মতামত

প্রতীক প্রতীকী নয়, জাতীয় চরিত্রেরই বহিঃপ্রকাশ

পৌরনির্বাচনে সংরক্ষিত আসনের নারী প্রার্থীদের জন্য নির্দিষ্ট করা প্রতীক শুধু প্রতীকীই নয়, এটাই আমাদের রাষ্ট্রের, সমাজের, পরিবারের সার্বজনীন চিন্তারই বহিঃপ্রকাশ। আমাদের পুরো সমাজটাই আসলে ওইরকম। শুধু কয়েকজন মানুষ হয়তো ব্যতিক্রম। এজন্যই নির্বাচন কমিশনের ওই অশিক্ষিত ও মূর্খ চিন্তার বিরুদ্ধে তেমন কোনো প্রতিবাদ হয়নি। মুখে মুখে আমরা যা-ই বলি না কেন আসলে আমরা সবাই একেকজন বীর (?) পুরুষ। তা-ই যদি না হতো তাহলে আমরা জেনেশুনে বুঝে সজ্ঞানে কেন নারীদের জন্য বেছে বেছে ওইসব প্রতীক নির্দিষ্ট করে দিলাম। আমাদের রাষ্ট্র পুরুষ, সমাজ পুরুষ, পরিবার পুরুষ, সংবিধান পুরুষ, আদালত পুরুষ, আইন পুরুষ, নির্বাচন কমিশনসহ সব প্রতিষ্ঠানই পুরুষ। আমরা নারীদের জন্য চুড়ি প্রতীক নির্ধারণ করবো না তো হাতি প্রতীক দিব? নারীদের এই বলে সান্ত্বনা দেয়া উচিত যে তোমাদের শিকল প্রতীক দেইনি। শিকলের মতোই চুড়ি প্রতীক প্রতীকীভাবে দিয়েছি। তোমাদের শিকল পরিয়েইতো রাখতে চাই।  আমরাতো চাই তারা চুড়ি পরে, চুলার পাশে সারাদিন থাকুক। পুতুল খেলে সময় কাটুক, ফ্রক পরে ভ্যানিটি ব্যাগ নিয়ে চকোলেট খেয়ে হারমোনিয়াম বাজিয়ে জীবন পার করুক। বিষয়টাতো এমন নয় যে হুট করে, ভুল করে ওসব প্রতীক নির্ধারণ করা হয়েছে। আগেও নারী প্রার্থীদের এরকম প্রতীক নির্বাচন কমিশন বরাদ্দ করেছে। প্রতিবাদও হয়েছে। এরপরও নির্বাচন কমিশন ওই কাজ করেছে। চলতি বছরের ২৮ এপ্রিল অনুষ্ঠিত ঢাকার দুটি ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও নারীদের জন্য বরাদ্দ দেওয়া প্রতীক নিয়ে সমালোচনার মুখে পড়েছিল নির্বাচন কমিশন। সেসময় বাসদ সমর্থিত সংরক্ষিত আসনের প্রার্থী শম্পা বসু প্রতিবাদ করেছিলেন। বলেছিলেন, “নারী আসনের সব প্রতীক নারীরা বাড়িতে যা ব্যবহার করে সেগুলো। পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। প্রতীকগুলোর পরিবর্তন চাই।” এরপর নারী প্রার্থীর অনেকেই সরাসরি প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। কোনো পুরুষ প্রার্থী অবশ্য এ নিয়ে কোনো কথা বলেননি। নির্বাচন কমিশন তখন বলেছিল পরবর্তী নির্বাচনে প্রতীক বরাদ্দের ক্ষেত্রে সজাগ থাকবে। সজাগ আর তারা থাকতে পারেননি। সাত মাসেও তাদের ঘুম ভাঙেনি।এখন ‘বীর’ কমিশন বলছে তাড়াহুড়ো করে নির্বাচন প্রস্তুতি সস্পন্ন করায় নারীদের প্রতীকের বিষয়ে খেয়াল রাখার সুযোগ হয়নি। শুধু এইটুকু অজুহাত দিয়েই তারা থামেননি, নির্বাচন কমিশনার মো. শাহনেওয়াজ বলেছেন, প্রতীক নিয়ে সিটি করপোরেশন নির্বাচনের সময় সমালোচনার পর এবার কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে। তারপরও প্রতীক নিয়ে কারও কারও খারাপ লাগা থাকতে পারে। তবে কাউকে খাটো করার জন্য কমিশন এটা করেনি। ভবিষ্যতে প্রতীক ঠিক করার ক্ষেত্রে কমিশন আরও বেশি মনোযোগী হবে।নির্বাচন কমিশনারের ওই বক্তব্যে এটা প্রমাণ করে যে সময় স্বল্পতা ছিল না, তারা সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের সময়ের সমালোচনার কথা মাথায় রেখে প্রতীকে পরিবর্তন এনেছেন। আর সেই পরিবর্তনের ফলাফল যদি এই হয়, তাহলে এটা বলতেই হবে যে তাদের মাথায়ই ঢোকেনি ওইসব প্রতীক যে হীন মানসিকতা, মূর্খতা, সভ্যতা বিরোধী, প্রগতি বিরোধী। এটা কমিশনের নিছক খামখেয়ালী ভাবলে ভুল হবে। আসলে ওটাই আমাদের জাতীয় চরিত্র।শুধু নির্বাচন কমিশনের পুরুষতান্ত্রিক কয়েকজন মানুষের কারণে এমনটি হয়েছে এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। নির্বাচন কমিশন প্রতীক নিয়ে পরিপত্র জারির আগে কমিশন সচিবালয় সেটি প্রস্তাব করেছে। সেটি আইন মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদন নিয়েছে। এরপর পরিপত্র জারি করে সেটি রাষ্ট্রপতির কার্যালয়, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পুলিশ সদর দপ্তর,তথ্য মন্ত্রণালয়,শিক্ষা মন্ত্রণালয়,র্যা ব, বিজিবি,আনসার,নির্বাচন সংশ্লিস্ট এলাকার সব পুলিশ সুপার,নির্বাহী কর্মকর্তা ও থানার ওসি থেকে শুরু করে সব জায়গায় পাঠানো হয়েছে। এতগুলো জায়গার একটি থেকেও বিষয়টির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়নি। কারণ আমাদের একবারও চিন্তা হয়নি যে ওই প্রতীকগুলো নারীদের জন্য নির্দিষ্ট করে রেখে কোনো ভুল করেছি। এটা যে আমাদের সনাতনী চিন্তারই বহিঃপ্রকাশ।নারীর প্রতি আমাদের দৃষ্টি যে আসলেই সনাতনী তার প্রমাণ তো ঘরেই ঘরেই রয়েছে। তা না হলে একটি দেশে শতকরা ৮৭ ভাগ  নারী তাঁদের স্বামীর হাতে নিগৃহীত হন কী করে। এই হিসেব বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো পরিচালিত নারীর প্রতি সহিংসতা জরিপ ২০১১ অনুযায়ী। ২০১৫ সালে চিত্রটা একই রকম হবে কোনো সন্দেহ নেই। নির্যাতের এই হারই বলে দেয়, বাইরে আমরা সবাই নারীর প্রতি বৈষম্য কমাতে বলি, আর ঘরে ফিরেই চেহারাটা পাল্টে ফেলি। শুধু মুখোশটা পড়ে আছি বলে মাঝে মাঝে নারীর প্রতি বৈষম্য কমাতে বলি। এটা স্বীকার করতেই হবে যে আমরা এখনো পুরুষতান্ত্রিকতা থেকে বের হয়ে মানুষতান্ত্রিক হয়ে উঠিনি। এইচআর/আরআইপি

Advertisement