মতামত

করোনাকালে সমালোচনা নয়, প্রয়োজন সমঝোতার

ড. প্রণব কুমার পান্ডে

Advertisement

পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশও শতাব্দীর সবচেয়ে ভয়াবহতম সময়ের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হচ্ছে। কোভিড-১৯ এর প্রথম ঢেউ আমরা সাফল্যের সাথে উত্তরণ করতে সক্ষম হলেও দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময় দেশের অবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। গত একমাস ধরে প্রতিদিনের সংক্রমণের হার এবং মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। ইতোমধ্যেই দেশে প্রতিদিনের শনাক্তের সংখ্যা ১১০০০ এর উপরে। একই সাথে মৃত্যুর সংখ্যা ২০১ এর উপরে রয়েছে। পরিস্থিতির ভয়াবহতা বিবেচনায় সরকার গত ১ জুলাই থেকে এক সপ্তাহের জন্য কঠোর লকডাউন বাস্তবায়ন করছে। ইতোমধ্যে আমরা লক্ষ্য করেছি লকডাউন এর মেয়াদ আগামী ১৪ জুলাই পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়েছে। কিন্তু গত এক সপ্তাহের লকডাউন বাস্তবায়নের ফলে সংক্রমণের হারের ক্ষেত্রে তেমন ইতিবাচক প্রভাব পড়তে এখন পর্যন্ত দেখা যায় নি।

পৃথিবীর অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতা এবং জন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতামতের আলোকে এটা বলা যায় যে, কোন দেশে যখন সংক্রমণের হার চূড়ায় পৌঁছে যায় সেখান থেকে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করতে লকডাউন কার্যকর করা ছাড়া আর অন্য কোন বিকল্প নেই। তবে লকডাউন কার্যকর করলেই সংক্রমণের হার কমে আসবে না। কঠোর লকডাউন বাস্তবায়ন করলে ২ থেকে ৪ সপ্তাহ অথবা কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারও বেশি সময় লেগেছে সংক্রমণের হার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে কমে আসার ক্ষেত্রে। পরিস্থিতি বিবেচনায় আমাদের অন্তত আরো দুই সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হবে সংক্রমণের চেইনটাকে ভেঙে দেওয়ার জন্য। তবে এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে কঠোর লকডাউন বাস্তবায়নের মাধ্যমে জনগণকে বাসায় রাখা এবং করোনা সুরক্ষা বিধি পুরোপুরি মেনে চলতে বাধ্য করা।

করোনাকালীন সময়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এক ধরনের নিস্তব্ধতা বিদ্যমান। এটি খুব সাধারণভাবে অনুমান করা যায় যে করোনা নিয়ন্ত্রণের যে তিনটি কৌশল এখন পর্যন্ত স্বীকৃত হয়েছে তার একটি হচ্ছে জন সমাগম এড়িয়ে চলা। ফলে, রাজনৈতিক দলগুলো তাদের কার্যক্রমগুলোকে কখনো কখনো ভার্চুয়ালি এবং কখনো কখনো ঘরোয়া ভাবেই পালন করছে। তবে, পাশাপাশি আরেকটি বিষয় লক্ষণীয় যে সরকার যখন প্রাণান্তকর চেষ্টা করছে করোনার ভয়াল থাবা থেকে অর্থনীতি এবং জনগণকে রক্ষা করার জন্য, ঠিক সেই সময় বাংলাদেশের একটি বিরোধী রাজনৈতিক দল সবসময় সরকারের সমালোচনায় ব্যস্ত রয়েছে। তাদের সমালোচনা যত না করোনা কেন্দ্রিক সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ সম্পর্কিত, তার চেয়ে বেশি তাদের নেত্রীর মুক্তির দাবিতে অথবা তাকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর জন্য।

Advertisement

গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় যে কোনো অতিমারি চলাকালীন সময়ে রাজনৈতিক সমঝোতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বাংলাদেশের বাস্তবতায় এই ধরনের সমঝোতা খুব বেশি দেখা যায় না। তবে এক্ষেত্রে সরকারের তরফ থেকে হয়তো কিছু কিছু ক্ষেত্রে সমঝোতার জন্য বিরোধী দলগুলোর সাথে আলোচনা চালিয়ে যাওয়া যেত। তবে, সংসদীয় রাজনীতির বাস্তবতায় এখন যে সমস্ত বিরোধী দল সংসদে প্রতিনিধিত্ব করছে তাদের সংখ্যা বিবেচনায় নিয়ে সরকার সেই সমস্ত বিরোধী দলের সাথে মূলত আলোচনা চালিয়ে এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করছে।

সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিচার করলে অবশ্যই এটি সঠিক সিদ্ধান্ত। পাশাপাশি দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় অন্যান্য বিরোধী রাজনৈতিক দল যারা এক সময় সংসদে প্রধান বিরোধী দল হিসেবে প্রতিনিধিত্ব করেছে বা সরকারে ছিল তাদের সাথে আলোচনা করা যেত। তবে এটা ঠিক যে সরকারের তরফ থেকে কোনো আলোচনায় আমন্ত্রণ জানানো হলে তারা সে আলোচনায় অংশ নিতেন এই বিষয়ে নিশ্চয়তা দেয়া খুব কঠিন। আমরা পূর্বেই লক্ষ্য করেছি বিভিন্ন সময়ে দেশের সরকার পরিবর্তনের জন্য সংসদীয় নির্বাচন কেন্দ্রিক ভিন্নমতের সময় বর্তমান সরকারের আলোচনার প্রস্তাব সেই বিরোধীদল বারবার প্রত্যাখ্যান করেছে। এই প্রত্যাখ্যানের মধ্য দিয়ে তারা আসলে রাজনীতির আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে।

অতিমারি বা মহামারি চলাকালীন সময়ে দেশের জনগণ কিংবা অর্থনীতি রক্ষা করার ক্ষেত্রে সরকার যেমন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, তেমনি যারা নিজেদেরকে বিরোধীদল হিসেবে দাবি করে তাদেরও একই রকম দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে এই অতিমারি চলাকালীন সময়ে জনগণকে রক্ষা করতে সরকারকে সহায়তা করা। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার মূল ভিত্তি হচ্ছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সহঅবস্থান। কিন্তু বাংলাদেশের বাস্তবতায় সেটি আমরা খুব বেশি দেখি না। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সরকারের ভুল সিদ্ধান্তের সমালোচনা করবে বিরোধী দল এটি যেমন বাস্তবতা, ঠিক তেমনি ভাবে বিরোধিতার খাতিরে সকল কাজের বিরোধিতা করাটা কখনোই কাম্য নয়। কিন্তু আমরা যদি বাংলাদেশের গত এক দশকের রাজনীতির প্রেক্ষাপট বিবেচনা করি তাহলে দেখব বিরোধীদলগুলো সব সময় সরকারের সমালোচনা করেছে সমালোচনা করার খাতিরে।

কোনো রাজনৈতিক দল যখন সরকারে থাকে তখন তারা সকল কাজই সঠিকভাবে করবে- এটি কখনোই প্রত্যাশা করা যায় না। সরকারের খারাপ কাজের যেমন সমালোচনা করার অধিকার বিরোধী দলের রয়েছে, ঠিক তেমনি গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় সরকারের ভালো কাজের প্রশংসা করার দায়িত্ব রয়েছে বিরোধী দলের। এই ভাবে যদি সরকার এবং বিরোধী দল তাদের নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করে তখনই দেশে গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকরণ হয়। আমরা আমাদের পাশের দেশ ভারতের কথা যদি চিন্তা করি তাহলে দেখব যে দেশের বিভিন্ন ক্রান্তিকালে সকল বিরোধীদল সরকারকে সমর্থন প্রদান করেছে। দেশের স্বার্থবিরোধী যখনই কোনো ঘটনা ঘটেছে কিংবা অন্য কোন দেশের সাথে সংঘাত হয়েছে তখন দল-মত নির্বিশেষে সকলে সরকারের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। এমনকি করোনা অতিমারির সময়ে যখন ভারত বিপর্যস্ত অবস্থার মধ্যে দিয়ে চলছিল ঠিক তখনই সরকারের বিভিন্ন ইস্যুতে বিরোধীদলগুলো ঐক্যমত না থাকলেও তারা সরকারকে সমর্থন করেছে এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য। এটি আসলে গণতন্ত্রের প্রকৃত মজা।

Advertisement

কিন্তু বাংলাদেশের বাস্তবতাটা পুরোটাই ভিন্ন। বাংলাদেশের যে রাজনৈতিক দলটি নিজেদেরকে বৃহত্তম বিরোধী দল হিসেবে দাবি করে তাদের কিছু রাজনৈতিক ভুলের কারণে তারা সংসদে নিজেদের প্রতিনিধিত্ব হাস্যকর অবস্থায় নিয়ে গেছে। জাতীয় সংসদের বিরোধী দল হিসেবে তাদের প্রাপ্য সম্মান তারা নিজেরাই হারিয়েছে। এর সাথে রয়েছে কিছু ব্যক্তিগত এজেন্ডা নির্ভর রাজনীতি। ক্ষমতার বাইরে থাকলেই যে রাজনৈতিক দল জনগণের কথা ভুলে যাবে এটি কখনোই কাঙ্ক্ষিত না। এই রাজনৈতিক দলটি যত না জনগণের কথা চিন্তা করে, তার চেয়ে অনেক বেশি চিন্তা করে তাদের নেতা এবং নেত্রীর বিষয়ে। স্বভাবতই তারা জনগণের সামনে এমন কোন এজেন্ডা উপস্থাপন করতে পারেনি যাতে আকৃষ্ট হয়ে জনগণ তাদের পক্ষে কথা বলবে।

এটা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই যে প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দলের রাজনীতির নিজস্ব কিছু কৌশল আছে। কিন্তু দেশ ও জাতি যখন অতিমারির বিপর্যয়ে আক্রান্ত তখন প্রতিটি রাজনৈতিক দলের উচিত নিজেদের ব্যক্তিগত এজেন্ডা বাস্তবায়ন না করে সকলে এক হয়ে দেশ ও জাতিকে এই অবস্থা থেকে উত্তরণে সরকারকে সহায়তা করা। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে করোনা পরিস্থিতিতে যে বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভাবে আবির্ভূত হয়েছে সেটি হচ্ছে অর্থনীতি এবং জনগণকে রক্ষা করার জন্য বর্তমান সরকারের প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা।

আমরা এখন পর্যন্ত বিরোধী দলগুলোর এমন কোনো ভূমিকা দেখি নি যাতে তাদের ওপরে জনগণ ভরসা রাখতে পারে। অতএব সকল রাজনৈতিক দলের উচিত অতিমারির সময় নিজেদের বিভেদ ভুলে একে অপরের সাথে মিলে এই অবস্থা থেকে উত্তরণের চেষ্টা করা। আমাদের মনে রাখতে হবে আমরা শতাব্দীর সবচেয়ে খারাপ সময় অতিবাহিত করছি। এখন সময় নয় সমালোচনার, কিংবা সংঘাতে জরানোর। এখন সময় সমঝোতার। সরকারি দল এবং বিরোধী দল যদি সমঝোতার ভিত্তিতে এক হয়ে কাজ করে, তবেই আমরা অতিমারি থেকে খুব দ্রুতই মুক্ত হতে পারব। দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এই রকম একটা অবস্থা তৈরি হলে জনগণ সবচেয়ে বেশি খুশি হবে।

লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের প্রফেসর।

এইচআর/এএসএম