পন্ন হয়েছে।

এখানে বিশেষ করে উল্লেখ করা প্রয়োজন বিবেচ্য প্রকল্পভুক্ত প্রায় সকল পুনঃখনন উপযোগী জলাশয়ের মালিকানা ভুমি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসক বা উপজেলা নির্বাহী অফিসার মহোদয়গণ এবং বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (বাপাউবো), সঙ্গত কারণেই পুনঃখননের জন্য তাদের অনাপত্তি পত্রের প্রয়োজন হয়। মৎস্য অধিদফতরের এ ব্যাপক পুনঃখনন কার্যক্রমে করোনা মোকাবেলার অংশীদার হিসেবে জেলা ও উপজেলা প্রশাসন এবং বাপাউবো এর সহায়তা ছিল অত্যন্ত আন্তরিক।

সকলের আন্তরিক প্রচেষ্টায় সংস্কারকৃত জলাশয়গুলোর উৎপাদনশীলতা প্রায় ৮ গুণ বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে ইজারা মূল্য কয়েক গুণ বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে সরকারের রাজস্ব আয় পূর্বের তুলনায় অনেক বেড়েছে, জনসাধারণের চলাচলের রাস্তা তৈরি হয়েছে, পরিবেশের উন্নয়ন হয়েছে, প্রভাবশালীদের মাধ্যমে বেহাত হওয়া সরকারি সম্পদ পুনরুদ্ধার হয়েছে, সম্পদেও সুষ্ঠ ব্যবহার নিশ্চিত হয়েছে, সর্বপরি প্রান্তিক জনগোষ্ঠির অধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তাদের কর্মসংস্থানসহ আর্থ-সামাজিক অবস্থার ব্যাপক উন্নয়ন ঘটেছে।

সরকারের অগ্রাধিকার প্রাপ্ত জলাশয় সংস্কার প্রকল্পের মাধ্যমে বর্তমান ২০২০-২১ অর্থবছর ব্যাপকভিত্তিক জলাশয় পুনঃখনন কার্যক্রম বাস্তবায়নের ফলে প্রকল্পের ক্রমপুঞ্জিত অগ্রগতি ৯০% এর অধিক হবে বলে আশা করা যায়। ফলে উন্নয়নকৃত জলাশয় হতে বছরে প্রায় ৯,৬০০.০ মেট্রিকটন অতিরিক্ত মাছ উৎপাদনসহ ১৬,৮০০ জন গ্রামীণ মানুষের সরাসরি স্থায়ী কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে।

লক্ষ্যণীয় বিষয়, সাম্প্রতিক করোনা মহামারি প্রাদুর্ভাবে শহরকেন্দ্রিক ব্যাপক সংখ্যক মানুষ কর্মহীন হয়ে নিজ গ্রামে স্থানান্তর হয়েছে। সেপ্রেক্ষিতে ঐসকল বেকার স্থানান্তরিত মানুষের জন্য জলাশয় পুনঃখনন কার্যক্রম তাৎক্ষণিকভাবে অস্থায়ী ভিত্তিতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে (১,১০০.০ হেক্টর জলাশয় পুনঃখননে ১.১০ কোটি ঘন মিটার মাটি উত্তোলিত হয়েছে)। বর্তমানে দেশে গ্রামীণ অর্থনীতি সচল থাকার জন্য সরকারের গৃহীত অন্যান্য পদক্ষেপের সাথে মৎস্য অধিদফতরের জলাশয় সংস্কার প্রকল্পের পুনঃখনন কার্যক্রম ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে।

প্রকল্পটির আরো কয়েকটি সফল দিক হলো গঠিত সুফলভোগী গ্রুপের সদস্যদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য উপযুক্ত প্রশিক্ষণ প্রদান এবং উদ্ভুদ্ধকরণ কর্মসূচির আওতায় সংস্কারকৃত জলাশয়ে প্রদর্শনী মৎস্য খামার স্থাপন। মৎস্য চাষের আধুনিক কলাকৌশলের উপর প্রশিক্ষণ প্রদান ও প্রদর্শনী স্থাপনের মাধ্যমে ফলাফল প্রদর্শন উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রাকে অতিক্রম করতে সাহায্য করেছে (৫.০ মেট্রিকটনটন/হেক্টর/বছরের বেশি হয়েছে)।

প্রকল্পের মধ্যবর্তী মূল্যায়ন প্রতিবেদনে গৃহীত কার্যক্রমের উপর অনেক ইতিবাচক বিষয় তুলে ধরা হয়েছে এবং দেশব্যাপী বৃহত্তর পরিসরে চাহিদার প্রেক্ষিতে অতিরিক্ত মৎস্য উৎপাদন ও গ্রামীণ পর্যায়ে কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে ভরাট জলাশয় পুনঃখননের মাধ্যমে মৎস্য চাষের আওতায় আনার সুপারিশ করা হয়েছে।

সম্প্রতি পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের আইএমইডি কর্তৃক নিবিড় পরিবীক্ষণ সমীক্ষা প্রতিবেদনে সংস্কারকৃত জলাশয়ে মাছের উৎপাদন ৪.০-৬.০ মেট্রিকটন/হেক্টর/বছর এবং ১৫,০০০-২০,০০০ জনমানুষের সরাসরি গ্রামীণ কর্মসংস্থান সৃষ্টিসহ সমপরিমাণ মানুষের পরোক্ষ কর্মসংস্থানের ফলে তাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন হবে বলে মতামত ব্যক্ত করা হয়েছে।

লেখক: তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌ. ও প্রকল্প পরিচালক, জলাশয় সংস্কারের মাধ্যমে মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধি প্রকল্প, মৎস্য অধিদপ্তর, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়।

এমএমএফ/এমএস