প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস সারা বিশ্বে এখন এক আতঙ্কের নাম। বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশেই হানা দিয়েছে এ ভাইরাস। এর সংক্রমণ থামাতে প্রায় সব দেশই কোনো না কোনোভাবে লকডাউনের পথে হাঁটলেও পরিকল্পিতভাবে এর তান্ডব থামাতে পেরেছে খুব কম দেশই।
Advertisement
মালয়েশিয়ায় করোনাভাইরাস শনাক্ত হয় গত বছরের ১৮ মার্চ। এরপর থেকে দেশটিতে সংক্রমণরোধে ঘোষণা করা হয় লকডাউন, কঠোর লকডাউন। অদ্যাবধি সংক্রমণ ঠেকাতে উওরণের পথে হাটঁছে দেশটি। অতি জরুরি কোনো কাজ ছাড়া মানুষ ঘরের বাইরে বের হতে পারছেন না। এই পরিস্থিতিতে কারও সাহায্যের কোনো প্রয়োজন হলে নিজ বাড়ির বাইরে সাদা পতাকা উড়াচ্ছেন দেশটির মানুষ।
আর এতেই বাড়িতে পৌঁছে যাচ্ছে খাবারসহ নিত্য-প্রয়োজনীয় সামগ্রী। মহামারি ও লকডাউন পরিস্থিতিতে বিপর্যস্ত স্বল্প আয়ের পরিবারগুলোর সাহায্য প্রার্থনার প্রতীক হিসেবে বেনদেরাপুতিহ বা সাদা পতাকা প্রদর্শনের একটি ক্যাম্পেইন গত সপ্তাহে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মালয়েশিয়ার মানুষের মধ্যে জনপ্রিয়তা পায়।
এর জবাবে প্রতিবেশি, বিভিন্ন সেক্টরের তারকা ব্যক্তিত্ব এবং বহু ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খাবার ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য নিয়ে এইসব অভাবী পরিবারের পাশে দাঁড়াতে শুরু করে।
Advertisement
গত মে মাস থেকে মালয়েশিয়ায় করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। এরপর সংক্রমণে লাগাম টানতে গত জুন মাসের ১ তারিখ থেকে দেশজুড়ে লকডাউন জারি করা হয়। এরপর থেকে এখনও লকডাউন ও করোনা বিধিনিষেধের মধ্যেই বাস করছে দেশটির বাসিন্দারা।
দীর্ঘসময় ধরে লকডাউন জারি থাকার কারণে দেশটির দরিদ্র মানুষের এক বেলা খবার খেয়ে দিন পার করার মতো বিভিন্ন সংবাদ গণমাধ্যমগুলোতে এসেছে। এছাড়া টনা দেড় বছরের বেশি সময় ধরে চলমান করোনা মহামারির কারণে দেশটিতে বেড়েছে আত্মহত্যার সংখ্যাও।
মালয়েশিয়ার পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসেই দেশটিতে ৪৬৮ জন আত্মহত্যা করেছেন। পুরো ২০২০ সাল জুড়ে এই সংখ্যাটি ছিল ৬৩১ জন এবং ২০১৯ সালে ছিল ৬০৯ জন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেনদেরাপুতিহ বা সাদা পতাকা গ্রুপ খোলা হয়েছে, যেখানে সাহায্য দরকার এমন পরিবারের ঠিকানা ও ছবি পোস্ট করা হয়ে থাকে। অনেকে আবার পার্শ্ববর্তী ‘ফুড ব্যাংক’র ছবিও পোস্ট করেন।
Advertisement
মালয়েশীয় সংবাদপত্র চায়না প্রেস’র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কেদাহ প্রদেশের একটি গ্রামে ২০টি সাদা পতাকা উত্তোলনের পর দেশটির অগ্নিনির্বাপণ দফতরের এক স্বেচ্ছাসেবক সেখানে জরুরি সহায়তা পৌঁছে দিয়েছেন।
পত্রিকাটি বলছে, গত ছয় সপ্তাহ ধরে মালয়েশিয়ার অনেক পরিবার কিছুই উপার্জন করতে পারেনি এবং সামনের দিনে তাদের খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে তারা চিন্তিত। বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও মানবিক সহায়তার এই ক্যাম্পেইনে যোগ দিয়েছে।
মালয়েশিয়ার নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সুপারমার্কেট চেইন ইকোএনসেভ ফেসবুকে ঘোষণা দিয়েছে যে, কোথাও যদি কারও সাহায্যের প্রয়োজন হয় বা কারও বাড়িতে সাদা পতাকা দেখলে তাদেরকে যেন সঙ্গে সঙ্গে জানানো হয়।
মালয়েশিয়ার পেতালিং জায়া শহরের একটি জনপ্রিয় ক্যাফের নাম অসাম ক্যান্টিন। চলমান মহামারিতে দরিদ্র মানুষের পাশে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে এই প্রতিষ্ঠানটিও।
অসাম ক্যান্টিন জানিয়েছে, ক্যাশিয়ারের কাছে কোনো ব্যক্তি নিজের সমস্যার কথা জানালে সঙ্গে সঙ্গে তারা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে বিনামূল্যে খাবার দিয়ে দেবেন।
এদিকে চলমান পরিস্থিতিতে কর্মহীন হয়ে পড়েছেন কয়েক হাজার বিদেশি কর্মীরাও। এরই মধ্যে মালয়েশিয়ানদের পাশাপাশি হাজার হাজার কর্মীর চাকরি চলে গেছে। চলছে আর্থিক সংকট। ঠিক এমন সময় কয়েকজন প্রবাসী ও কমিউনিটি সংগঠন তাদের সহযোগিতার হাত খোলা রেখেছেন। তাদের উদ্দেশ্য আত্মপ্রচার নয়।
তারা মানবতার সেবায় নীরবে নিভৃতে মালয়েশিয়ায় কর্মহীন প্রবাসীদের সহযোগিতা করে যাচ্ছেন প্রতিনিয়ত। তারা প্রমাণ করেছেন, ইচ্ছে থাকলে কাজের মধ্যে থেকেও মানুষের কল্যাণে এগিয়ে আসা যায়। প্রয়োজন শুধু মানসিকতা।এই মানবতার ফেরিওয়ালাদের একজন হলেন, বাংলাদেশ প্রেসক্লাব অব মালয়েশিয়ার সভাপতি ও বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মনির বিন আমজাদ।
গত তিন সপ্তাহ ধরে মালয়েশিয়ার বিভিন্ন স্থানে কঠোর লকডাউনের মাঝে কর্মহীন হয়ে ঘরে বসে থাকা বাংলাদেশি, মালয়েশিয়ান, ইন্দোনেশিয়ান ও মিয়ানমারের নাগরিকসহ বিভিন্ন দেশের নাগরিককে এ সহায়তা দিয়ে আসছেন তিনি।
মনির বিন আমজাদ জানান, শুধুমাত্র মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে তিনি এ পর্যন্ত প্রায় ১২ হাজার প্যাকেট খাদ্য সহায়তা দিয়েছেন। খাদ্য সহায়তার মধ্যে রয়েছে চাল, আলু, ডাল, পেঁয়াজ, সবজি ও তেল। এছাড়াও স্থানীয় ৩০০ পরিবারকে নগদ অর্থ সহায়তাও দেয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, প্রায় এক মাসের মতো হতে চললো মালয়েশিয়ায় চলমান কঠোর লকডাউন। লকডাউনের কবলে পড়ে কর্মহীন হয় হাজার হাজার মানুষ। ইতোমধ্যে জানতে পারি অনেকেই আছেন খাদ্য সংকটে। যাদের বড় একটি অংশ আমাদের প্রবাসী বাংলাদেশি।
তাই সকলের কথা চিন্তা করে মানবিক উদ্দেশ্যে প্রায় ৮ হাজার মানুষের কাছে খাদ্য সামগ্রী ও নগদ অর্থ বিতরণ করেছি। এ সময় মালয়েশিয়ায় অবস্থারত সকল সামর্থ্যবান বাংলাদেশিদেরও সহযোগিতার হাত বাড়াতে সবার প্রতি অনুরোধ জানান তিনি।
প্রবাসী অধিকার পরিষদ মালয়েশিয়ার পক্ষ থেকেও খাদ্য ও আর্থিক সহায়তা অব্যাহত রেখেছে। পরিষদের সভাপতি জাহিদ হাসান জানান, সংগঠনের পক্ষ থেকে এ সহায়তা অব্যাহত থাকবে। এছাড়া মিজান গ্লোবাল এম এস ডিএন বিএইচডি ও নাদিয়া এম এসডি এন বিএইচডি কোম্পানিও খাদ্য সহায়তা দিচ্ছে বলে জানা গেছে।
এমআরএম