দেশে এখন কার্যত কোনো রাজনীতি নেই। করোনা মহামারি অনেক কিছুই উলটপালট করে দিয়েছে। কোনো কিছুই আর স্বাভাবিকভাবে চলছে না। সরকার আছে ঠিকই তবে সরকারের নিয়ন্ত্রণ কাদের হাতে সে প্রশ্ন খোদ জাতীয় সংসদের আলোচনায়ই উঠেছে। রাজনীতিবিদরা রাজনীতি থেকে দূরে, এখন আমলাদের হাতে নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা। ব্যবসায়ী-আমলা মিলে একটি চক্র গড়ে উঠেছে। আওয়ামী লীগের একজন প্রবীণ নেতা, যার ঝুড়িতে বাংলাদেশের রাজনীতির উত্থানপতনের অনেক কাহিনি জমা , অল্প বয়সেই যিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের রাজনৈতিক সচিবের দায়িত্ব পালন করেছেন, সেই তোফায়েল আহমেদ সম্প্রতি রাজনীতিতে আমলাপ্রাধান্য নিয়ে সংসদে কিছু ক্ষোভের কথা প্রকাশ করেছেন। তবে সরকার প্রধান এ নিয়ে মুখ না খোলায় এটা নিয়ে আলোচনা আর তেমন আগায়নি ।
Advertisement
বিএনপি এখন ভার্চুয়ালি কিছুটা সক্রিয় আছে। বাস্তবে সক্রিয় থাকার অবস্থা নেই। করোনার দুঃসময় কাটলে বিএনপির যে খারাপ সময় যাচ্ছে সেটা কাটবে কিনা তা এখনই বলা মুশকিল। তবে গত ২ জুলাই বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এক ভার্চুয়াল আলোচনায় বলেছেন, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে আন্দোলন ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। আন্দোলন ছাড়া কেনো বিকল্প নেই – এটা কোনো নতুন কথা নয়। প্রশ্ন হলো, আন্দোলন করতে বিএনপিকে নিষেধ করেছে কে? বিএনপি তো কয়েক বছরে কম চেষ্টা করেনি। করোনার আগে আন্দোলনের কত কর্মসূচিই তো বিএনপি দিয়েছে কিন্তু ফল কি হয়েছে? সরকারকে দুর্বল করতে গিয়ে, আওয়ামী লীগের পায়ের নিচে মাটি আলগা করতে গিয়ে বিএনপি নিজে ক্রমাগত দুর্বল হয়েছে, পায়ের নিচের মাটি হারিয়েছে।
বিএনপি নেতাদের বিভিন্ন সময়ের বক্তব্য শুনে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে কারো কারো বিভিন্ন বিষয়ে ‘বিপ্লবী’ পোস্ট দেখে অনেক আগে শোনা একটি চুটকি মনে পড়ছে। একদিন এক লোক একটি উঁচু পাহাড়ের সামনে দাঁড়িয়ে গম্ভীরভাবে কিছু ভাবছিলেন। আরেক লোক অনেকক্ষণ এটা দেখে কৌতূহল দমন করতে পারলেন না। অন্যের ব্যাপারে মানুষের কৌতূহল একটু বেশিই থাকে। তিনি ভাবুক ব্যক্তির কাছে গিয়ে বললেন, কিছু মনে না করলে আপনাকে একটি প্রশ্ন করতে পারি?ভাবতে ভাবতেই তিনি জবাব দিলেন। করুন?- আপনি কি কিছু নিয়ে বিশেষ চিন্তিত?- হুম।- কি নিয়ে?- আমার মন চায়, এই পাহাড়টা তুইলা আছাড় মারি।- ভালো তো। মারুন না। এখানে কেউ বাধা দেওয়ার নেই।- ভাইরে শক্তিতে যে কুলায় না!
কিছু করতে হলে শুধু ইচ্ছা থাকলেই হবে না। সামর্থ্যও থাকতে হবে। ফেসবুকে যারা ঝড় তোলেন তারা খারাপ কিছু সহ্য করতে পারেন না। তারা শুধু ভালোর প্রত্যাশা করেন। কিন্তু পৃথিবীতে ভালো-খারাপের দ্বন্দ্ব তো নতুন কিছু নয়। ভালো চাই, খারাপ করি। পৃথিবীতে হয়তো ভালো মানুষের সংখ্যাই বেশি। সংখ্যায় খারাপ মানুষ কম। কিন্তু সংখ্যাগুরু ভালো মানুষেরা হলেন, নির্বিরোধ এবং নিষ্ক্রিয়। সংখ্যালঘু খারাপ মানুষ আবার সক্রিয় এবং যা খুশি তাই করে ফেলতে পারেন। তাই পৃথিবী নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা ভালো মানুষের চেয়ে খারাপ মানুষের হাতেই বেশি থাকে বা চলে যায়।
Advertisement
ভালো মানুষ যদি ক্ষমতাবান হয়ে একটি খারাপ কাজ করেন তাহলে ভালো মানুষেরা একযোগে তার বিরোধিতা করেন, হৈচৈ করেন। খারাপ মানুষেরা খারাপ করলে, হয়তো মৃদু সমালোচনা করেন, তবে তাড়াতাড়ি তা ভুলেও যান। আমরা ভালো মানুষের শাসন চাই, সুশাসন চাই – এটা যদি সত্য হয়, আন্তরিক হয়, তাহলে খারাপ শাসন চলে কীভাবে? আমাদের চাওয়ায় কী কোনো ভেজাল আছে, গলদ আছে?
আওয়ামী লীগ এখন ক্ষমতায় আছে। টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার রেকর্ড গড়েছে দলটি। আমাদের দেশে শুধু নয়, অন্য অনেক দেশেও শেখ হাসিনার চেয়ে আর কেউ এত দীর্ঘ সময় সরকার প্রধানের দায়িত্ব পালন করতে পারেননি। তিনি তার শাসনকালে ভালো কাজ বেশি করেছেন, না খারাপ কাজ বেশি সেটা একটি দীর্ঘ আলোচনা ও বিতর্কের বিষয়।
আমি যদি বলি, শেখ হাসিনা ভালো কাজ বেশি করেছেন, সঙ্গে দুই্একটি মন্দ কাজও করেছেন। সঙ্গে সঙ্গে হয়তো একজন বলে উঠবেন, বলেন কী, শেখ হাসিনার মতো দুঃশাসক আর হয় না।
যদি বলি, তিনি তাহলে ক্ষমতায় টিকে আছেন কীভাবে? জবাব পেতে দেরি হবে না : আরে, ক্ষমতায় তো আছেন জোর করে। সামরিক-বেসামরিক আমলা এবং একটি লুটেরা ব্যবসায়ী চক্রের ওপর নির্ভর করে। বিরোধী দলকে ফ্যাসিস্ট কায়দায় দমন করে।
Advertisement
যদি বলি, হাসিনার আগে জিয়া-এরশাদ-খালেদা জিয়াও তো জোর করে ক্ষমতায় থাকার নানা রকম চেষ্টা করেছেন। পারেননি কেন? শেখ হাসিনা কী কেবল জবরদস্তি করেই ক্ষমতায় আছেন, নাকি তার পেছনে জনসমর্থনও আছে? অমনি জবাব পাওয়া যাবে, রাখেন আপনার দালালি। মানুষের ভোটের অধিকার একবার ফিরিয়ে দিতে বলেন, দেখেন জনসমর্থন কোন দিকে!আমি যদি বলি, ঠিক আছে, লুটপাট, দুর্নীতি শেখ হাসিনার আমলেও হচ্ছে। কিন্তু শুধু কি আওয়ামী লীগের চাটার দলেরই পেট ভরছে? মানুষ কি কোনো উপকার পায়নি, পাচ্ছে না? বিদ্যুৎখাতে দুর্নীতি আছে। কিন্তু বিদ্যুৎ সংকট তো দূর হয়েছে। খালেদা শুধু খাম্বা দিয়েই দায়িত্ব পালন করেছেন। খালেদার আমলে কৃষক সার পায়নি, পানি পায়নি, গুলি পেয়েছে। হাসিনার সময় কি সার বা কৃষি উপকরণের সংকট হয়েছে?
জবাবদাতা প্রস্তুত, বলবেন, কথায় কথায় খালেদা জিয়ার সময়ের উদাহরণ টানা কেন? খালেদা খারাপ বলেই তো মানুষ হাসিনার ওপর আস্থা রেখেছিল। হাসিনা মানুষের আস্থার মর্যাদা রাখতে পারেননি।
আমি যদি বলি, আচ্ছা, শেখ হাসিনাকে ভোটের মাধ্যমে পরাজিত করে কাকে ক্ষমতায় আনা হবে? সঙ্গে সঙ্গে জবাব পাবো : মানুষ যাকে পছন্দ করবে, সেই ক্ষমতায় আসবে।
আচ্ছা, আমাদের ভোটের অভিজ্ঞতা কি বলে? মানুষ কি ভালো মানুষকে ভোট দেয়, নাকি দল এবং মার্কা দেখে ভোট দেয়? রাজনীতিতে ভালো মানুষ যারা ছিলেন, তারা বিলুপ্তপ্রায় হয়ে গেলেন কেন? ভালো রাজনীতিকের প্রতি মানুষের সমর্থন থাকলে রাজনৈতিক দলগুলো খারাপ মানুষকে কাছে টানার সাহস পেতো কি?
রাজনৈতিক দলের প্রধান লক্ষ্য ক্ষমতা। রাজনৈতিক দলের নীতি, কৌশল, কর্মসূচি প্রণীত হয় ক্ষমতায় যাওয়ার পথ তৈরির জন্যই। আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলাম বা রামকৃষ্ণ মিশনের মতো শুধু সেবাদান কোনো রাজনৈতিক দলের লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য নয়। জনসেবার ব্রতের কথা একসময় রাজনীতিবিদের মুখে শোনা গেলেও এখন সময় পাল্টেছে। চিন্তার জগতেও এসেছে পরিবর্তন। এখন প্রতিযোগিতার সময়।
তারপরও এখনও কারো কারো নিজেকে ‘বিপ্লব স্পন্দিত বুকে মনে হয় আমিই লেনিন'। কিন্তু ওটা মুখে, কাজে নয়!
যেকোনো পরিবর্তনের জন্য হুজুগ নয়, দরকার হয় সচেতন ও সংগঠিত জনশক্তির। এখন আমাদের অনেকেই ভাবুক হয়ে ভাবসাগরে হাবুডুবু খেতে ভালোবাসি। কিন্তু গায়ে-গতরে রোদ-মেঘ একটু মাখামাখি করুক তা চাই না। পাহাড় তুলে আছাড় মারার অবাস্তব কল্পনা নয়, এখন দরকার ভালোর পক্ষে একটি দল গড়ে তোলা। ‘এ’-এর বিকল্প ‘বি'- এই সনাতন চিন্তায় আটকে না থেকে ‘সি' কিংবা ‘ডি'র পক্ষে সমবেত হওয়ার বাস্তব কাজে হাত দেওয়াই এখন জরুরি। সৎ ও সাহসী মানুষদের খোলস থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। জড়তা নয়, দরকার তীব্র একটি ঝাঁকি। সেই ঝাঁকি কে দেবে, তারই এখন অপেক্ষা।
লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক, কলামিস্ট।
এইচআর/এএসএম