মতামত

আফগানিস্তানের সমস্যা ও সম্ভাবনা

স্কোয়াড্রন লিডার অব. সাদরুল আহমেদ খান

Advertisement

১. মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটো বাহিনী যেভাবে আফগানিস্তানে এসেছিল:কোনও বিদেশী শক্তির আফগানিস্তান আক্রমণ করা সহজ, বিজয় করা কঠিন এবং শাসন করা অসম্ভব।

১৯১৯ সালে ব্রিটিশরা আফগানিস্তানকে স্বাধীনতা দিতে বাধ্য হয়েছিল। রাজা জহির শাহের নেতৃত্বে ১৯৬০ সালের দিকে আফগানিস্তান সকল সূচকে উন্নয়নের শীর্ষে ছিল। ১৯৭১ সালে দাউদ খান বিদ্রোহ করে আফগানিস্তানের রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন। ১৯৭৮ সালে আফগানিস্তানে রাশিয়া সমর্থক কমিউনিস্ট পার্টির আরেকটি পাল্টা অভুথান ঘটেছিল । নতুন সরকার গঠিত হয়েছিল তবে কমিউনিস্ট পার্টির মূল বিষয় (সোভিয়েট সংস্করণ)ভূমি সংস্কারের প্রশ্নে প্রচুর চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছিল । ১৯৭৯ সালে সোভিয়েত রাশিয়া কমিউনিস্ট সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য আফগানিস্তানে সেনাবাহিনী প্রেরণ করেছিল, তবে তারা পরাজিত হয় এবং ১৯৮৯ সালে তাদের প্রত্যাহার করা হয়, যা পরবতিতে ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের অন্যতম কারণ ছিল।

১১ সেপ্টেম্বর ২০০১-এ আল-কায়দার টুইন টাওয়ার আক্রমণের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটো বাহিনী ২০০১-২০১৪ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তানে "অপারেশন এন্ডরিং ফ্রিডম" পরিচালনা করেছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বকে জানান দিয়েছিল , “হয় আপনি আমাদের সাথে আছেন অথবা আমাদের বিপক্ষে।“ একইসাথে, ৪৯ টি দেশ ন্যাটো-এর ছায়ায় আন্তর্জাতিক সুরক্ষা সহায়তা বাহিনীর (আই এস এ এফ) নামে আফগানিস্থানে সন্ত্রাস বিরোধী সামরিক অভিযান শুরু করেছিল। জাতিসংঘ সুরক্ষা কাউন্সিল ২০০১ এর ডিসেম্বরে রেজোলিউশন ১৩৮৬ দ্বারা আইএসএএফ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।

Advertisement

২. আফগানিস্তানে ২০ বছরে মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটো বাহিনীর অর্জন?মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটো বাহিনী তালেবানকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিয়ে অস্থায়ীভাবে আল-কায়েদারদের তাড়িয়ে দেয়। এটি অর্জনে এই যুদ্ধে ৩,৫০০ এরও বেশি বিদেশী সেনা এবং ১০ লক্ষেরও বেশি বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছেন। গত ২০-বছরের জীবন, জীবিকা এবং অর্থ ব্যয়ের দিক দিয়ে এই সামরিক অভিযান সবচেয়ে ব্যয়বহুল। মার্কিন করদাতার জন্য অপ্রাপ্তির এই যুদ্ধে এতো মার্কিন ডলার ব্যয় এক বিস্ময়কর ঘটনা। বিশ বছর পেরিয়ে গেলেও ন্যাটো বাহিনী এখনও আফগানিস্তানে শান্তি প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ। ট্রাম্প প্রশাসন আফগানিস্তানের ইস্যুতে মার্কিন ক্ষয়ক্ষতি থামাতে চেয়েছিল, তারা যুক্তি দিয়েছিল যে, ২০০১ সালের চেয়ে দেশটি আরও ভাল অবস্থানে রয়েছে এবং তালেবানরা আরও উন্মুক্ত মনের অধিকারী হয়েছে। আর তাই আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহার সিদ্ধান্ত নেয় ট্রাম্প ।

ট্রাম্প প্রশাসনের সাথে তালেবানদের চুক্তি অনুসারে ২০২১ সালের ১ মে তারিখের মধ্যে, সমস্ত বিদেশী সশস্ত্র বাহিনী আফগানিস্তান ছেড়ে যাওয়ার কথা ছিল। বাইডেন প্রশাসন এই সময়কাল ১১ ই সেপ্টেম্বর ২০২১ পর্যন্ত বাড়িয়েছিলেন এবং প্রতীকী ৯/১১ দিনে এই সৈন্য প্রত্যাহারটি সম্পন্ন হবে বলে সিদ্ধান্ত নেয় ।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে এসেছিল তালেবানদের সন্ত্রাসী কার্যক্রম শেষ করার জন্য- তবে এখন তারা চলে যাচ্ছে এমন এক সময়ে যখন তালেবানরা ক্রমাগত ক্ষমতায়িত হচ্ছে, এবং শীঘ্রই তারা আফগানিস্থানের দখল নিবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ন্যাটো সেনা প্রত্যাহার শুরু হতে না হতেই তালেবানরা দেশজুড়ে প্রায় ৪০ টি জেলা দখল নিয়েছে। আফগানিস্তানের ৩৮৭ টি জেলার মধ্যে এখন লড়াই চলছে ১১৬ জেলায়।

৩. মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটো বাহিনীর প্রত্যাবাসন শেষে আফগানিস্তানের সম্ভাব্য সমস্যা:ইতিহাস বলেছে যে, সোভিয়েত বাহিনী প্রত্যাবাসন শেষে আফগানিস্তানে তালেবানরা ক্ষমতায় এসেছিল, তাদের মনোনীত সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আল-কায়েদা আফগানিস্তানে সন্ত্রাসী প্রশিক্ষণ শিবির স্থাপন ও জিহাদিদের নিয়োগ করতে সক্ষম হয়েছিল। একইভাবে, ইরাক থেকে মার্কিন বাহিনী প্রত্যাবাসন শেষে আইএসআইএস ( ইসলামিক স্টেইট) আবির্ভাব ঘটেছিল। ২০২১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরে মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটো বাহিনী প্রত্যাবাসন শেষে আফগানিস্থানে আবারও সন্ত্রাস দেখা দিতে পারে, তালেবান, আল-কায়েদা বা দায়েশ নামে নতুন কোন সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর আগমন ঘটতে পারে।

Advertisement

প্রেসিডেন্ট আশরাফ গণির পতন ঘটিয়ে আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ নিতে পারে তালেবানরা। মনগড়া শরিয়া আইন প্রতিষ্ঠিত করে দেশকে ৯০ এর মতো উগ্রপন্থার প্রজনন ভূমিতে পরিণত করতে পারে । আইএসআইএসের মতো সন্ত্রাসী বাহিনীতে যোগদান ও প্রশিক্ষণের জন্য পশ্চিমা দেশ থেকে বিদেশী সন্ত্রাসী যোদ্ধাদের আফগানিস্থানে প্রবেশের ডেউ আসতে পারে, কেননা ন্যাটো বাহিনী চলে যাওয়ার পরে আফগান সীমান্ত অরক্ষিত থাকবে ।

আল-কায়েদা, ইসলামিক স্টেট (আইএস), দায়েশ এবং অন্যান্য জঙ্গি গোষ্ঠী আফগানিস্তান থেকে কখনও নিরমূল হয়নি; তারা ন্যাটো বাহিনীর আসন্ন প্রত্যাবর্তনের খবরে উৎসাহিত হয়েছে। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, যদি জিহাদি জঙ্গি গোষ্ঠী আফগানিস্তানে ভালভাবে জেঁকে বসে, তবে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের নামে আমেরিকা আবার হস্তক্ষেপ করতে পারে, আমেরিকা তখন দক্ষিণ এশিয়া, মধ্য এশিয়া বা নতুন দেশ খুঁজে পাবে যা খনিজ সম্পদসমৃদ্ধ বা ভাল ভৌগলিক অবস্থানে রয়েছে।

আফগানিস্তান এখন গৃহযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে, কারণ বিশৃঙ্খলা এখনও শেষ হয়নি। যদিও বর্তমান আফগান সরকার তুরস্ককে রাখতে চায়, তবে তালেবান জানিয়েছে তুরস্ক ন্যাটো সদস্য এবং ন্যাটো সদস্যদের সাথে তুর্কিদেরও প্রত্যাহার করা উচিত হবে। তুরস্ক এই অঞ্চলের নতুন নেতা হিসাবে আবির্ভূত হয়ে আফগানিস্তানে কাজ করতে পারে। গত ২০ বছর তুরস্ক আফগানিস্তানে নন- কমব্যাট ভূমিকায় নিযুক্ত ছিল। তুরস্কের এই নতুন লড়াইয়ের ভূমিকা শুরু করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটোর অন্যান্য সদস্য দেশগুলির যৌক্তিক, আর্থিক, রাজনৈতিক এবং সৈন্য সমর্থন প্রয়োজন। রাজনৈতিক সহায়তার সদ্ব্যবহার করে তুরস্কের এই অঞ্চলে সেনা থাকার জন্য জাতিসংঘ ও ন্যাটো কর্তৃক আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী সমরথিত হওয়া জরুরি।

আফগানি দোভাষী এবং কর্মচারীরা যারা বিগত ২০ বছর ন্যাটো বাহিনীকে সহায়তা করেছিলেন তাদের এবং তাদের পরিবারগুলো মহাবিপদের মুখোমুখি হতে পারে। তালেবানরা তাদের রেহাই দেবে না, প্রতিশোধ নেওয়ার মধ্য দিয়ে আফগানিস্তানে গৃহযুদ্ধ শুরু হতে পারে। ইইউভুক্ত দেশগুলিতে আফগানিস্তান থেকে আশ্রয়প্রার্থীদের সংখ্যার উত্থান ঘটবে। কে আফগানি কে তালিবান কে আল-কাইদা তা আলাদা করা খুব কঠিন হবে। সুতরাং ভবিষ্যতে ইইউভুক্ত দেশগুলির সুরক্ষাও ঝুঁকির মধ্যে পড়বে।

৪. এশীয় দেশগুলির জন্য ঝুঁকি:আফগানিস্তানে ন্যাটো বাহিনী প্রত্যাহারের পর আফিম বাণিজ্য, যৌন বাণিজ্য, শিশুশ্রম, জোরপূর্বক শ্রম, মাদক ও মানব পাচার আরও বাড়াবে বলে মনে হয়। তালেবানরা আফগানি ক্ষুদ্র উপজাতিদের জোর করে তুলা শ্রমিক হিসাবে উজবেকিস্তানে বিক্রি করতে পারে। আফগানিস্তান হবে মধ্য এশিয়ার অপরাধের স্বরগ রাজ্য ।ওসামা বিন লাদেন হত্যার প্রতিশোধ নিতে পাকিস্তান আল-কায়েদার আক্রমণের প্রধান লক্ষ্য হতে পারে।কেন্না, আল-কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেনের নিরাপদ আশ্রয় ছিল পাকিস্তানে কিন্তু সে গোপন ঠিকানা ফাস করেছিল পাকিস্থান । মার্কিন সেনা পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদে “অপারেশন নেপচুন স্পিয়ার” পরিচালনা করে লাদেন কে হত্যা করেছিল। অপহরণ বাড়বে, তাই মধ্য এশিয়া অঞ্চলের ভ্রমণ ও পর্যটন খাত ক্ষতিগ্রস্থ হবে।এনজিও এবং মানবিক কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাবে, ফলস্বরূপ মানব বিকাশ সূচকের পতন ঘটবে আফগানিস্তানে।

তালেবানদের সাথে ধর্মীয় মতপার্থক্যের কারণে, আফগানিস্তানে ভারতীয় সহায়তা এবং বিনিয়োগ হুমকির মুখে পড়বে। যেমন সালমা বাঁধ, সংসদ ভবন, চাবাহার বন্দর ইত্যাদি, ইতিমধ্যে আফগানিস্তানে অবস্থানরত ভারতীয় নাগরিকগণ তালেবান্দের নিশানায় পরিণত হয়েছেন।

৫. মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটো বাহিনী প্রত্যাবাসন শেষে আফগানিস্তানের সম্ভাবনা:মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটো বাহিনী চলে যাওয়ার পরে অবশ্যই একটি শূন্যতা দেখা দেবে, সহিংসতার পরিবর্তে চীনের উন্নয়ন কৌশল দ্বারা এই শুন্যতা পূরণ করা যেতে পারে। ইউরেশিয়া, মধ্য প্রাচ্য এবং দক্ষিণ এশিয়ার সাথে যোগাযোগের জন্য আফগানিস্তান চীনের প্রবেশদ্বার হতে পারে।

ইতোমধ্যে চীন ট্যাক্সকর্গান বিমানবন্দর নির্মাণসহ কয়েকটি কৌশলগত প্রকল্প চালু করেছে। চীন আফগানিস্তানের সীমান্তবর্তী পাকিস্তানের বেলুচিস্তান প্রদেশের গওয়াদার সমুদ্রবন্দরের নির্মাতা ও অপারেটরও। ট্যাক্সকর্গান এবং গওয়াদার উভয়ই চায়না পাকিস্থান ইকওনমিক করিডর (সিপিইসি) এর অধীনে তৈরি করা হচ্ছে। এই সমস্ত উন্নয়ন প্রকল্পের অবিচ্ছিন্ন ও টেকসই অগ্রগতিতে আফগানদের মানসিকতার পরিবর্তন শুরু হয়েছে, তারা এখন স্থলমাইন, বোমা, দুর্নীতি ও নিরক্ষরতার পরিবর্তে তাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য নিরাপদ ভবিষ্যতের কথা ভাবছে। ট্যাক্সকর্গান, ওয়াখন এবং গওয়াদারের কৌশলগত সম্পদগুলি চীনের অবকাঠামোগত অবস্থাঙ্কে শক্তিশালী করবে এবং এ অঞ্চলে দীর্ঘমেয়াদী অর্থনৈতিক ও সুরক্ষা লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা করবে।

চীন তার বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভস (বিআরআই) আফগানিস্তানে প্রসারিত করতে আগ্রহী এবং কাবুলকে কমপক্ষে অর্ধ দশক ধরে এটিতে যোগ দিতে অনুরোধ করছে। তবে মার্কিন-সমর্থিত আফগান সরকার বিআরআই-তে যোগ দিতে দ্বিধায় ছিল, মার্কিন বাহিনী আফগানিস্থান ত্যাগ করায় চিন সেখানে অবস্থান নিতে এবং কাবুলকে বিআরআইতে যোগ দেওয়ার জন্য প্রস্তুত করতে পারে।

আফগানিস্তানের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে পাকিস্তানের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে এবং চিনের সাথে পাকিস্থানের সুসম্পর্ক রয়েছে। চিন বিআরআই নিয়ে তালেবান ও অন্যান্য উপজাতিদের ভাল মনোভাব দেখা যাচ্ছে। এই দলগুলি বলেছে যে তারা আফগান জাতীয় স্বার্থে কাজ করে এমন উন্নয়ন প্রকল্পগুলিকে সমর্থন করবে। আফগানিস্তানে চিনা অবকাঠামো এবং অন্যান্য প্রকল্প তৈরিতে যদি তালেবানরা সহযোগীতা করে তবে চিন আরও অনেক ভাল অবস্থানে থাকবে।

উন্নয়নের মাধ্যমে শান্তি স্থাপন, এটাই হতে পারে যুক্তরাষ্ট্র পরবর্তী আফগানিস্তানে চিনের ফর্মুলা। আফগানিস্তান মধ্য এশিয়ার এমন একটি দেশ যা সর্বদা ‘মহা শক্তিধর দেশগুলির দন্দের মধ্যে ধরা পড়ে। মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটো বাহিনী আফগানিস্তান থেকে সরে আসার পরে এই অঞ্চলের বেশিরভাগ অংশে চিন প্রভাব বিস্তার করবে ব্ লে মনে হয়। মধ্য এশিয়ার এই অস্থির দেশটি আগামী দিনগুলিতেও বিশ্বকে অবাক করবে বলে ধারনা করা যায়।

লেখক : স্কোয়াড্রন লিডার (অব) সাদরুল আহমেদ খান , সাবেক ডেপুটি সার্জেন্ট-এট-আর্মস। সদস্য, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ অর্থ ও পরিকল্পনা বিষয়ক উপ-কমিটি ।

এইচআর/এএসএম